মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে শরীরে ও মনে

0
45

রাত প্রায় ১০টা সাকিবের অপেক্ষায় বাসার সবাই, মানে হামিদ সাহেব সাকিবের বাবা, সাকিবের মা ও সাকিবের বড়ো বোন যিনি সাকিবের থেকে ৫ বছরের বড়ো। সাকিব ক্লাস নাইনে পড়ে। ইদানীং সাকিব বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকে। বাসায় দেরি করে ঢোকে, কোথায় ছিল জিজ্ঞাসা করলে, খুব বিরক্তি প্রকাশ করে, মেজাজ যেন চড়া, রাত জাগছে, এত রাত জেগে সিনেমা দেখে, গেম খেলে, উঠে দুপুর ২টার পর, সকালের নাস্তাা খাচ্ছে না, শরীর শুকিয়ে গেছে আগের থেকে, সাকিবের মা সন্দেহ করছেন নেশাতে জড়িয়ে পড়েনি তো সাকিব?

কিন্তু সাকিবের বাবা বললেন অনেক দিন তো করোনার জন্য বাইরে যায়নি; যাক না। কিন্তু কয়েকদিন থেকেই বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৮টা-৯টা বেজে যাচ্ছে। আজকে রাত ১০টা, এখনো সাকিব ফেরেনি তার মোবাইলে ফোন দিয়ে সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না এমন কথা আসছে। এমনিতে রাত ১০টায় সবাই রাতের খাবার খেতে বসলেও আজকে কারো যেন খিদে লাগছে না। সাকিবের মা বললেন সাকিবের পরিচিত বন্ধুদের বাসায় ফোন দিয়ে খোঁজ নিতে। সাকিবের বাবা হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিলেন। শেষ পর্যন্ত কাছের পুলিশ স্টেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সাকিব ও তার সাথের কিছু ছেলেরা ছিনতাই করতে যেয়ে জনতার হাতে ধরা খেয়ে অনেক মারের শিকার হয়ে এখন থানার হাজতে বন্দী। অনেক টাকা দিয়ে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর সাকিবের বাবা হামিদ সাহেব জানতে পারেন সাকিব মাদকে আসক্ত। বাসা থেকে মাঝে মাঝে টাকা হারানো যেত সেটা যে সাকিব করতো তা পরিষ্কার হলো। সাকিবের বাবা অপেক্ষা না করে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে একটি মানসম্মত রিহ্যাবে সাকিবের সুস্থতার আশায় ভর্তি করলেন।

মাদক গ্রহণের ক্ষতিকর প্রভাব

স্বাস্থ্যের ওপর শারীরিক ও মানসিক প্রভাব

মাদক গ্রহণে শুধু মস্তিষ্কের ক্ষতি হয় না সাথে দীর্ঘদিন শারীরিক সমস্যাও হয়। ইয়াবা গ্রহণে হৃৎপিন্ডের উপর নেতিবাচক প্রভাবে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। সাথে লিভার, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে, কিডনির সমস্যা ও ফুসফুসের নানা রোগ হবার প্রবণতা বাড়ে, সাথে আছে যৌন অক্ষমতার প্রবণতা। মাদকাসক্ত রোগীদের মানসিক রোগ যেমন-বিষণ্ণতা, সিজোফ্রেনিয়া রোগের ঝুঁকি বাড়ে। যেহেতু মানসিক রোগ হলে চিকিৎসা করে সুস্থ হলে ৩-৬ মাস কমপক্ষে সময় নেয় সেক্ষেত্রে আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ে। স্বাভাবিক কাজে ব্যস্ত হতে পারে না। ১৯তম মৃত্যুর কারণ মাদক। সুতরাং মানসিক ও শারীরিক রোগের চিকিৎসা করাতে টাকা প্রয়োজন, না হলে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় ৪০% মাদকাসক্তদের চিকিৎসা না পেয়ে পরিবারের বোঝা হয়ে থাকে। মাদকাসক্ত রোগীদের দ্বারা বছরে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।

মাদকাসক্তদের দ্বারা মানুষের নিরাপত্তার প্রতি প্রভাব

মাদকাসক্তদের রিস্ক নিয়ে বা অনেক বেশি গতিতে যানবাহন চালকের কারণে রাস্তায় দুর্ঘটনার প্রবণতা বেশি ও অনেকেই বিকলাঙ্গ হয়ে যায়, হাত-পা হারিয়েছে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, গাঁজাসেবীদের মধ্যে সাধারণ মানুষদের থেকে যানবাহনে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা ১০ গুণ বেশি। এমনকি কোকেন ও বেনজোডায়াজেপিন সেবনে এর হার ২-১০ গুণ বেশি যা ইয়াবাসেবীদের সর্বোচ্চ ৩০ গুণ বেশি। দুর্ঘটনায় ২০০ জনে ২০ জনের মৃত্যু হয় বা গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বিকলাঙ্গ হয়। হাসপাতালে চিকিৎসায় কম অর্থ ব্যয় হয় না। মাদক গ্রহণের সিরিঞ্জ হতে হেপাটাইটিস A, B, C ও AIDS ছড়ায়।

পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব

মাদকাসক্তদের ফেলে দেয়া মাদকের উচ্ছিষ্ট অংশ পরিবেশে ও পানিতে ফেললে পরিবেশ দূষিত হয়। পানি দূষিত হয়ে পানিতে থাকা প্রাণীদের ক্ষতি হয়। আবার মাদক যেমন-পপি গাছ জমিতে লাগালে জমির পুষ্টিগুণ নষ্ট হয় ও সে জমিতে কোনো গাছ জন্মাতে পারে না। ফসল ও চাষ হয় না যা দেশের খাদ্য উৎপাদনের জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশের মতো কৃষি নির্ভর ও দেশের জন্য মাদকের দ্বারা অর্থনৈতিক বড়ো ক্ষতির প্রবণতা হতে পারে।

মাদকাসক্তদের মধ্যে অপরাধের প্রবণতা

গবেষণায় দেখা গেছে ৫৫% অপরাধের সাথে মাদকাসক্তরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এমনকি ১৯% মাদকাসক্তরা মাদক নেয়া ছাড়াও অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের জেলে আটক অপরাধীদের মধ্যে ১৭% মাদকের ৫ টাকার জন্য বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এসব অপরাধে অস্ট্রেলিয়াতে ৩ বিলিয়ন ডলার ও আমারিকার ৬১ বিলিয়ন ডলার বাৎসরিক খরচ হয়। এসব অপরাধের জন্য বিচারের কাজে অভিভাবকদের অনেক অর্থ অপচয় হয়। আবার অনেক অপরাধে টাকা জরিমানা হয়।

মাদকাসক্তদের কাজের ক্ষেত্রে প্রভাব

মাদকাসক্তরা কাজ স্বাভাবিক গতিতে করতে পারেন না। মাদকাসক্ত জানলে কেউ চাকরি দিতে চায় না। অনেকের কোনো কাজ করার আগ্রহ থাকে না। বাসায় শুয়ে বসে সময় কাটায়। যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১১ সালে কাজে যোগদান না করায় ১২০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে যার ৬২% মাদকের কারণে। কাজে যোগদান না করলে GDP কমে আসে উৎপাদন কমের কারণে।

চিকিৎসায় খরচ, হাসপাতালে ভর্তি

মাদকাসক্তরা তাদের মাদকের প্রভাবের জন্য কাজ করতে পারে না। এদের রিহ্যাবে ও হাসপাতালে চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ হয় যা আমাদের দেশের মতো নিম্ম আয়ের দেশে অনেকের পক্ষেই দেয়া সম্ভব না। ২০১০ সালে ইউরোপে গবেষণায় দেখা গেছে বেকারদের প্রায় ৫৬% মাদকে আসক্ত থেকে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।

শিশু ও মহিলাদের ওপর মাদকের প্রভাব

পরিবারের কেউ মাদকাসক্ত হলে তা বাচ্চাদের ক্ষত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ছোটো বয়সে মাদক আসক্তদের শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের সম্ভাবনা অনেক। অনেকেই এর মধ্যে দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতার প্রবণতা বেশি ও তারা স্বাভাবিক কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। দিনকে দিন মহিলাদের মধ্যে মাদকাসক্তের প্রভাব বাড়ছে। এদের মধ্যে বাসায় নির্যাতন, যৌন নির্যাতনের ও মাদক দ্বারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের প্রবণতা বাড়ে।

পরিশেষে বলা যায়, আমাদের মতো গরীব দেশে যেখানে অনেক মানসিক চাপ, দিনকে দিন বাড়ছে বেকারত্ব, দারিদ্র্য সেখানে একজন মাদকে আসক্ত হলে তাকে চিকিৎসা করা যথেষ্ঠ ব্যয়বহুল যা সবার পক্ষে সম্ভব না। অনেকেই মাদক গ্রহণের কারণ হিসেবে দারিদ্র্যকে উল্লেখ করলেও সামাজিক কারণে মাদক থেকে সুস্থতার ক্ষেত্রে লজ্জা ও চিকিৎসা নিতে আন্তরিকতার অভাবের কারণে দীর্ঘদিন অর্থনৈতিক সমস্যা শুধু পরিবার না দেশও একজন নাগরিকের দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত হয়। আবার মাদকাসক্তরা দীর্ঘদিন কাজ না করার কারণে দারিদ্রতায় ভুগে। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উনড়বয়ন, সামাজিকভাবে মাদক ও মাদকাসক্তদের সহযোগিতার মাধ্যমে সার্বিক চিকিৎসা নিশ্চিত ও প্রতিরোধে দেশ ও দেশের কঠোর অবস্থানই পারে দেশকে মাদকের থাবা থেকে বাঁচাতে।

ডা. চিরঞ্জীব বিশ্বাস

সহকারী অধ্যাপক, উত্তরা মহিলা মেডিক্যাল কলেজ।

সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৯ম সংখ্যায় প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে 

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪
Previous articleশিশুর সিজোফ্রেনিয়া হলে কি করবেন?
Next articleশজিমেকে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ নিয়ে আলোচনা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here