শিল্পীসত্তাটাকে বাঁচাতেই নেশা ছেড়ে ফিরে আসা-ব্যান্ডশিল্পী মাকসুদ

0
69

মাকসদুলু হক। মাকসুদ নামে বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতে তমুলু জনপ্রিয় তারকাশিল্পী। আপাত চোখে ভাবকু আর বাউলিয়ানার সংমিশ্রণে ভিন্ন ধাচের মানুষ মনে হলেও ব্যক্তিজীবনে যিনি সমাজ ও মানুষ সচেতন। মনকে ভীষণ গুরুত্ব দেন তিনি। বিশ্বাস করেন মনই মানুষের আসল নিয়ন্ত্রক। অকপটে বলেছেন একসময়ের ব্যক্তিগত বেপোরোয়া জীবনের কিছু কথাও। নেশায় আসক্ত হয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসার গল্প। স্পষ্টভাষী এই শিল্পীর মুখোমুখি হয়েছিল সাদিকা রুমন। মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনের সংখ্যা-৬ প্রকাশিত তার সেই বিশেষ সাক্ষাৎকারটি তারকার মন বিভাগের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল

মনের খবর: গান কি মানষুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে?
মাকসুদুল হক: অবশ্যই গান মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিছু শব্দ দ্বারা গান মানুেষর মস্তিষ্কে এমনভাবে গাঁথতে পারে যেটা অন্য কোনো মাধ্যমে সম্ভব না। একজন গীতিকার বা একজন সংগীতশিল্পী কিন্তু পাঁচ মিনিটের ভেতর একটি উপন্যাস মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। মানুষ তো বেঁচে আছেই শুধু শব্দে। আমাদের অস্তিত্বটাই শব্দ। শব্দ ছাড়া একটা পৃথিবী অকল্পনীয়। যেখানে শব্দ নেই সেখানে মানুষ টিকে থাকতে পারে না। মানুষ মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে-সেখানে শব্দ না থাকলে, পরস্পরের সাথে কথা না বললে তার অস্তিত্বই নড়বড়ে। সেখানে গান খবুই বিস্তৃত উৎস। অবশ্যই গান মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে।

মনের খবর: তার মানে কি গান মানুেষর জীবনদর্শনকেও নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত করতে পারে?
মাকসুদুল হক: অবশ্যই করে। যাঁরা গান করেন যাঁদের গান শুনে আমরা বড় হয়েছি তাঁরা অবশ্যই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তাঁদের চিন্তাচেতনা আমাদের চিন্তাচেতনাকে প্রভাবিত করেছে, জীবন-জীবিকায় পরিবর্তন এনেছে। যেমন : আমি বব মার্লের গান, জীবনদর্শন দ্বারা প্রভাবিত। আবার লালন আমাদের জীবনদর্শনকে প্রভাবিত করে।

মনের খবর: গানহীন আপনি কেমন হতে পারতেন?
মাকসুদুল হক: শৈশব থেকে তো গানের সাথেই বেড়ে উঠেছি। আসলে গানহীন আমাকে ভাবতেই পারি না।

মনের খবর: আপনি একসময় মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন, এর শুরুটা কীভাবে ঘটেছিল?
মাকসুদুল হক: ‘মাদকাসক্তি’ কথাটা আমি ব্যবহার করতে নারাজ। আমি বলতে চাই ‘মাদকের অপব্যবহার’। কারণ সমস্যাটা মাদকে নয়, আমাদের মধ্যে। আমরাই খারাপ। মানুষের খারাপের জন্য মাদকের আবিষ্কার হয়নি। আমরাই তার অপব্যবহার করেছি। আমার শুরুটা ছিল গঞ্জিকা দিয়ে। আমি কখনো হার্ড ড্রাগস নিইনি। বন্ধু-বান্ধবদের সাথেই শুরুটা ছিল। তারপর একটা সময় মাত্রা বেড়ে যায়। এত চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় যে আমার শরীর আর নিতে পারে না। সেখান থেকে ফিরে আসাটা কীভাবে? আমি মানসিকভাবে একটা সময় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। আমাদের দেশে যে গঞ্জিকা পাওয়া যায় সেটা তো ভালো না। একবার আমার গঞ্জিকার সাথে ধুতুরা মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল। ধুতুুরা একটা হাতিকেও পাগল করে ফেলতে পারে। সে-সময়ই আমি প্রথম রিহ্যাবে যাই। সেই সময় যদি আমি ফিরে না আসতাম তাহলে আমাকে পাগলা গারদে যেতে হতো। সারাজীবন পাগলাগারদে কাটাতে হতো। কারণ ফিরে না এলে আমার ব্রেইনটা নষ্ট হয়ে যেত। ধরুন, আপনার সিটামল খাওয়ার কথা দিনে ‍দুইটা বা চারটা আপনি যদি একশটা খান তাহলে কী হবে? আপনার ব্রেইনের ফাংশন ফেইল করবে। ব্রেইন যদি ফল করে তাহলে তো আপনাকে বিকলাঙ্গ হয়ে বা পাগল হয়ে বাকিটা জীবন পাগলদের সাথে কাটাতে হবে। সেই পর্যায়ে চলে যাওয়ার আগে আমার নিজেকে শুধরে নেয়ার উপলব্ধি হয়।

