‘ADHD কারো একার পক্ষে সারিয়ে ফেলা সম্ভব নয়’- অধ্যাপক ডা. গোলাম রব্বানী

0
39
অধ্যাপক ডা. গোলাম রব্বানী

মনের খবরঃ আমরা জানি ADHD একটি রোগ। এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা নিতে গেলে স্পেশাল ট্রিটমেন্ট এর প্রয়োজন পড়ে। এখানে স্পেশাল ট্রিটমেন্ট বিষয়টা আসলে কী?

অধ্যাপক ডা. গোলাম রব্বানীঃ ADHD একটি মেন্টাল হেলথের ক্লাসিফিকেশন। আমরা মূলত সারা পৃথিবীতে দু’ধনের ক্লাসিফিকেশন দেখে থাকি। আইসিডি (ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন ডেথ এন্ড ডিজিসেস) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আরেকটা ক্লাসিফিকেশন আছে যেটা নর্থ আমেরিকা ফলো করে সেটা হলো ডিএসএম( ডায়াগনস্টিক এন্ড ষ্ট্যাটেটিকাল ম্যানুয়াল)। এটা বর্তমানে পঞ্চম এডিশন চলছে। এই পঞ্চম এডিশন ২০১৩ থেকে অর্থাৎ আইসিডির আগে থেকেই কাজ করছে। ADHD শব্দের অর্থ হচ্ছে এটেনশন ডেফিসেন্সি হাইপারএক্টিভ ডিজঅর্ডার। এটিকে নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডারের মধ্যে রেখেছি। কারণ সাধারণত মানুষ যখন ফিজিক্যালি, সাইকোলিজিক্যালি ডেভেলপ করে অর্থাৎ জন্মের পর শিশুকালেই এটি দেখা যায়। শুধু তাই নয় কিশোর বয়সেই এই সমস্যা দেখা যায়। এছাড়াও কোমরবিড হিসেবে চাইল্ড দেভেলপ এর সাথে জড়িত থাকে। যেমন অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার, ইন্টেলেকচুয়াল ডিজেবিলিটিসহ আরো অনেক নিউরোডেভেলপমেন্টাল সমস্যার সাথে এটি সম্পৃক্ত।

আমার বাস্তব জীবনে আমি এমন একটি শিশুকে পেয়েছিলাম, যার সাইকিয়াট্রিক হিসেবে আমি কাজ করেছি। ছেলেটি ইন্টেলেকচুয়াল ডিজেবিলিটিতে ছিলো। পরবর্তীতে দেখা গেছে তার সঙ্গে টিউমারোক্লসিস ছিলো, যেটা অটিজম এর লক্ষণ। ছোট বেলা থেকেই তার ব্রেনের ভিতর টিউমার থাকায় এটেনশন এবং কনসেন্ট্রেশন দিতে পারতো না।

লারনিং এর জন্য আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়কে কাজে লাগাতে হয়। পঞ্চ ইন্দ্রিয় বলতে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক, জিহ্বা ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি আমাদের চারপাশে কি ঘটছে। এখানে যদি কেউ এটেনশন এবং কনসেন্ট্রেশন না দিতে পারে , তাহলে ক্লাসরুমে সে পিছিয়ে পড়বে। ADHD আক্রান্ত শিশুকে দেখলেই বোঝা যায় , সে একবার চেয়ারে বসছে, একবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, একবার বাথরুমের দিকে যাচ্ছে আবার শিক্ষক বা টেবিলে যা আছে তা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। অতিচঞ্চল বা সাইকোমটাল এক্টিভিটিস বা ফিজিক্যাল এক্টিভিটিস খুবই বেশী থাকে। যার ফলে এটেনশন এবং কন্সেন্ট্রেশন কিছুই দিতে পারে না।

এই জিনিসগুলো না হওয়ার ফলে সে কোন জিনিসই তার ব্রেনে পাঠাতে পারে না এবং এক্ষেত্রে যে প্র্যাক্টিস করতে হবে তাও সে মনে করতে পারছে না। তার মানসিক অবস্থা বন্ধ্যার মতো হয়ে যায়। ইমপালসিভ অর্থাৎ হুটহাট কিছু করে ফেলে, ভবিষ্যতে এর কি প্রভাব পড়তে পারে তা সম্বন্ধে তার কোন ধারণা থাকে না।

