আন্তর্জাতিক রেফারেন্স বইয়ে ডা. জিল্লুর রহমানের ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ গবেষণা

0
125

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক গবেষণা রেফারেন্স বই ‘মেন্টাল হেলথ এন্ড ইলনেস ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’ এর রুরাল ওয়ার্ল্ড সিরিজে ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশী সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. মোহাম্মদা জিল্লুর রহমান খান (রতন) এর গবেষণা নিবন্ধ।

বইয়ে বাংলাদেশের পল্লী মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নশিরোনামের আলোচ্য গবেষণায় তিনি বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়ন, সেবার পরিধি বৃদ্ধি, প্রচলিত কুসংস্কার রোধে করণী সহ নানান বিষয় তুলে ধরেছেন।

গতকাল রোববার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনিস্টিটিউটে সাইন্টিফিক কমিটির মিটিং শেষে সহকর্মী, শিক্ষার্থী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের হাতে বইটির কপি তুলে দেন ডা. মোহাম্মাদ জিল্লুর রহমান খান (রতন)।

এসময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর পরিচালক অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট (বিএপি) এর সহ-সভাপতি  ব্রিগেডিয়ার জেনালে (অবঃ) আজিজুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক  ডা. মোহাম্মদ তারিকুল আলম ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. ফারুক প্রমুখ।

মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সিঙ্গাপুরের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘স্প্রিঙ্গার নেচার সিঙ্গাপুর পিটি লিমিটেড’ এর গবেষণা সিরিজ বুক ‘মেন্টাল হেলথ এন্ড ইলনেস ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’ এর একটি সিরিজ ‘মেন্টাল হেলথ ইলনেস ইন দ্যা রুরাল ওয়ার্ল্ড’।

ভারতের বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস, ‍যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ও ডিন ডা. সন্তোষ চতুর্বেদী সম্পাদিত সিরিজটির ‘মেন্টাল হেলথ ইলনেস ইন দ্যা রুরাল ওয়ার্ল্ড’ বইটি ২০২০ সালে সফট কপি প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি এর হার্ড কপি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘স্প্রিঙ্গার নেচার সিঙ্গাপুর পিটি লিমিটেড’।

অরো পড়ুন…
মানসিক স্বাস্থ্য কী?
মানসিক স্বাস্থ্য : আমরা কতোটা সচেতন?

সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত বইটিতে মোট ২২টি অধ্যায় রয়েছে। এর ১১ নাম্বার অধ্যায়ে ‘ডেভেলপমেন্ট অফ রুরাল মেন্টাল হেলফ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশ হয়েছে ডা. জিল্লুর রহমানের গবেষণা। এছাড়াও এতে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, শ্রীলঙ্কা, সাউথ আফ্রিকা, ইন্ডিয়া ও ইউরোপ সহ ২২টি দেশের গবেষাণা প্রকাশ হয়েছে।

ডা. জিল্লুর রহমান খান রতন, বিভাগীয় প্রধান- মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ

ডা. মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান খান (রতন) বাংলাদেশের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ এর মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট বিএপি‘র সাইন্টিফিক কমিটির সেক্রেটারী। বই সম্পর্কে মনের খবর আলাপ করে ডা. জিল্লুর রহমানের সাথে।

তিনি আমাদেরকে জানান, বালাদেশে গ্রামীণ মানসিক স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি ও কীভাবে তা ডেভেলপমেন্ট করা যায়, কোন কোন পদক্ষেপ প্রয়োজন, সরকার ইতোমধ্যে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে? কাজের ক্ষেত্রে আমাদের সামনে কোন ধরণের বাধা আছে এসব বিষয় উঠে এসেছে বইটির ১১ নাম্বার অধ্যায়ের ১৮২ থেকে ১৯৫ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত তার আলোচনায়।

ডা. জিল্লুর রহমান বলেন, আমার আলোচনার মূল বিষয় ছিলো গ্রামীণ জনপদে কীভাবে সাফল্যের সাথে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা অরগানাইজড করা যায়। এক্ষেত্রে কী কী আমাদের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এবং সেগুলোর সমাধান কীভাবে করা যায়।

  • তিনি বলেন, আমাদের জনবল কম, সাইকিয়াট্রিস কম, স্পেশালিস্ট সার্ভিস কম। সেক্ষেত্রে আমাদেরকে মানসিক স্বাস্থ্য তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামীণ জনপদে পৌঁছাতে হলে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা সেন্টারে সেবাটা বিস্তৃত করতে হবে। আমাদের ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে, জেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে সেখানে ডাক্তাররা যান। তাদেরকে যদি আমরা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষন দিতে পারি বিশেষ ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকমীদের তাহলে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাবে।

