ক্লাসিকাল অটিজম বনাম রিগ্রেসিভ অটিজম

0
1730
ক্লাসিকাল অটিজম বনাম রিগ্রেসিভ অটিজম

আরিফ (ছদ্মনাম), বয়স ৩ বছর। তার ডেভেলপমেন্টাল ডিলে নিয়ে মা মিসেস রুম্পা (ছদ্মনাম) ও বাবা মো: সাজ্জাদ (ছদ্মনাম)-এর সাথে সে গিয়েছিল রাজধানীর একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে অ্যাসেসমেন্ট করানোর উদ্দেশ্যে। সেখানে যেয়ে অ্যাসেসমেন্টকারীর সঙ্গত প্রশ্নগুলোর জবাবে আরিফের মা বাবার কাছ থেকে যা জানা গেলো, তা হলো –

আরিফের সকল প্রকার শারিরীক বিকাশ যথার্থ সময়ে হয়েছে। আরিফের ভাষাগত বিকাশও যথার্থ সময়ে হয়েছে। আরিফ তার বয়সী ছোট শিশুদের সাথে খেলতে পছন্দ করতো। আরিফের ৮ মাস বয়স থেকেই কিছু বিষয়ে অতিরিক্ত কৌতুহল ছিলো, যা এখোন আরো অনেক বেড়ে গিয়েছে। যেমন- খেলনা লাইন করে সাজানো, বর্ণমালা ও বস্তুর আকার আকৃতি নিয়ে অধিক আগ্রহ।

আরিফ শুরু থেকেই কিছুই চিবিয়ে খায় না। আরিফ শুরু থেকেই মা ও বাবা ছাড়া অন্য কারো স্পর্শ পছন্দ করতো না। আরিফের দেড় বছর বয়সে চিকুনগুনিয়া জ¦র হয়, যার ফলে খিঁচুনীও হয়।

জ্বরের পর থেকে আস্তে আস্তে পরিবারের সবাই লক্ষ্য করলেন যে, আরিফের বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। যার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের প্রতি অনিহা, ডাকে সাড়া না দেয়া, আঙুল দিয়ে পয়েন্ট না করা, চোখের দিকে না তাকানো লক্ষ্যণীয়।

আরিফকে নিয়ে সবসময় তার মা-বাবা সব ধরনের অনুষ্ঠানে যায় তার ৩ মাস বয়স থেকেই। তার ৬ মাস বয়স থেকে মা-বাবা লক্ষ্য করেছেন, আরিফ কোনো দাওয়াতে বা ভিড় সম্বলিত পরিবেশে যেতে পছন্দ করে না। যদিও বা নিয়ে যাওয়া হয়, তার সেখান থেকে বার বার বের হয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে এবং হাত দিয়ে কান বন্ধ করে রাখে।

এক বছর বয়স থেকে আরিফ পায়ের আঙুলের উপর সবসময় না হলেও, প্রায়ই ভর দিয়ে হাঁটা শুরু করে। পরবর্তীতে খেয়াল করা হয়, মেঝেতে বসলে আরিফ সবসময় W ম্যানারে বসছে। যার ফলে তার পায়ের গঠনে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ব্যাপারটা হলো, ইদানিং সে নিজেকে প্রচন্ড আঘাত করে, কিন্তু ব্যাথা অনুভব করে না। তার জেদ ও নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা দূর করার জন্য ডিভাইসের সহযোগিতা নেয়ার কারণে বর্তমানে তার স্ক্রিন ডিপেন্ডেন্সি দেখা দিয়েছে। তাকে এখন পর্যন্ত টয়লেট ট্রেনিং করানো যাচ্ছে না।

আরিফের মা-বাবার তথ্যগুলোর সত্যতা যাচাই করা গেলো তার শূন্য বয়স থেকে শুরু করে ৩ বছর বয়স পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ধারণকৃত বেশ কিছু ভিডিও-র মাধ্যমে। সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে বোঝা গেলো যে, আরিফ অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজওর্ডার সম্পন্ন একজন শিশু।

তার অটিজমের ধরণকে গবেষকরা নাম দিয়েছেন, রিগ্রেসিভ অটিজম। এই অটিজমের ধরনটি অনেক মা-বাবাই ধরতে পারেন না। যার ফলে ভালো হয়ে যাবে মনে করে তা সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে গুরুতর আকার ধারণ করে। আজকে তাই আমার লেখার বিষয় রিগ্রেসিভ অটিজম।

রিগ্রেসিভ অটিজম কি?