এই অবস্থায় ডাক্তারের সাথে আলোচনা করতে যায়। তখন সাধারণত প্রথমেই পেডিয়াট্রিক নিউরো লজিষ্ট এর কাছে পাঠায়। আগে তো নিউরো লজিষ্ট সেপাশালিষ্ট ছিলো না, হাতে গোনা কয়েক জন। চাইল্ড স্পেশালিষ্ট ছিলো। তারা তাদেরকে পরামর্শ দিতেন, খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখতে বলতেন। আসলে ADHD কে অনেকগুলো আঙ্গিকে আমাদের চিন্তা করতে হয়। নিউরোলজিক্যান এস্পেক্ট, বিহ্যাভিয়াল এস্পেক্ট এবং তার সাইকিয়াট্রিক আস্পেক্ট সবকিছুই। যার জন্য পেডিয়াট্রিক নিউরো লজিষ্টের সঙ্গে, পেডিয়াট্রশিন এর সঙ্গে আমাদের সাইকিয়াট্রইষ্ট বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিষ্ট, স্কুল সাইকোলজিষ্ট এবং ডেভেলপমেন্টাল সাইকোলজিষ্ট। সবগুলা ক্ষেত্র থেকেই আমাদের হেল্প নিতে হবে।

একজন মানুষকে শুধু তার আংকিক বা গাণিতিক মাধ্যমে নির্ণয় করতে পারবো না। এডাপ্টিভ বিহেভিয়ার লাগবে। অনেক বাচ্চাই আছে তার এডাপ্টিভ ডেফিসেন্স মাইল্ডিভ ফরম্যাটে আছে। সে এগুলাকে এডাপ্ট করতে পারে। আচার আচরন গুলোকে শুধরিয়ে নিতে পারে।

একজন বাচ্চার যদি এডিএইচডির সাথে এডিএসডি থাকে তাহলে তা আরো বেশী দুরুহ হতে পারে। কারণ অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে কমিউনিকেশন সমস্যা থাকেই। যেদিন থেকেই বাচ্চার এই অবস্থা ধরতে পারবেন সেদিন থেকেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে কিন্তু তাকে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

মনের খবরঃ সবাই কি এই ট্রিটমেন্ট করতে পারেন কিনা?/ যদি না পারেন তবে এক্ষেত্রে কারা পারে?

অধ্যাপক ডা. গোলাম রব্বানীঃ ADHD কিন্তু কারো একার পক্ষে সারিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। মূল যেই জায়গা গুলোতে আমরা চিকিৎসা করবো সেগুলোকে আইডেন্টিফাই করতে আমাদের সবাইকে নিয়েই এগিয়ে আসতে হবে। আইডেন্টিফাই করে পেডিয়াট্রিক নিউরো লজিষ্ট, পেডিয়াট্রশিন, সাইকিয়াট্রিষ্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিশট, স্কুল সাইকোলজিষ্ট এবং ডেভেলপমেন্টাল সাইকোলজিষ্ট – সবাইকে যার যার জায়গায় ডায়াগনোসিস করতে হবে। কেউ একক ভাবে এটা সাইয়ে ফেলতে পারবেন না। সমষ্টিগত চিকিৎসার মাধ্যমেই এগিয়ে যেতে হবে।

মনের খবরঃ এই ধরণের ট্রিটমেন্ট করতে এক্সপারটিজ/ট্রেনিং লাগে কিনা?

অধ্যাপক ডা. গোলাম রব্বানীঃ আমাদের একটি ADHD গ্রুপ আছে। ইন্টারন্যশনাল এডিএইচডি গ্রুপ। জার্মানির বার্লিনে ২০১৬ সালে এর কংগ্রেসে আমি যোগ দিয়েছিলাম। ADHD ট্রিটমেন্ট করার জন্য বাইরে ADHD স্পেশালিষ্ট আছে। তারা দলগত ভাবে কাজ করে। মানে একজন নেতৃত্ব দেয় এবং তাকে আরো কয়েকজন সহায়তা করেন। যেমনঃ সাইকিয়াট্রিষ্ট, নিকাল সাইকোলজিষ্ট, থেরাপিষ্ট, বিহেভিয়াল সাইকোলজিষ্ট এরা প্রত্যকেই এই ADHD তে সংযুক্ত থাকেন। মানে সেপাশালিষ্ট গ্রুপ এক্টিভ করে এর চিকিৎসা করা সম্ভব।

মনের খবরঃ সরকারী/বেসরকারী মেডিকেলসহ বাংলাদেশের কোথায় কোথায় এই ট্রিটমেন্ট পাওয়া সম্ভব?

