প্রসঙ্গ : সাইক্লোথাইমিক ব্যক্তিত্ব

0
107

ডা. সৌবর্ণ রায় বাঁধন : সাইক্লোথাইমিয়া শব্দটি অনেক পুরোনো। এর ইতিহাসের সূচনা সাইকিয়াট্রির জন্মলগ্ন থেকে। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কার্ল লুডউইগ কার্লবাম সর্বপ্রথম এর নামকরণ করেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এর আলোচনা ও ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কখনো একে বাইপোলার ডিজঅর্ডারের ধরন, কখনো ব্যক্তিত্বের ধরন, টেম্পারেমেন্টের প্রকৃতি হিসেবে দেখানো হয়েছে। কখনো এর নামকরণ হয়েছে সাইক্লোথাইমিক পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার, কখনো আ্যফেক্টিভ পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার, কখনো বা বাইপোলার ফোর ডিজঅর্ডার নামে। ডিএসএম ফাইভের সর্বশেষ শ্রেণিবিন্যাসে একে বাইপোলার স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডারের ভিতরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সাইক্লোথাইমিয়াতে অসংখ্য হতাশার এপিসোড এবং অতিমাত্রায় উচ্চমাত্রার আবেগের এপিসোড আসে। কিন্তু কোনোটাই মেজর ডিপ্রেসিভ এপিসোড কিংবা ম্যানিয়ার ক্রাইটেরিয়া পূরণ করে না। শিশুদের ক্ষেত্রে এটাতে কমপক্ষে একবছর এবং বড়োদের ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুইবছর টানা এই উঠানামার লক্ষণগুলো থাকতে হয়। সাইক্লোথাইমিয়ার ক্ষেত্রে হতাশা থেকে উচ্চ আবেগে অথবা উচ্চ আবেগ থাকে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়ার ব্যাপারটা হুট করেই হয়। এই পরিবর্তন সুনির্দিষ্ট কোনো ধরন বা প্যাটার্ন অনুসরণ করে না। ফলে এটার সাথে খাপ খাইয়ে চলাটা রোগীর জন্য এবং তার আশেপাশের সবার জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
সাইক্লোথাইমিয়া কি বাইপোলার টাইপের কোনো মানসিক অসুস্থতা নাকি ব্যক্তিত্বের কোনো ধরন তা নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক রয়েছে। এমিল ক্রাপেলিন এবং স্নাইডার একে পারসোনালিটি বা ব্যক্তিত্বের সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছিলেন। সাইক্লোথামিয়ায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রে বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারের সহউপস্থিতি থেকে আন্দাজ করা যায় যে সাইক্লোথাইমিয়ার সম্পর্ক এই পারসোনালিটির সাথে বেশি। আবার সাইক্লোথাইমিয়ায় যারা ভুগেন তাদের পরিবারে বাইপোলার ওয়ান ডিজঅর্ডারের উপস্থিতি থাকে। আবার বাইপোলারে যারা ভুগেন তাদের পরিবারে সাইক্লোথাইমিয়ায় আক্রান্তের উপস্থিতি দেখা যায়। এটা সাক্ষ্য দেয় যে সাইক্লোথাইমিয়া সম্ভবত বাইপোলারের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সর্বশেষ গবেষণা অনুযায়ী সাইক্লোথাইমিয়াকে মুড ডিজঅর্ডারের ঘরানায় রাখা হয়েছে।
সাইকোএনালিস্টদের মতে শিশুর বিকাশে ওরাল স্টেজে ফিক্সেশন বা এই স্টেজকে সফলতার সাথে অতিক্রম না করতে পারলে সাইক্লোথাইমিয়ার মতো মুডের অস্থিতিশীলতা বা উঠানামা হতে পারে। শৈশবে বড়ো ধরনের কোনো আঘাত এ ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। ফ্রয়েডের মতে এই ধরনের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সুপারইগো প্রচণ্ড রকমের রুক্ষ হয়। সুপারইগো ইগোর সব কাজে অনেক বেশি শাস্তিমূলক মনোভাব দেখাতে থাকে। সামান্য কোনো কাজ বা চিন্তায় ইগো সুপারইগোকে দিয়ে অনেক বেশি নিপীড়িত হতে থাকে। ব্যক্তি তখন অত্যধিক মাত্রায় হতাশা বোধ করতে থাকে। কারণ সে কোনো কিছু করেই সন্তুষ্ট হতে পারে না। যে কাজই করুক তা নিয়ে মনের ভিতরে আত্মসমালোচনার জন্ম হয়। এক পর্যায়ে সহ্য করার ক্ষমতা চলে গেলে ইগো সুপারইগোর সমালোচনার ভার থেকে মুক্ত হতে