রিগ্রেসিভ অটিজম লক্ষ্য করা যায়, যখন কোনও শিশুর সাধারণ প্রচলিত বিজ্ঞানের নিয়মেই বিকাশ ঘটতে থাকে, তবে পরবর্তীতে সাধারণত ১৫ থেকে ৩০ মাস বয়সের মধ্যে সামাজিক ও ভাষাগত দক্ষতা হারাতে শুরু করে। পরবর্তীতে তা অটিজম হিসেবে নির্ণয় করা হয়।

ক্লাসিকাল অটিজম বনাম রিগ্রেসিভ অটিজম

গবেষকরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অটিজম সম্পন্ন শিশুর ভিডিও-তে পর্যবেক্ষণ করেছেন, যে ক্লাসিকাল অটিজম ও রিগ্রেসিভ অটিজমের একটা জায়গাতেই পার্থক্য, যা হলো একটির লক্ষণ শিশুর প্রথম বছর থেকেই লক্ষণীয় আর একটির লক্ষণ শিশুর বয়স গড়ে ১৯ মাস থেকে লক্ষণীয়। যেমন ভাষাগত বিকাশে বিলম্ব, চোখের দিকে না তাকানো, নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেয়াসহ দেখা বেশ কয়েকটি আচরণ।

অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার সম্পন্ন্ প্রায় ২৫-৩০% শিশুরা কথা বলতে শুরু করার পরে দুই বছর বয়সের আগে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। একজন আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ও অটিজমের গবেষক অমি ক্লিনের মতে, “অটিস্টিক রিগ্রেশনের বেশিরভাগ উদাহরণগুলো শিশুদের আয়ত্ব করা শব্দ ভান্ডার থেকে বেশকিছু শব্দ হারিয়ে যাওয়ার উপর ভিত্তি করে, যেই শব্দগুলো সম্ভবত এই শিশুরা কেবল তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে শুনেছিল”। কিছু শিশু সামাজিক দক্ষতা হারায়, কিছু শিশু ভাষার দক্ষতা হারায় আবার কিছু শিশু উভয়ই হারায়।

পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ, আবেগীয় দক্ষতার অভাব, খেলনা নিয়ে প্রচলিত নিয়মে না খেলতে পারা বা বিশেষ কিছু মানুষ ছাড়া অন্যদের প্রতি অনাগ্রহ, এ সবকিছুই দুই ধরণের অটিজম সম্পন্ন শিশুদের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। তবে রিগ্রেসিভ অটিজম সম্পন্ন শিশুরা পরিবেশগত কারণে প্রাথমিক ভাবে ভাষার বোধগম্যতার ও ইশারায় ভাবপ্রকাশের দক্ষতা কিছুটা দেখাতে সক্ষম হলেও, তা পরবর্তীতে অটিজমের নিউরোলজিকাল বৈশিষ্ট্যের কারণে লোপ পেতে থাকে।

পরিবেশগত কারণ বলতে এখানে আমরা উল্লেখ করতে পারি, যৌথ পরিবারে বসবাস, গ্রামে বসবাস, মা-বাবার সাথে যথেষ্ট পরিমাণে গুনগত সময় কাটানো, অতিরিক্ত স্ক্রিনটাইম থেকে নেয়া শব্দ ভান্ডার ইত্যাদি। যার মাধ্যমে একজন সাম্ভাব্য অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশু শুধু ভাষার বা আচরণের অনুকরণ করা শিখেছে, কিন্তু যথার্থ প্রয়োগ শিখেনি।