মনের খবর: এই উপলব্ধির পেছনে কি আপনার শিল্পীসত্তা ভূমিকা রেখেছিল?
মাকসুদুল হক: অবশ্যই। অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিল। আমি তো সৃষ্টি করি। কথায় বলে যে, আল্লাহ যাকে ঘৃণা করেন তার মস্তিষ্ক ধ্বংস করে দেন। আমার মনে হতে থাকে, আমি তো আল্লাহর সাথে এমন কোনো প্রতারণা করিনি যে তিনি আমার মস্তিষ্ক ধ্বংস করে দেবেন! আমি সৃষ্টি করতে পারি, অবলীলায় মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারি। অনেকে সারাজীবন সাধনা করেও মানুষের কাছে যেতে পারে না। আমি সেটা পেরেছি-এটা তো কম পাওয়া না। একটা মানুষের জীবনে এটা বিশাল বড় পাওয়া। আমার শিল্পীসত্তাটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই মূলত ফিরে আসা। যখন আমি ফিরে আসি তখন বোধ করি যে কোথায় ছিলাম আর কোথায় এলাম-সবকিছু নতুন লাগে।

মনের খবর: তার মানে মানুষ চাইলে ফিরে আসতে পারে?
মাকসুদুল হক: অবশ্যই। এই সময় কিন্তু মানুষ কারো কথা শোনে না। যখন কেউ খুব বেশিমাত্রায় ব্যবহার করে বা এমন পর্যায়ে চলে যায় যখন আর কোনো কিছইু করার নাই তখন সে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনে আর থাকে না। আস্তে আস্তে তার মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যায়। আমি রিহ্যাবে এমনও দেখেছি যে ১০/১৫ বছর ধরে আছে। এরপর একটা সময় তাদেরকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেয়া হয়। চূড়ান্ত উন্মাদদেরকেও দেখেছি সেখানে। ওদেরকে দেখেও আমার শিক্ষা হয়েছে যে আমি যদি ফিরে না আসি তাহলে আমারও এই পরিণতি হবে, আমিও এই পথে চলে যাব।

মনের খবর: যারা ফিরে আসতে চায় তাদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ দেবার আছে?
মাকসুদুল হক: আমি উপদেশ দেয়ার মানুষ না। তাদেরকে এটকুইু বলতে পারি যে, কোনো মাদকই খারাপ না; এর অপব্যবহারটা খারাপ। যদি কেউ মাদক নেয় আমি যতই তাকে বলি-ছেড়ে দাও। সেটা সম্ভব না। একজন মাদকাসক্ত লোক কখনো বলতে পারে না যে তার শতভাগ নিরাময় ঘটেছে। আমিও বলতে পারি না। যেকোনো সময় আমি আবার আসক্ত হয়ে পড়তে পারি। এক্ষেত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণটা সবচেয়ে জরুরি। এই যে বুক ভরে বাতাস নিচ্ছি, মানুষের সাথে কথা বলছি এটা আমি হারিয়ে ফেলব। আমার কাছে সবচেয়ে যেটা কাঙ্খিত সেটা হলো-উজ্জ্বল বাতাস, উজ্জ্বল আলো। নিজেকে হারিয়ে ফেললে এই বাতাসটা ভারী হয়ে যায়। এই বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে হবে। যারা দুর্বলচিত্তের তারা কিন্তু সহজে ফিরে আসতে পারে না। তারা হাজাররকম অজহুাত দেখাবে। বিশেষত যারা কেমিক্যাল ড্রাগস নেয় তারা কখনো সত্যিটা বলে না। এক্ষেত্রে তাই নিজের ইচ্ছাশক্তিটাই সবচেয়ে বড়।