ডা. রতন জানান, দেশে ৩৮টি মেডিকেল কলেজ আছে। কিন্তু সেগুলোতে এখনো ডিপার্টমেন্ট তৈরী হয়নি। আউটপেশেন্টে বসার জায়গা নাই, লোকবল নাই। এছাড়াও নানাবিধ সমস্যা আছে। এগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। মেডিকেল কলেজগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগ চালু করতে হবে। সারাদেশে মেডিকেল কলেজগুলোতে ডিপার্টমেন্ট চালু হলে আর কাউকে ঢাকায় আসা লাগবে না।

তিনি আরো জানান, দেশে প্রথমবার ‘হেলথ পপুলেশন এন্ড নিউট্রিশন সেক্টর’ প্রোগ্রামে আলাদাভাবে মেন্টাল গুরুত্বের সাথে জায়গা পায়। এ নিয়ে সরকার একটি প্রকল্প নেয় ২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত। এরপর সেটাকে ১৬’ থেকে ২১’ করা হয়। এরমধ্যে অনেক কাজ হয়েছে। সরকারিভাবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গুরুত্ব পেয়েছে। এরপরও আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যেগুলো নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে বলছিলেন ডা. জিল্লুর রহমান।

তিনি বলেন ওই প্রকল্পের আগে আমার আলোচনায় মেন্টাল সার্ভিস ফর ভালনারেবল পপুলেশন, মেন্টাল হেলফ পলিসি (কর্মপদ্ধতি) এবং লেজিলেশন (আইন) উঠে আসে।

তিনি বলেন, ২০১৬ সালে এ বিষয়ে আইন পাশ হয়েছে আর সম্প্রতি মেন্টাল হেলথ পলিসি (কর্মপরিকল্পনা) মন্ত্রীসভায় অনুমোদন হয়েছে। সে হিসেবে অনেক বড় কাজ হয়েছে এখন সচেতনতা বাড়ানো দরকার। সমাজে অনেক কুসংস্কার আছে সেগুলো দূর করতে পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

ডা. খান বলেন, জনগণকে সচেতন করতে- আমরা বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস সহ নানা সময়ে নানান কর্মসূচি পালন করি। বিশেষ করে মানসিক রোগের চিকিৎসা উন্নয়নে নিরলস কাজ করছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট। পাঁচটি মানসিক রোগের ওপর গাইডলাইন তৈরীর কাজ করছে বিএপি। ইতোমধ্যে বাইপোলার ডিস-অর্ডার ও সিজোফ্রেনিয়া রোগের গাইডলাইন প্রকাশ করা হয়েছে। আরো তিনটি রোগ ডিপ্রেশন, এনজাইডি ও ওসিডি ডিসঅর্ডার এর গাইডলাইন তৈরীর কাজ চলছে।

এছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মানসিক স্বাস্থ্য প্রোগ্রাম, রেডিও-টেলিভিশনে বিভিন্ন টকশো প্রোগ্রাম, সাইকিয়াট্রিকরাও ব্যক্তিগতভাবে কাজ করছে। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন-সংস্থা আছে, মনের খবর পত্রিকা কাজ করছে, অন্যান্য গণমাধ্যমেরও ভুমিকা আছে।

এখন সারাদেশে মেডিকেল কলেজগুলোতে ডিপার্টমেন্ট চালু হলে আর কাউকে ঢাকায় আসা লাগবে না। এগুলোর আন্ডারে তৃণমূল পর্যায়ে সেবাটা পৌঁছে দিতে হবে।

ডা. খান আরো বলেন, গ্রামীণ ক্লিনিকে কী কী চিকিৎসা পাওয়া যায় সেটা যদি মানুষের জানা থাকে- যে এখানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায়। তখন মানুষ বুঝতে পারবে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রচলিত ধারণা একটা কুসংস্কার। সচেতনতা বাড়ানো গেলে তখন মানুষ বুঝতে পারবে মানসিক সমস্যাও একটা অসুস্থতা। এরজন্য চিকিৎসা রয়েছে এবং প্রাথমিকভাবে তারা স্থানীয় ক্লিনিকেই সেই সেবাটা পাবে।

এটাও পড়ুন…..
পরিবারে কম সন্তান শিশুর মানসিক সমস্যা তৈরী করে : গবেষণা

মানসিক সমস্যা সম্পূর্ণই কুসংস্কার নাকি গ্রামীণ ধারণার নূন্যতম কোনো ভিত্তি আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে এটা একটা রোগ। মস্তিস্কের একটা সমস্যা। অসংক্রামক ব্যাধি। এর চিকিৎসা রয়েছে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রমাণিত এটা ব্রেনের রোগ। ডায়াবেটিকের মতো মাল্টিপল কস। শারীরিক, মানসিক এবং মনোসামাজিক সমস্যা। হাইপারটেনশন ডায়বেটিক যেমন অসংক্রামক ব্যাধি। জেনেটিক, পরিবার, বংশগতভাবে এটা হতে পারে।