আশেপাশে এতো মানুষ সম্বলিত পরিবেশে থাকার পরও যখন তাদেরকে পরিচিত পরিবেশের বাহিরে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তারা সেই পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। বিধায় পরিবারের লোকদের সাথে শিশুটি যেভাবেই যোগাযোগ স্থাপনে অভ্যস্ত হোক না কেন, শিখিয়ে দেয়ার পরও বাহিরের মানুষের সাথে সেভাবে সে যোগাযোগ স্থাপনে আগ্রহ পায় না বা বিরক্তি প্রকাশ করে অথবা ভয় পায়।

এই ব্যাপারটা শিশুটির মা-বাবা তেমন লক্ষণীয় মনে করেন না, কারণ সে বাসায় কোনরকমে (মৌখিক বা অমৌখিকভাবে) পরিবারের মানুষদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হচ্ছে। রিগ্রেশনের পর থেকে শিশু অটিস্টিক স্নায়ুবিক বিকাশের স্ট্যান্ডার্ড প্যাটার্ন অনুসরণ করতে শুরু করে আর তখন মা-বাবা পরিবর্তনগুলো ভালো মত লক্ষ্য করেন।

সাম্ভাব্য কারণ

গর্ভকালীন বা প্রসবকালীন সময়ে মায়ের শারিরীক বা মানসিক জটিলতা, জ্বীনগত জটিলতা বা অটোইমিউনিটি, পরিবেশ দূষণ, শিশু অবস্থায় মানসিক চাপ, গুরুতর ইনফেকশন, খিঁচুনী, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি।

এমএমআর ভ্যাক্সিনের সাথে এর সম্পর্ক নিয়ে মাত্র ১২ জন শিশুর উপরে করা একটি বিতর্কিত গবেষণা রয়েছে, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন গবেষণায় ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়।

করণীয়

অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এএসডি), তা ক্লাসিকাল হোক অথবা রিগ্রেসিভ হোক, সন্দেহ হলে আপনার সন্তানের একটি সম্পূর্ণ অ্যাসেসমেন্ট প্রয়োজন, যা আপনার সন্তানকে দ্রুত সঠিক ব্যবস্থাপনায় নেয়ার পূর্বশর্ত। অটিজম সম্পন্ন শিশুর বিভিন্ন ধরণের দক্ষতা যাচাই-এর প্রয়োজন আছে। তাই বিভিন্ন পেশাজীবী ব্যক্তির দলগত পর্যবেক্ষণ আবশ্যক। এই দলে যারা থাকবেন তারা হলেন-

শিশু বিকাশ বিশেষজ্ঞ পেডিয়াট্রিশিয়ান, শিশু নিউরোলজিস্ট, শিশু মনোবিজ্ঞানী বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, স্পিচ এ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাথোলজিস্ট, অডিওলজিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট ও পুষ্টিবিদ।

পরামর্শ

অটিজম ও এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিস্তর জানার চেষ্টা করুন। অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার সম্পর্কে আপনি যত বেশি জানবেন, আপনার সন্তানের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে আপনি তত ভাল ভাবে নিজেকে তৈরি করতে পারবেন।

নিজের সন্তান সম্পর্কে বিস্তর জানার প্রয়াস রাখুন। আপনার সন্তানের চ্যালেঞ্জিং আচরণগুলো কী কী এবং তার এই আচরণগুলো কিভাবে প্রভাবিত হচ্ছে তা সম্পর্কে লিখিত রেকর্ড রাখুন। কিভাবে আচরণ গুলোর ইতিবাচক ব্যবস্থা নেয়া যায় তা সম্পর্কে প্রফেশনালদের সাহায্য নিন।

ধৈর্য্য ধরুন ও লেগে থাকুন। আপনার সন্তানের সম্ভাবনার বিকাশ ঠিক কত দিনের মধ্যে আসবে তা সময় বেধে কেউ আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। সকল শিশু নিজ বৈশিষ্ট্যে আলোকিত। এক একজনের বিকাশ এক এক ভাবে ঘটে। প্রফেশনাল সাহায্য সহকারে কারো বিকাশজনিত উন্নতি ঘটবে হয়তো এক মাসে, কারো হয়তো ঘটবে এক বছরে।

