পরিবার যেভাবে শিশুকে গড়ে তুলবে


মাহজাবীন আরা : শিশুর মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে মূলত পরিবারের সদস্যদের সংস্পর্শে থেকে। তাই প্রতিটি পরিবারেই শিশুদের জন্য নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। নৈতিক শিক্ষা হলো সেই শিক্ষা, যা মানুষকে ভালো ও মন্দ; ন্যায় ও অন্যায়; শুভ ও অশুভের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে তার জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। যে শিশু জীবনের প্রথম বছরগুলোতে তার বিকাশের জন্য সহায়ক পরিবেশ পায়, সে শিশুটি অন্যদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান, সামাজিক ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। তার সামাজিক দক্ষতা, ভাষার দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও আত্মবিশ্বাস প্রভৃতির বিকাশ ঘটে যা তাকে সুনাগরিক হতে সহায়তা করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে স্নেহ-মমতার বন্ধন সন্তানকে নিরাপত্তা দেয়, তাতে শিশু আস্থাবান ও বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সন্তানের প্রতি বাবা-মার অবহেলা, অনাদর বা অতিরিক্ত দমননীতির প্রভাবে সন্তান অপরাধপ্রবণ, আস্থাহীন ও অন্তর্মুখী হয়।


শিশুকে অপরাধ প্রবনতামুক্ত ও অন্যের অধিকার সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পরিবারের কী কী করণীয় হতে পারে আসুন সে বিষয়ে জেনে নেই-
শিশুরা অনুকরণপ্রিয়; তাই বড়রা যা করে, তারা তাই শেখে। এজন্য অভিভাবকদের আচরণ হতে হবে মার্জিত, সুন্দর ও শিক্ষণীয়। অর্থাৎ শিশুর মধ্যে ন্যায়নীতিবোধ উন্মেষ ঘটাতে চাইলে নিজেদের ন্যায় নীতিতে অটল থাকতে হবে। আবার শিশুর মধ্যে সামাজিকতার বৈশিষ্ট্য আনতে চাইলে নিজেদেরকে সামাজিক হতে হবে।
শিশুর বয়স ও পরিপক্কতা অনুযায়ী নিয়ম-নীতি প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ ছোট ছেলেমেয়েদের যেভাবে পরিচালনা করা যায়, যৌবনপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েদের সেভাবে পরিচালনা করা যায় না। আবার কিশোর কিশোরীদের বেলায় একটু বেশি স্বাধীনতার প্রয়োজন হয়।


ছোটবেলা থেকেই শিশুদের সততার শিক্ষা দেওয়া জরুরি। তারা যেকোনো ভুল করুক না কেন, তাদেরকে সত্য বলায় উৎসাহিত করতে হবে। এজন্য মা-বাবাকেও শিশুর সামনে মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। মা-বাবার সততা শিশুদের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। কারণ তারা মা-বাবাকেই অনুসরণ করে ও আদর্শ মনে করে।
পরিবারের সবাইকে সম্মান করা শেখাতে হবে ছোটবেলা থেকেই। পরিবারে যে গৃহকর্মী, তাকেও সম্মান করতে শেখানো পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব। শিশুর সামনে অন্যদের হেয় করা বা কটাক্ষ করা থেকে বড়দের বিরত থাকতে হবে। এতে করে শিশুরা তাদের শৈশবকাল থেকেই অন্যদের সম্মান করার শিক্ষা অর্জন করবে।
সবার সঙ্গে ভালো আচরণ করা, অন্যদের সমস্যায় এগিয়ে যাওয়া, তাদের সুখ-দুঃখে পাশে থাকার বিষয়ে শিশুকে মানসিকভাবে তৈরি করতে হবে। এতে তাদের মধ্যে সহযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে উঠবে।


