স্বেচ্ছামৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব

0
48

বিশ্বখ্যাত মনোবিশ্লেষক-মনোচিকিৎসক সিগমুন্ড ফ্রয়েড এর মতে মানুষের মধ্যে অবচেতনে থাকে ‘মৃত্যু প্রবৃত্তি’- পরিবেশ পরিস্থিতির প্রভাবে এই মৃত্যুর প্রবৃত্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে আর তখনই ‘মরিবার সাধ’ হয় তার। কবির কবিতায় আর চিত্র পরিচালকদের নির্দেশনায় আত্মহত্যা কখনও হয়ে ওঠে ‘মহিমান্বিত- যার ফল হয় ভয়াবহ। American Foundation For Suicide Prevention-এর মেডিকেল ডিরেক্টর, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হার্বার্ট হেনডিন বলেন, নান্দনিকতার আবরণে আত্মহত্যাকে শৈল্পিক করে দর্শক বা পাঠকের জন্য আকর্ষণীয় করা হলে তা আত্মহত্যার প্রবণতাকে বাড়িয়ে তোলে।

উদাহরণ স্বরূপ, নিউইয়র্ক টাইমসের একটি রিপোর্টের কথা তিনি বলেন, যেখানে স্কুল পড়ুয়া দুই কিশোর-কিশোরীর আত্মহত্যাকে রোমিও-জুলিয়েটের কাহিনীর সাথে তুলনা করে বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবে ‘রোমান্টিক ফ্লেভার’ দেয়ায় কিশোর-কিশোরীদের কাছে আত্মহত্যা তথাকথিত মহৎ বা অনুকরণীয় কোন দৃষ্টান্ত বলে ভুল ভাবে উপস্থাপন করা হতে পারে। পাশ্চাত্যে মধ্য বয়সী বা শেষ বয়সী মানুষেরা একাকীত্বে ভোগেন- যাকে বলা হয় empty nest syndrome. এই একাকীত্বের কারণে সেখানে ৪০-৫০ বছর বয়সী পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি আর বাংলাদেশে ১১-২৫ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

ইউরোপ-আমেরিকায় অবিবাহিত বা বিধবা-বিপত্নীকদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি হলেও বাংলাদেশে বিবাহিত নারীদের মধ্যে আত্মহত্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। সেই সাথে এদেশে কম শিক্ষিতদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি হলেও উন্নত রাষ্ট্রে শিক্ষিত পেশাজীবীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের আরেক গবেষণায় দেখা যায়, মানব মস্তিষ্কের সোরব্রোস্পাইনাল (Cerebrospinal) তরলের মধ্যে ‘৫ হাইড্রোক্সইনডোলএসেটিক এসিড (5-Hydroxyindoleacetic acid) নামক একটি রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ কমে গেলে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। আত্মহত্যা করার জন্য প্রথমে বিক্ষিপ্তভাবে মনের মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা আসে। এর পর এই বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলো বারবার আসতে থাকে, ব্যক্তি এই চিন্তা থেকে সহজে মুক্ত হতে পারে না। আত্মহত্যার চিন্তা তার স্বাভাবিক কাজকর্মের উপর প্রভাব ফেলে এবং তার আত্মহননের ইচ্ছা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। সে ভাবে ‘কেন আমি বেঁচে থাকব?’ সে জীবনের ইতি টানার চিন্তা করে। একসময় তার মনে হয় এখনই তার মরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত সময়। সে কখনও আবেগতাড়িত হয়ে মৃত্যু চেষ্টা করে আবার কখনও পরিকল্পনা করে মৃত্যুচেষ্টা করে। সফল না হলে তার মধ্যে আবার বিক্ষিপ্তভাবে আত্মহত্যার চিন্তা আসতে থাকে এবং এই চক্রটি বারবার হতে পারে। তাই যে ব্যক্তি কথাচ্ছলেও মৃত্যুর ইচ্ছা ব্যক্ত করে ধরে নিতে হবে তার আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। সেকারণে কারো মৃত্যু ইচ্ছা সংক্রান্ত কথাকে কখনই হালকা ভাবে নেয়া যাবে না।