আবার কারো ঘটতে পারে আরো অনেক দীর্ঘ অপেক্ষার পর। কিন্তু মাঝপথে যেয়ে হাল ছাড়া যাবে না। হয়তো আপনি হতাশায় ক্লান্ত হয়ে যেতে পারেন, কিন্তু ক্লান্ত হয়ে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।

পথিমধ্যে যাত্রাবিরতি দিয়ে ক্লান্তি কাটিয়ে আবার সামনে এগিয়ে যাবেন। সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আমরা কেউ ভবিষ্যৎ জানিনা। হাল ছেড়ে দিলে অপার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের আর দেখা মিলবে না। আপনার সন্তান নিমজ্জিত হবে কঠিন থেকে কঠিনতর বিপত্তির ভিতর।

আপনার অটিজম সম্পন্ন শিশুটির অক্ষমতাকে বারবার খুঁজে বের না করে, তার সক্ষমতাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। আপনার সন্তানের প্রতিটি ছোট ছোট সাফল্য উপভোগ ও উদযাপন করুন। অন্যের সাথে আপনার সন্তানের তুলনা না করাই ভাল। আগেই বলেছি, সকল শিশু নিজ বৈশিষ্ট্যে আলোকিত। নিঃশর্ত ভালবাসা এবং স্বীকৃত বোধ করা আপনার শিশুকে অন্য যে কোনও কিছুর চেয়ে বেশি সহায়তা করবে।

অনেক পরিবারেই রিগ্রেসিভ অটিজমকে নেহায়াত বিকাশজনিত জটিলতা মনে করে থাকেন। তারা অপেক্ষায় থাকেন প্রকৃতির নিয়মে শিশু বেড়ে উঠার এবং সেড়ে উঠার। যেই শিশুদের শুধুমাত্র ভাষাগত জটিলতা থাকে, তারা একসময় প্রাকৃতিকভাবে জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র ভাষাগত জটিলতা, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো কারণ, তা জেনে নিতে দোষ কোথায়? আর জানার পর মেনে নিতেই বা দোষ কোথায়?

পরিশিষ্ট

পরিশেষে এটাই লিখে শেষ করতে চাই, সঠিক সময়ে সঠিক মূল্যায়নের পর ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করলে অপনার সন্তানের সামনে খুলে যেতে পারে অসীম সম্ভাবনার দ্বার। আপনার না জানার ইচ্ছা বা আপনার জেনেও না মেনে নেওয়ার ইচ্ছা হতে পারে আপনার সন্তানের সম্ভাবনার নিরব ঘাতক।

অজান্তে সন্তানের নিরব ঘাতক হবেন না। সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রেখে, আত্মবিশ্বাস ও সাহস সঞ্চয় করে সমাজের বাধা উপেক্ষা করে আপনার অটিজম সম্পন্ন সন্তানকে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলুন।

লিখেছেন:
ডা. আইরিন বিনতে আজাদ
জেনেরেল ফিজিশিয়ান (এমবিবিএস)
প্যারেন্ট এডুকেটর, কিডিরকস স্পেশাল স্কুল
সার্টিফাইড প্যারেন্টিং কোচ (ডেভেলপমেন্টাল, ইফেক্টিভ এ্যান্ড এনকারেজিং প্যারেন্টিং, ভারত)
ট্রেইন্ড ইন ডিজ্যাবিলিটি, অটিজম এ্যান্ড ইনক্লুসিভ এডুকেশন (আই ই আর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজওর্ডার কোর্সে প্রশিক্ষণরত (ইপনা, বি এস এম এম ইউ)

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪

Previous articleকপালের নিচে ও নাকের গোড়ায় ভারী বা অস্বস্তি অনুভব করছি
Next articleসার্ক সাইকিয়াট্রিক ফেডারেশনের কমিটিতে বাংলাদেশের খ্যাতনামা ৮ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here