মানসিক চাপের কারণে ব্রেনের নিউরোক্যামিক্যাল রসায়নিকের তারতম্য হওয়ায় মানসিক অসুস্থতা তৈরী হয়। অন্যান্য রোগের মতো এটা কীভাবে হয় তা বিজ্ঞানে প্রমাণ করা হয়েছে এবং এর চিকিৎসাও রয়েছে। সমাজে প্রতলিত ধারণার পুরোটাই কুসংস্কার।

আন্তর্জাতিক এ গবেষণা কর্মে নিজেকে কীভাবে সম্পৃক্ত করলেন সে অভিজ্ঞতা জানিয়ে ডা. জিল্লুর রহমান বলেন, ২০১৭ ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে ইন্টারন্যাশনাল একটা কনফারেন্স ছিলো। সেখানে আমাদের টিম লিডার ছিলো অধ্যাপক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন। বর্তমানে তিনি স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

ওইখানে একটা কান্ট্রি পেজেন্টেশন ছিলো। সেটা এনায়েত স্যারের করার কথা ছিলো। কিন্তু স্যার আমাকে আগে থেকেই বললেন এটা তোমাকেই করতে হবে। ওই পেজেন্টেশনে আমার লেকচার শুনে সন্তোষ চতুর্বদী খুশি হন। পরে বিরতির সময় সন্তোষ চতুর্বদী আমার সাথে পরিচিত হন এবং আমাকে বলেন আমরা একটা সিরিজ বের করতেছি তুমি একটা লেখা দাও বাংলাদেশে গ্রামীণ মেন্টাল হেলথ নিয়ে।

দেশের জন্য এটা একটা বড় অর্জন এবং নিজের জন্যও গর্বের বিষয়। দেশের অন্যান্য সাইকিয়াট্রিসরা যদি এরকম কাজে অংশ নেন তাদের প্রতি বিশেষ বার্তা রেখে তিনি বলেন, ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে অনেক সাইকিয়াট্রিস্টের গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে।

আমি মনে করি যেহেতু ইন্টারন্যাশনাল অনেক জার্নালে তাদের লেখা জার্নাল আছে সেহেতু বইয়েও তাদের কন্ট্রিবিউশন থাকলে আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের দেশের কার্যক্রম আলোচনায় আসবে দেশেও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অগ্রগতি নতুন মাত্রা পাবে।ইতোমধ্যে আরো দুজন সাইকিয়াট্রিস্টেরে গবেষণা প্রকাশ হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। আমি মনে করি আরো যারা আছেন তাদেরও রেফারেন্স গবেষণা পাবলিকেশনে এগিয়ে আসতে হবে।

  • উল্লেখ্য, রুরাল মেন্টাল, আরবান মেন্টালসহ প্রায় ১০টি বই নিয়ে ‘মেন্টাল হেলথ এন্ড ইলনেস ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’ সিরিজটি করেছে সিঙ্গাপুরের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘স্প্রিঙ্গার নেচার সিঙ্গাপুর পিটি লিমিটেড’। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড এই সিরিজটির সম্পাদক ডব্লিউএইচও এর মেন্টাল হেলথ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও ওয়ার্ল্ড সাইকিয়াট্রিস অ্যাসোসিয়েশনের (World Psychiatric Association) প্রেসিডেন্ট জার্মান সাইকিয়াট্রিস প্রফেসর নরমান সার্টারিয়াস।

সিরিজের সর্বশেষ প্রকাশনা ‘মেন্টাল হেলথ ইলনেস ইন দ্যা রুরাল ওয়ার্ল্ড’। এতে ২২টি দেশের মনোরোগ বিশেষজ্ঞের করা নিজ নিজ দেশের গ্রামীণ জনপদে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে গবেষণা প্রকাশ পেয়েছে। এই অংশের সম্পাদনা করেছেন- ভারতের বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস, ‍যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ও ডিন ডা. সন্তোষ চতুর্বেদী।

আরো পড়ুন…
দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি : মানসিক অস্বস্তিতে ভুগছেন নাগরিকরা

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে 

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪

/এসএস

Previous articleলোকবল সংকটে পাবনা মানসিক হাসপাতাল, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ধারস্থ স্থানীয় এমপি
Next articleমানসিক চাপ কমাতে কান্না করুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here