আত্মহত্যার কারণ সমূহ

ঠিক কোন কোন কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে তা সঠিকভাবে খুঁজে বের করা বেশ কঠিন। কারণ তখন ব্যক্তির কাছ থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করার আর কোনো উপায় থাকে না। সাধারণত দুই ধরনের গবেষণার মাধ্যমে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা যায়। যথা- Prospective Studies এবং Epidemiological Studies. Prospective Studies কে মানসিক ময়নাতদন্তও বলা হয়। এর মাধ্যমে কোন কোন বিষয়গুলো একজন মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা জানা যায়। আর Epidemiological Studies এর মাধ্যমে সামাজিক ও ডেমোগ্রাফিক কারণগুলো পাওয়া যায়।

ব্যক্তিগত কারণ
দীর্ঘদিন অসহনীয় শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা বা কষ্টের কারণে মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। দীর্ঘদিন এই অসহনীয় যন্ত্রণা একসময় তারা আর সইতে না পেরে আত্মহত্যা করতে পারে। একই সাথে যদি অনেকগুলো সমস্যা এসে হাজির হয় এবং তখন ব্যক্তি সবগুলো সমস্যার সম্মিলিত চাপ যদি নিতে না পারে, তখন ব্যক্তি আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে।

যেসব মানুষের মাঝে এই প্রবণতা থাকে যে, অন্যরা ব্যক্তির সকল সমস্যার কারণ, অন্যরা তার ক্ষতি করবে অর্থাৎ যাদের প্রত্যক্ষণে Hostility Biases থাকে তাদের আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়, তারা কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেনা, ফলে তাদের সামাজিক সাপোর্ট খুবই কমে যায়, তাদের কোনো ভালো বন্ধু থাকে না, তখন তাদের কাছে খুব ছোট-খাটো বিপদ আপদ  খুব বড় মনে হয়।

ব্যক্তি জীবনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে গ্যাপ বা দুরত্ব ব্যক্তির মাঝে হতাশার জন্ম দিতে পারে এবং তখন মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। কতটুকু প্রত্যাশা করা যাবে আর কতটুকু করা যাবে না এই বিষয়ে যদি ব্যক্তির সচেতনতার অভাব থাকে তবে তাদের হতাশা ততো বেশি হবে। কেউ যদি অন্যের কাছ থেকে আদর, ভালোবাসা, স্নেহ, শ্রদ্ধা ইত্যাদির প্রাপ্তির জন্য অতিরিক্ত প্রত্যাশা থাকে তবে তারা বেশ ঝুঁকিতে আছে বলা যায়।

যেসব ব্যক্তি মাদকদ্রব্য গহণ করে বা বিভিন্ন ধরনের ড্রাগ নেয় তাদের আত্মহত্যার ঝুঁকি সাধারণ মানুষের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি। আাবার যারা ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য গহণ করে তাদের আত্মহত্যার ঝুঁকি সাধারণ একজন মানুষের তুলনায় প্রায় ১৪ গুণ। কারণ এসব ব্যক্তি এমনিতেই মাদকদ্রব্য গ্রহণজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগতে থাকে এবং এর সাথে তাদের ব্যক্তিগত ও সমাজিক নানা সমস্যা দেখা দিলে তারা আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা।

ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন ধরণের মানসিক রোগের উপস্থিতি ব্যক্তির আত্মহত্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ১৯৭৪ সালে Barraclough তার একটি গবেষণায় দেখতে পান যারা আত্মহত্যা করে তারা কিছু মানসিক সমস্যায় ভোগে। এছাড়া বিভিন্ন দেশে পরিচালিত গবেষণা উপরোক্ত গবেষণার ফলাফলকে সমর্থন করে। যদিও কিছু গবেষণায় গ্রাম এলাকার মানুষের ক্ষেত্রে মানসিক রোগের সাথে আত্মহত্যার তেমন কোন শক্ত সহ-সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি (Phillips, 2010)। সাধারণত যেসব মানসিক রোগের সাথে আত্মহত্যার গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখা গেছে সেগুলো হলঃ

পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার – ৫০%
মুড ডিজঅর্ডার – ৬%
স্ক্রিজোফ্রেনিয়া – ৫%
মাদকদ্রব্য গ্রহণ – ৭%

এছাড়া PTSD, Anxiety Disorders, Anorexia Nervosa ইত্যাদির সাথে আত্নহত্যার সম্পর্ক রয়েছে।

বংশগতি বা জেনেটিক ফ্যাক্টর
শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিষয়গুলো আত্মহত্যা বিষয়টিকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে না। আত্মহত্যার সাথে বংশগতির কোন সম্পর্ক আছে কিনা তা জানার জন্য বিজ্ঞানীরা পরিবার, অভিন্ন জমজ ও পোষ্যপুত্রদের নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন যে, আত্মহত্যার সাথে বংশগতির গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন 5-HT পাথওয়েতে কার্যক্রম কমে গেলে মানুষ আত্মহত্যামূলক বিভিন্ন আচরণ করে। যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের পোষ্টমর্টাম এ দেখা গেছে যে উক্ত পাথওয়েতে কার্যক্রম কমে গিয়েছিল।

এছাড়া মানুষের লিম্বিক সিস্টেম (limbic system) তাদের আবেগীয় বিভিন্ন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে এবং আমাদের কর্টেক্স (cortex) বিভিন্ন লজিক্যাল বা যুক্তিপূর্ণ বিষয় নিয়ে কাজ করে। যখন মানুষ কোনো বিরূপ বা কঠিন পরিস্থিতির স্বীকার হয় তখন যদি তারা আবেগীয়ভাবে উত্তেজিত হয়ে যায় তবে তখন মানুষের লিম্বিক সিস্টেমে রক্তচলাচল বেড়ে যায় বা লিম্বিক সিস্টেম একটিভ হয়ে যায় এবং তখন কর্টেক্স লজিক্যালি চিন্তা করতে পারেনা। তখন তাদের আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

সামাজিক কারণ
আত্মহত্যার জন্য সামাজিক বিভিন্ন ফ্যাক্টর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক কারণগুলোর উপর এমিল ডুরখেইম একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ দিয়েছেন। ডুরখেইম চার ধরনের আত্মহত্যার কথা বলেছেন। এগুলো মূলত দুটি সামাজিক বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়। যথা- সামাজিক অন্তর্ভুক্তি (social integration) এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ (Social Responsibility)। এই দুটি উপাদানের আধিক্য এবং অভাব দুটির কারণেই মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। সামাজের সাথে মানুষ যখন বেশি সংযুক্তি অনুভব করে তখন মানুষ দেশের জন্য প্রাণ দেয়, কোন জাতি বা গোষ্ঠীর জন্য জীবন দেয়। যেমন আমরা দেখি সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে প্রতিদিন মানুষ আত্নঘাতি বোমা হামলা করছে এবং আত্মহত্যা করছে। এটাকে বলে কোনো কিছুকে ভালোবেসে আত্মহত্যা করা (Altruistic suicide)। আবার মানুষ যখন সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বা সমাজের সাথে সংযুক্তি কম অনুভব করে তখন হতাশায় ভোগে, বিষন্নতায় পড়ে যায়, সমাজের সাথে বা কমিউনিটির সাথে একটা গ্যাপ তৈরি হয়, সামাজিক বন্ধন কমে যায় তখন মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। এসময় মানুষ জীবনকে অর্থহীন মনে করে, পিতৃত্বের ধরণ যদি অতিরিক্ত রক্ষণশীল ধরনের হয় তবে সন্তানের সামাজিক বন্ধন বা সামাজিক সম্পর্ক সুন্দর ভাবে গড়ে উঠতে পারে না। এর ফলে টিন এজ ছেলে মেয়েরা একাকিত্ব অনুভব করতে পারে, বিষন্নতায় ভুগতে পারে। এভাবে ধীরে ধীরে মানুষ পরিবার, সমাজ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে যা তাদের ভিতর আত্মহত্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। এধরনের আত্মহত্যাকে বলা হয় Egoistic suicide। যেমন ডুরখেইম দেখেছিলেন যে বিবাহিতদের তুলনায় অবিবাহিতদের ভিতর আত্মহত্যার হার বেশি, কারণ অবিবাহিতদের তুলনায় বিবাহিতদের সামাজিক বন্ধন বেশি থাকে। ডুরখেইম আরো দেখেছিলেন যে যেসব মহিলাদের বা মানুষের সন্তান হয়না তারা বেশি আত্মহত্যা করে।