মনে রাখতে হবে, মানসিক ভাবে যারা অসুস্থ, যারা বিষণ্ণতা, সিজোফ্রেনিয়া, ব্যক্তিত্বের বিকার বা মাদকাসক্তিতে ভুগছেন তাদের মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি অনেক বেশি। অনেক সময় অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য, কোন কিছু পাওয়ার জন্য আত্মহত্যার চেষ্টা হয়ে থাকে- এক্ষেত্রে যারা বেঁচে উঠেন তারা কিন্তু পরে অনুতপ্ত হন। তাদের মধ্যে আত্মহত্যার ইচ্ছা ততটা তীব্র থাকে না। কিন্তু যারা লোকচক্ষুর আড়ালে সুইসাডাল নোট লিখে এবং দীর্ঘ পরিকল্পনার পরে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তারা সত্যিকার অর্থেই মরে যেতে চান। তারা যদিওবা কোন কারণে আত্মহত্যা করতে ব্যর্থ হন- তবুও মনে রাখতে হবে যে এরা পরবর্তীতে আবারও আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারেন।

মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী কিন্তু স্বেচ্ছামৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব। একবারের জন্যই তো পৃথিবীতে আসা, তাই আত্মহত্যাকে ‘না’ বলতে হবে। প্রতিরোধ করতে হবে আত্মহত্যার প্রবণতা। এজন্য যে বিষগুলোর দিকে আমাদের নজর দেয়া প্রয়োজন, তা হলো-

সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি- বিভিন্ন ধর্মে ও সংস্কৃতিতে আত্মহত্যাকারী বা আত্মহত্যার চেষ্টাকারীর পরিবার সামাজিক ভাবে হেন হন। যদি আত্মহত্যা বিষয়ে এই দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটিয়ে সকলকে বিশ্বাস করানো যায় যে, আত্মহত্যার ইচ্ছা একটি ভুল মানসিক প্রক্রিয়া। এ থেকে বাঁচার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেয়া প্রয়োজন, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আত্মহত্যার উপকরণের সহজ প্রাপ্তি প্রতিরোধ করা- বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর অনেক দেশে আত্মহত্যার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কীটনাশক ও স্লিপিং পিল। লাইসেন্সের মাধ্যমে কীটনাশকের বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং কৃষকের বাড়ীতেও তা এমন জায়গায় রাখতে হবে যাতে সহজে কেউ তার নাগাল না পায়। সেই সাথে প্রেসক্রিপশন ছাড়া সবধরনের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করার কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।
মিডিয়ার ভূমিকা পরিবর্তন- আত্মহত্যার কৌশল ও মাধ্যম নিয়ে ফলাও করে পত্রিকায় বা টিভিতে সংবাদ প্রচার হলে ঐ কৌশলে আত্মহত্যা করার হার বেড়ে যেতে পারে। অস্ট্রিয়ায় ১৯৮৪ সাল থেকে সাব-ওয়েতে ট্রেনের সামনে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যার খবর নতুন পদ্ধতি হিসেবে ব্যাপক প্রচার পেতে থাকে। এতে করে এই পদ্ধতিতে আত্মহত্যার হার এমন উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকে যে ‘অস্ট্রিয়ান এসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন’ এ ধরনের রিপোর্টিং-এর বিরুদ্ধে প্রচারণ শুরু করে। এই প্রচারণা শুরুর ছয় মাসের মধ্যে সাব-ওয়েতে আত্মহত্যার হার অনেক কমে আসে। তাই আত্মহত্যার খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট সকলকে। আত্মহত্যার সংবাদ মিডিয়ায় কীভাবে প্রকাশিত প্রচারিত হবে সে বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি নীতিমালা রয়েছে- যা মেনে চলা সকল প্রচার মাধ্যমের জন্য জরুরী।
ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণীর প্রতি বিশেষ সহায়তা- মাদকাসক্ত ব্যক্তি, মানসিক রোগী, অভিবাসী, বেকার ও সাংস্কৃতিকভাবে শ্রেণীচ্যুতদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি, একারণে তাদের প্রতি বিশেষ সহায়তা কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন।
সামাজিক বন্ধন বৃদ্ধি- নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রভাবে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে মানুষ। পারিবারিক কাঠামো ভেঙ্গে সামাজিক বন্ধন ছোট হয়ে আসছে। পারিবারিক বন্ধন বাড়ানো, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, খেলা-ধুলার সুযোগ বৃদ্ধি সেই সাথে ধর্মাচার মেনে চলে আত্মহত্যার প্রবণতা কমানো যায়।
মানসিক রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা- গবেষণায় দেখা যায় আত্মহত্যাকালীন সময়ে ৯৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে মানসিক অসুস্থতা বিরাজ করে। বিষণ্ণতা, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়া সহ নানাবিধ মানসিক রোগের দ্রুত শনাক্তকরণ ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারলে বহু আত্মহত্যা কমানো যাবে। মানসিক রোগের অপচিকিৎসা বন্ধেও পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
নারীর ক্ষমতায়ন- আমাদের দেশে যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন এমন কি উত্যক্তকরণের ফলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এই সমস্ত কারণগুলো দূর করার জন্য প্রয়োজন নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর প্রতি নারী-পুরুষ সকলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না করাও আত্মহত্যা প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
বিশেষ পরামর্শ সেবা- যারা আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন (ছাত্রী, নববিবাহিতা বা বিবাহযোগ্য বয়সের তরুণী, দরিদ্র জনগোষ্ঠি, মাদকসেবী, মানসিক রোগী, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার যারা) তাদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা এলাকা ভিত্তিক বিশেষ পরামর্শ সেবা প্রাপ্তির সুযোগ থাকতে হবে। যেখানে আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক বা কাউন্সিলরগণ সকলকে সাধারণ ভাবে আত্মহত্যা প্রতিরোধের বিষয়াদি সম্পর্কে পরামর্শ দেবেন, পাশাপাশি কারো মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা বা ইচ্ছা দেখা দিলে তা রোধ করার উদ্যোগ নেবেন।
সার্বক্ষণিক টেলিফোন সহায়তা- জাতীয় পর্যায়ে সার্বক্ষণিক টেলিফোন সাহায্য পাবার সুযোগ থাকতে হবে। কারো মধ্যে আত্মহত্যা করার ইচ্ছা জন্মালে বা জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটলে সে যেন এই বিশেষ নম্বরগুলোতে ফোন করে সুপরামর্শ পায়। এই টেলিফোনগুলোর সাহায্যকারী প্রান্তে সবসময় থাকবেন ‘মনোচিকিৎসক-কাউন্সিলর’।

‘মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট-আইনজীবী-পুলিশ-সমাজকর্মী’ সমন্ময়ে গঠিত একটি টিম যারা সাহায্য প্রার্থনাকারী ব্যক্তিকে দ্রুততর সময়ের মধ্যে টেলিফোনে বা সরাসরি উপস্থিত হয়ে আত্মহত্যার পথ থেকে ফেরাবেন ও মানসিক বিপর্যয়ের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দিবেন। প্রয়োজনে আইনী সহায়তাও দিবেন। পশ্চিমা দেশগুলোতে এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে এধরনের টেলিফোন সার্ভিস চালু আছে। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে কার্যকরী এক পদ্ধতি শুরু করা যেত পারে।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleপ্যারেনটিং স্টাইলের সাথে সন্তানের আত্মহত্যার সম্পর্ক
Next articleআত্মহত্যার কারণ সমূহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here