চায়, তাকে ছুড়ে ফেলতে চায়। সুপারইগোকে চাপা দিতে পারলে আত্মসমালোচনার ভার থেকে মুক্ত থাকা যায়। এটার জন্য অচেতন মনে ডিফেন্স কাজ করে। এই ডিফেন্সের নাম ডিনায়াল। কোনো একটি বিষয়কে আপাতভাবে অস্বীকার করে যায়। ডিনায়ালের মাধ্যমে পারিপার্শ্বিক জগতের নানামুখি চাপ এবং মনের ভিতরের হতাশাবোধকে এড়িয়ে চলা যায়। এবং এই সার্বক্ষণিক হতাশাবোধ থেকে নিজকে বাঁচানোর জন্য এক ধরনের ইউফোরিয়া বা অত্যধিক আনন্দোচ্ছ্বাসের অবস্থা অচেতন মন তৈরি করে। যেটাকে অনেকে হাইপোম্যানিয়াও বলে থাকেন। এভাবেই হতাশা ও ইউফোরিয়া চক্রাকারে অনবরত আসতেই থাকে। এমনকি সে টানা দুইমাসের বেশি সময় এই উত্থান-পতনের বাইরে থাকতে পারে না। সাইক্লোথাইমিয়ায় এই চক্র বা সাইকেল লাগাতার চলতে থাকে।
আরেকটি তত্ত্বমতে খুব বড়ো ধরনের কোনো আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কে সমস্যা হলে বা পছন্দের কাউকে হারিয়ে ফেললে তীব্র হতাশার বোধ তৈরি হয়। সাইক্লোথাইমিয়ায় ব্যক্তি এই হতাশাবোধ থেকে বাঁচতে ওই লাভ অবজেক্ট বা ভালোবাসার বস্তু বা ব্যক্তির তার নির্ভরশীলতাকে অস্বীকার করে। এবং একইসাথে যে ধ্বংসাত্মক বা আগ্রাসী কারণে ওই পছন্দের ব্যক্তিকে হারিয়ে ফেলেছে সেটাকেও অস্বীকার করে। এই অস্বীকার করতে গিয়ে অচেতন মন এক ধরনের ভ্রান্ত উচ্ছ্বাস বা ফলস ইউফোরিয়া তৈরি করে। এভাবে এই ধরনের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বারাবার ক্ষতি থেকে জন্ম হওয়া হতাশাকে থামাতে গিয়ে মন বিভিন্ন ধরনের ডিফেন্স মেকানিজমের মাধ্যমে ইউফোরিয়া তৈরি করে। যেটা আবার ক্ষণস্থায়ী হওয়ায় চক্রাকারে চলতে থাকে।
সাইক্লোথাইমিয়াতে টেমপারেমেন্টের প্রভাব আছে বলে গবেষকরা মনে করেন। এটা পারসোনালিটির বায়োলজিকাল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। একজন শিশু জন্মগত ভাবে যে বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আসে যেমন আবেগিক দৃষ্টিভঙ্গি, ইমোশন প্রকাশের ধরন ইত্যাদি ব্যক্তিত্বের ধরন নির্ধারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টেম্পারেমেন্টের এই ভিন্নতার কথা গ্রিক যুগের বই কর্পাস হিপোক্রেটিকামেও প্রাথমিক আলোচনা রয়েছে। পরবর্তীকালে জার্মান সাইকিয়াট্রিস্ট এমিল ক্রাপেলিন সর্বপ্রথম সাইক্লোথাইমিক ট্রেইটের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন এই ধরনের টেম্পারেমেন্ট থেকে পরবর্তিতে বিভিন্ন ধরনের মুড ডিজঅর্ডার, সাইক্লোথাইমিয়া ইত্যাদি হতে পারে। সাইক্লথাইমিক টেমপারেমেন্টের মুডের অল্প বা বেশি পরিমাণে অস্থিতিশীলতা থাকে। এই অস্থিতিশীলতার ফলে হুট করে ভালো মুড বা খারাপ মুডে পর্যবসিত হওয়ার প্রবণতা থাকে। এছাড়া কখনো কখনো অত্যধিক ক্রিয়াশীল থাকে আবার কখনো কখনো কাজে আগ্রহ ও হারিয়ে ফেলে। সাইক্লোথাইমিক টেম্পারেমেন্ট থাকলে পরবর্তিতে বাইপোলার ডিজঅর্ডারের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। এগুলোর পাশপাশি আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কে অস্থিরতা, তাড়নার বশবর্তী হয়ে কাজ করে ফেলার প্রবণতা, খিটখিটে মেজাজ এই বৈশিষ্ট্যগুলো আবার সাইক্লোথাইমিয়া ও বর্ডারলাইন পারসোনালিটি দুই ক্ষেত্রেই দেখা যায়। বিশেষ করে মেজাজ বা মুডের অস্থিতিশীলতা দুইক্ষেত্রেই দেখা যায়। অনেক সময় এই দুই ডিজঅর্ডারকে আলাদা করে ডায়াগোনসিস করা কঠিন হয়।

লেখক : ডা. সৌবর্ণ রায় বাঁধন
রেসিডেন্ট, ফেইজ-বি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যল বিশ্ববিদ্যালয়।

Previous articleমাদক বিরোধী দিবসে মনের খবরের “লাইভ ওয়েবিনার”
Next articleমাঝে মাঝে নিজেকে মানসিকভাবে প্রচণ্ড অসুস্থ আর দুর্বল লাগে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here