আবার পরিবার,সমাজ বা রাষ্ট্র যদি অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে তখন ব্যক্তি আত্মহত্যা করতে পারে। অতিরিক্ত কঠোর নিয়ম-কানুন মানার চেয়ে বরং ব্যক্তি মৃত্যুকে বেছে নেয়। এধরনের আত্মহত্যার উদাহরণ হিসেবে জেল-হাজতে কয়েদিদের আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করা যায়। জেলখানার অতিরিক্ত নিয়ম-কানুনের কারণে জীবন তার কাছে অর্থহীন হয় এবং এই জীবন বয়ে বেড়ানোর চেয়ে আত্মহত্যাই তাদের কাছে বেশি ভালো মনে হয়। এধরনের আত্মহত্যাকে Fatalistic suicide বলা হয়।

একইভাবে নিয়ন্ত্রণ যদি অতিরিক্ত ঢিলে হয়ে যায় তখনও মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। একটি সমাজ যখন খুব দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে বা সমাজে যদি কোন সংকট চলতে থাকে থাকে, তখন সমাজে বিদ্যমান নিয়ম-কানুন বা নিয়ন্ত্রন হারিয়ে যায়। সামাজিক রীতি-আদর্শ হারিয়ে যেতে থাকে, সামাজিক আচরণের কোনো সুনির্দিষ্ট গাইড লাইন থাকেনা, তখন মানুষের মধ্যে নানা ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়, মানুষের জীবনের লক্ষ্য হারিয়ে যেতে থাকে, মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হতে পারে। এটা মূলত যেসব পিতা মাতা Neglecting Parenting Style অনুসরণ করে তাদের সন্তানের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। এ ধরনের আত্মহত্যাকে Anomic suicide বলা হয়।

সামাজিক অন্যান্য ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে আছে পরিবারে আত্নহত্যার ইতিহাস থাকা, বন্ধু-বান্ধবদের কটু কথার স্বীকার হওয়া, বাবা মা বা পরিবারের অন্যান্য মানুষের দ্বারা ক্রমাগত কটুকথা শুনতে থাকা,  কৃষ্টিগত বিশ্বাস, লিঙ্গগত বৈষম্য, পরিবারের আর্থিক অবস্থা, আধুনিক জীবনের চাপ, বিবাহিত জীবনের ঝগড়া বিবাদ, বিচ্ছেদ, চাকরী চলে যাওয়া, অর্থনৈতীক ধস, শিক্ষা, অ্যাবিউজ, প্রিয় কোন মানুষের মৃত্যু ইত্যাদি।

মানসিক কারণ
আত্মহত্যার জন্য মানসিক কারণগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আশাহীনতা। এছাড়া সারাক্ষণ নেগেটিভ চিন্তা করাও গুরুত্বপূর্ণ। যারা সর্বদা নেতিবাচক চিন্তা করতে থাকে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে। তাছাড়া যারা এক বা একাধিক বার প্রচেষ্টা করেও সফল হতে পারেনা তাদের পিতা মাতা, পরিবার বেশির ভাগ সময় তাদের বিভিন্ন অন্যায় আবদার মেনে নেয়, ফলে তারা তাদের অবিভাবকদের ভয় ভীতি দেখানোর জন্য আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালায়। অনেকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অপরাধবোধে ভোগে এবং আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। আবার অনেকে সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতার অভাবে কি করবে বুঝতে না পেরে আত্মহত্যা করে বসে।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleস্বেচ্ছামৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব
Next articleভয়, লজ্জা, সংকোচে আপনি যখন অসহায় বোধ করছেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here