মনের খবর: সামাজিক প্রেক্ষিত থেকে আমাদের কী করণীয় এক্ষেত্রে?
মাকসুদুল হক: একটা দেশে তো দ্বৈত আইন চলতে পারে না। একদিকে ঢাকা ক্লাবে, বারে কিছু লোককে লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে মদ খাওয়ার। অ্যালকোহলের মতো ড্রাগ তো নেই। হেরোইন, মারিজুয়ানা, ইয়াবার থেকে বেশি বিপদজনক অ্যালকোহল। কিন্তু সেটা আমরা সামাজিকভাবে ধুমধাম খাচ্ছি। কবি, সাহিত্যিক সবাই মিলে একসাথে বসে খাই-সামাজিকভাবে এটা গ্রহণযোগ্য। একটা ছেলে ড্রাগস নেয় এটা শুনলে আমরা নিতে পারি না; কিন্তু মাঝে মাঝে মদটদ খায় বা ড্রিংকস করে-এটা যেন কোনো কিছু না। এই দ্বৈতসত্তাকে আমি মানতে পারি না। আমাদের দেশে একটি থামাতে আরেকটি লিগালাইজ করতে হয়। বিয়ার লিগালাইজড না করে আপনাকে আরো খারাপ জিনিস এনার্জি ড্রিংক দেয়া হচ্ছে। বাচ্চাদেরকে পর্যন্ত বাবা-মা এনার্জি ড্রিংক দিচ্ছে। শুধু তো ‘মাদক মাদক’ বললে হবে না, ‘মাদক’ কী সেটা বুঝতে হবে। হোয়াট ইজ ফুড অ্যান্ড হোয়াট ইজ ড্রাগ সেটা বুঝতে হবে। ফুড-এ যে কতটা ড্রাগ আছে সেটাতো আমরা পরিমাপ করছি না। কলা থেকে শুরু করে আনারস, পেয়ারা কোনটাতে ড্রাগ নেই! অথচ এগুলোকে আপনি লিগালাইজড করছেন! কিন্তু বার, বিয়ার এগুলোকে করছেন না। সামাজিকভাবে নেশা নিয়ে যারা বড় বড় কথা বলে সন্ধ্যাবেলায় তারা সোনারগাঁতে হুইস্কি নিয়ে বসে। কী কারণে আমাদের দেশে হেরোইন আসলো! ’৮৮ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে যে-কোনো জায়গায় গাজাঁ পাওয়া যেত। এলিফ্যান্ট রোড বাটা সিগনালের উল্টো দিকে ছিল সরকার অনুেমাদিত গাঁজা বিক্রয়কেন্দ্র। আমি নিজে গিয়ে কিনেছি। আমাদের মধ্যে কিন্তু আসক্তি ছিল না। ’৮৮ তে এরশাদ সাহেব আমেরিকার কথায় হেরোইনটা ঢোকানোর জন্য গাজাঁটা ব্যান করেন। আমাদের দেশে গঞ্জিকা আর ইয়াবাকে ক্যাটাগরির দিক থেকে একই অবস্থানে রাখা হয়েছে! এসবের সাথে রাজনীতি জড়িত। গঞ্জিকার উপকারিতা বা ঔষধ হিসেবে এর ব্যবহার আমরা জানছি না। ক্যান্সারের প্রাথমিক চিকিৎসা, চোখের গ্লুকোমা, হাপাঁনিসহ প্রায় বিশটা থেকে পঁচিশটা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। গঞ্জিকা থেকে ক্যান্সার নিরাময়ের ড্রাগ উৎপাদনের সম্ভাবনা খুব বেশি থাকার কারণেই তারা সারা বিশ্বে এটাকে ব্যান করার উদ্যোগ নেয়। আমেরিকা থেকে মেডিসিন্যাল মারিজুয়ানা যেটা দেয়া হয় সেটা কিন্তু বিভিন্ন রোগের জন্য আলাদা করে দেয়া হয়-ক্যান্সারের কেমোথেরাপি দেয়ার জন্য একধরনের মারিজুয়ানা, আবার হাঁপানির জন্য আরেক ধরনের। কাজেই আমি বিক্ষিপ্তভাবে বলতে পারি না এটা ভালো, ওটা খারাপ। আসলে সংকটটা সৃষ্টি হয় মাদকের অপব্যবহারে। গত কয়েক মাসে আমাদের দেশে ইয়াবার প্রকোপ প্রবলভাবে বেড়েছে। এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে গত ছয়/সাত মাসে রোহিঙ্গা ক্রাইসিসে। আপনি কল্পনা করতে পারবেন না যে আমাদের দেশে মায়ানমার থেকে কী পরিমাণ ইয়াবা আসছে। এই কেমিক্যালসগুলো আসে দেশের সম্ভাবনা ধ্বংস করার জন্য। ইট’স অ্যা বিগ পলিটিক্স। শুধু মাদকাসক্তির কথা বলে বড় বড় সেমিনার করে লাভ নেই। আমাদেরকে জানতে হবে। ‘মাদকাসক্ত’ বলে মাদক ব্যবহারকারীকে একরকমের ক্রিমিনালাইজড করে ফেলা হচ্ছে। এভাবে তো উত্তরণ সম্ভব না! এক কোটি মানুষ ইয়াবা খাচ্ছে বলে তো আপনি এক কোটি মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারবেন না। আপনি তো এক কোটি মানুেষর রিহ্যাবের ব্যবস্থা করতে পারবেন না! এর অস্তিত্বকে স্বীকার করতে হবে। শুধু নেগেটিভ ভিউ থেকে মল্যূায়ন করে লাভ নেই। মাদকের ভালো দিক আছে এটা আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। তারপরই আপনি এর অপব্যবহারকে প্রতিহত করতে পারবেন।

Previous articleচিকিৎসা শাস্ত্রে ভাষাবিজ্ঞানের ব্যবহার
Next articleপ্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করলেন অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here