অধ্যাপক ডা. গোলাম রব্বানীঃ নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেকটি পাবলিক এবং প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে সাইকিয়াট্রিষ্ট থাকার কথা। আপনারা জেনে খুশি হবেন সামনের কারিকুলামে আমাদের সাইকিয়াট্রিষ্টদের পুরো একটি বোর্ড দেওয়া হয়েছে। অন্য সব বিষয়ের মতো। এর মানে আমাদের সেবাদানের যে জায়গাটা বা যে অধিকার তা প্রস্তুত হয়ে গেলো। উচিৎ হচ্ছে প্রত্যেকটা মেডিকেল কলেজে এই ADHD চিকিৎসার ট্রিটমেন্ট থাকা উচিৎ। সত্যি বলতে কোন সাইকিয়াট্রিষ্ট এ ধরণের কেস পেলে সাদরে তা গ্রহন করতে ইচ্ছুক। সেই অরথে বাংলাদেশে যতগুলা মেডিকেল কলেজ আছে সবখানেই এর চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব।

এর সঙ্গে যত পেডিয়াট্রিক হাসপাতাল বা ইনস্টিটিউট আছে তারাও এর চিকিৎসা দিতে পারে। ৩৪ টা চাইল্ড ডেভেলপ সেন্টার আছে যেখানে এর চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশে এর সংখ্যা আরো বাড়ছে।

৫৬৫ জন যে আমাদের সাকোলজিষ্ট, সাইকিয়াট্রিষ্ট আছে , সোশ্যাল ওয়ার্কার আছে তারা সবাই প্রস্তুত আছে ADHD চিকিৎসার জন্য। এছাড়াও ৮ টা ক্যান্টনমেন্টে প্রয়াস চাহে, আরো কিছু প্রাইভেট ইন্সটিটিউট আছে যারা প্রস্তুত।

মনের খবরঃ ADHD ব্যাপারে সাধারণ মানুষের জন্য যদি কোন বার্তা/ কিছু বলতে চান ?

অধ্যাপক ডা. গোলাম রব্বানীঃ সাধারণ এবং সব মানুষদের আমরা এই বার্তায় দিবো যে, জন্মলাভের পর থেকে প্রতিটি মুহূর্তই একটি শিশুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই ক্ষেত্রে পিতা-মাতা এবং অভিভাবক( দাদী,নানী , ফুফু, ভাই ,বোনইত্যাদি) প্রত্যেকেই সার্বক্ষণিক নজর রাখবেন। যদি কেউ এমন কোন আচরণ দেখেন যেখানে অতিরিক্ত চঞ্চলতা যা তার বয়সের অন্য বাচ্চাদের মতো নয়। তাৎক্ষনিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন, বিশেষ করে চাইল্ড রিলেটেড যে ডাক্তার আছে যদি তা না সম্ভব হয় তবে নিউরো লজিষ্ট এর কাছে , অথবা সাইকোলজিষ্টের স্মরণাপন্ন হবেন। কাছাকাছি চাইল্ড ডেভেলপ সেন্টার বা মেডিকেল কলেজ আছে সেখানে নিয়ে যেতে হবে।

৯-১২ মাস বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে তারা উড়োজাহাজ দেখলে আঙ্গুল দিয়ে তা ইংগিত করে কিনা, আলতো উচ্চারণ করতে পারছে কিনা, কোন জিনিস চাইলে তা হাত দিয়ে সংকেত দিচ্ছে কিনা। তা খেয়াল করুন। যদি এর ব্যক্তয় ঘটে, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এটিই হলো আমাদের সবচেয়ে বড় আবেদন। আমি সবার কাছে অনুরোধ রাখবো যে আপনার শিশুকে অবহেলা করবেন না। শিশু বলেই সে এমন আচরণ করবে, কয়দিন পরেই ঠিক হয়ে যাবে। এসব ধারণা থেকে বের হয়ে এসে, শিশুর সঠিক যত্ন নিন।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন- শরীফুল সাগর

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪

 

 

 

Previous article‘স্পোর্টস সাইকোলজি’ বিস্তারিত; মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনের ফেব্রুয়ারী সংখ্যায়
Next articleমানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে হরর সিনেমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here