শুধু বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যদের জন্য ভালোবাসা নয়; ছোটবড়, ধনী-গরিব, পশুপাখির প্রতিও ভালোবাসা শেখাতে হবে। এতে শৈশব থেকেই অন্যের প্রতি সহানুভুতিশীল মনোভাব গড়ে উঠবে। ছোটবেলা থেকেই শিশুকে ধর্মীয় চর্চার শিক্ষা দিতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যেই নৈতিকতার বীজ প্রোথিত থাকে। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া শেখাতে হবে। ছোটবেলা থেকেই শিশুকে নম্র বা বিনয়ী হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে, যেন তার মধ্যে অহংকারবোধের জন্ম না নেয়। শিশুকে বুঝিয়ে দিতে হবে, নম্র ও বিনয়ী আচরণের মধ্য দিয়ে সে সবার কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে।


শৃঙ্খলা একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। পরিবারে ও বাইরে শিশুকে আদব-কায়দা ও নিয়ম-নীতিতে অভ্যস্ত করানোর জন্য শৃঙ্খলার প্রয়োজন আছে। তাই তাদেরকে শৃঙ্খলাবোধ শেখাতে হবে। সন্তান ও বাবা-মার মধ্যে সমঝোতামূলক, সমতাপূর্ণ এবং ইতিবাচক সম্পর্ক থাকবে। শিশু কাঙ্খিত আচরণ করলে উপযুক্ত পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। ঠিক তেমনি অনাকাঙ্খিত, অসামাজিক ও অন্যায় আচরণের জন্য সাময়িকভাবে শাস্তি প্রদান ও পুরস্কার দেয়া থেকে বিরত রাখতে হবে। এতে শিশু ন্যায়- অন্যায় সম্পর্কে বুঝতে শিখবে। শিশু পরিচালনায় বাবা-মা যে নীতি বা আদর্শ অনুসরণ করবেন তা যেন অটল থাকে। অর্থাৎ কোনো বিষয়ে বা ঘটনায় একদিন এক রকম প্রতিক্রিয়া করলে আবার অন্যদিন অন্যরকম প্রতিক্রিয়া শিশু বিভ্রান্ত হয়। একই বিষয়ে অভিন্ন নীতি ও মনোভাবের ফলে শিশু বাবা-মার প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও সম্মান করতে শিখবে এবং নিজেও আদর্শবাদী হতে শিখবে।


শিশুকে কাজে অংশগ্রহণ করানো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পারিবারিক বা দলগত কাজে শিশুকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং বয়স অনুযায়ী দায়িত্ব দিলে সে নিজেকে দায়িত্বশীল মনে করে। শিশুকে শারীরিক শাস্তি বা মারধোর করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, মারধোর করা হলে বড়ো হয়ে এরা নিজের সন্তানদেরও মারধোর করে এবং পরিবারে অশান্তি ডেকে আনে; তাদের মধ্যে আগ্রাসী মনোভাব, বিরোধিতা করা এবং অনেক সময় বাবা মার সাথে মারামারি করার মনোভাব গড়ে উঠতে পারে।
শিশুর প্রতি স্নেহ, মায়া, মমতা প্রকাশ করলে শিশুও পরিবারের অন্যদের মায়া করতে শেখে। পরিবারের সবার প্রতি সমান অধিকারবোধের শিক্ষা তাকে অন্যের অধিকারবোধের প্রতি সচেতন হতে শেখাবে।

উপরোক্ত বিষয়গুলো মেনে চললে পরিবারে একটি সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করবে। এতে করে শিশুর নৈতিক শিক্ষা লাভের পাশাপাশি তাদের মধ্যে মানবিক গুণাবলিও সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত হবে। শিশুরা এ দেশ ও সমাজের জন্য সুনাগরিক রুপে নিজেদের গড়ে তুলতে পারবে এবং সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে সক্ষম হবে।

লিখেছেন, মাহজাবীন আরা
এসিস্ট্যান্ট কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট

Previous articleমানুষ কেন সফলতা পেয়েও বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ? থাকছে বিশেষজ্ঞের অভিমত
Next articleঅনুশোচনা কাজ না করাটা ভীতিকর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here