আচরণ, ইতিবাচক আচরণ এবং ‘না’ বলতে পারার পদ্ধতি ও প্রয়োজনীয়তা

মো. আকবর হোসেন
মনোবিজ্ঞানী, সিয়েরা লিওন।

আমরা মানুষজন প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করি। একই ব্যাক্তি একেক জায়গায় একেকজনের সাথে একেকরকম আচরণ করি। পারস্পরিক সম্পর্কটা পারস্পরিক আচরণের ধরনের ওপর নির্ভর করে। আমাদের আচরণের ধরনের ওপরেই নির্ভর করে কারো সাথে আমাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হবে নাকি শত্রুতাপূর্ণ হবে এটা জানা কথা এবং সরল কথা।

আজকের আলোচনায় চেষ্টা করবো বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ব্যাক্তির সাথে আমরা কয়ভাবে আচরণ করি এবং সেই আচরণের মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী। আমরা জানার চেষ্টা করবো যৌক্তিক ‘না’ কীভাবে বলতে হবে, কীভাবে কারো কাছে কিছু অনুরোধ করতে হবে এবং অনুরোধ করে না পেলে কিভাবে তা সামলাতে হবে।

পারস্পরিক সম্পর্কে যে কোনো পরিস্থিতিতে আমরা ৩ভাবে আচরণ করি। তা হলো :

১. আক্রমণাত্মক আচরণ (Aggressiveness): এখানে ব্যাক্তি তার চাওয়া, পাওয়া, মতামত এবং অনুভূতিগুলো সততার সাথে প্রকাশ করে কিন্তু এটার জন্য অন্যকে প্রতিদান দিতে হয় খারাপভাবে। কারণ এখানে ব্যাক্তি বাজেভাবে তার অধিকার, মতামত, অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে গিয়ে অন্যের মতামত, অনুভূতিগুলোকে অসম্মান, অশ্রদ্ধা, অবহেলা এবং ছোট করে।

একটা উদাহরণ দেয়া যাক। আপনি হয়তবা কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত, তখন আপনার কোনো এক বন্ধু বা অন্য কেউ আপনাকে হয়তবা কোথাও ঘুরতে, বা একটু চা খেতে অফার করলো। তখন আপনি আপনার কাজের গুরুত্বটা বোঝানোর জন্য এমনভাবে রিয়েক্ট করলেন যে, এরপর থেকে ওই বন্ধু আপনাকে আর কখনো কোনো অনুরোধ করতে আসলো না। আপনি তার অনুরোধটা না রাখার যে কারণগুলো বলছেন সবগুলোই ঠিক ছিলো, কিন্তু আপনার বলার ধরনটা ছিলো উচ্চ স্বরে, রাগত স্বরে, আক্রমণাত্মক।

আপনার বন্ধু তার জায়গা থেকে ঠিক যে, সে তার বন্ধুকে অনুরোধ করতেই পারে। এটা তার অধিকারের মধ্যে পড়ে। আপনিও না করতেই পারেন যেটা আপনি করছেন, কিন্তু আক্রমণাত্মকভাবে। এখানে আপনি আপনার মতামত, অধিকার, অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আপনার বন্ধুর অনুভূতিকে অবজ্ঞা করেছেন। তাকে ছোট করেছেন।

এ ধরনের ব্যক্তিরা কখনো অন্যের প্রশংসা করে না। তাদের চেষ্টাই থাকে অন্যকে নিচে নামানো। কারণ কী এধরনের আচরণের? কারণ হলো ব্যক্তির মাথায় সবসময় এটাই থাকে যে, আমি ঠিক, তুমি ঠিক না… I am ok, you are not ok. তো যেহেতু তার চিন্তা চেতনায় বিরাজ করে- আমিই ঠিক, বাকিরা বেঠিক, তাই নিজের চিন্তা চেতনা বা অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য অন্যের অধিকারকে ভায়োলেট করাটা এদের স্বভাবের অংশ হয়ে যায়।

এ ধরনের আচরণের সুবিধা হলো- ব্যক্তি সাময়িকভাবে যা চায় তাই পায়। অসুবিধা হলো এতে করে তার শত্রু বাড়ে এবং বাকিরা তাকে এড়িয়ে চলে।

২. নিষ্ক্রিয় আচরণ (Passive behaviour ): এটা হলো আক্রমণাত্মক আচরণের উল্টোটা। এখানে ব্যক্তি অন্যের মতামত, অনুভূতি, অধিকার, চাওয়া-পাওয়ার গুরুত্ব দিতে গিয়ে নিজের অধিকার চাওয়া পাওয়া অনুভূতিকে জলাঞ্জলি দেয়। নিজের ভালোলাগা মন্দলাগা মুখে বলে প্রকাশ করতে পারে না। যেটাকে আমরা বলি বুক ফাটে তো মুখ ফাটে না।

অন্যের ইচ্ছার সাথে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া, না বলতে না পারা। মিনমিন করে, নমনম ভাবে কথা বলা। ‘না’ করার যথেষ্ট কারণ থাকলেও অপছন্দনীয় হওয়ার ভয়ে ব্যক্তি জোরালোভাবে ‘না’ বলতে পারে না। লোকজন তাকে ছেড়ে যাবে, সে একা হয়ে যাবে, নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না- এসব চিন্তা ভাবনা তার মাথায় ঘোরে। তারা চায় সবাই তাদের পছন্দ করুক। তাদের চিন্তা ভাবনার সামারি হলো- ‘তুমিই ঠিক আমি বেঠিক’। You are ok, I am not ok….

তো তুমিই যেহেতু ঠিক তাই তোমার সব কিছুই আমার কাছে ঠিক। কোনো কিছুতেই আমার না নাই।
সমাজে এ ধরনের অনেক মানুষ আছে যারা ‘না’ বলতে না পারার কারণে অনেক সমস্যায় পড়ে, জীবনে অনেক বড়ো দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এদের self esteem খুবই দূর্বল থাকে। এবং যেহেতু এরা এদের মনের সুখ দুঃখ, চাওয়া পাওয়া কারো সাথে শেয়ার করে না, সব কিছু মনে লুকিয়ে রাখে তাই পরবর্তীতে নানারকম মানসিক সমস্যা, যেমন- সোমাটোফরম ডিজঅর্ডারে ভোগে।

এদের অনেক multiple unexplained physical symptoms দেখা দেয় যেটার জন্য ডাক্তারগুলে খেলেও রোগ ভালো হয় না। কারণ তাদের সমস্যাটা শরীরে হলেও সমস্যার কারণ মনে। এই জন্য ডাক্তার যতই ঔষধ দিক কোনো কাজ হয় না। যতই পরীক্ষা নিরীক্ষা করুক সব কিছুই নরমাল। এরপর শেষ পর্যন্ত যখন মনোবিজ্ঞানীদের কাছে আসে তখন মনোবিজ্ঞানী বোতলের ছিপিটা খুলে দেয়, রোগী ফরফর ফরফর করে সারা জীবনের যত না বলা কষ্টের অভিজ্ঞতা সব বলতে শুরু করে এবং সমস্যাও ভালো হয়ে যায়।

৩. দৃঢ় আচরণ (Assertive behaviour) : Assertive এর প্রকৃত বাংলাটা কী হবে সেটা সঠিক জানা নেই, তবে দৃঢ়তাপূর্ন আচরণ হতে পারে। এখানে ব্যাক্তি নিজের চাওয়া পাওয়া, অনুভূতি, অধিকারগুলো সততার সাথে প্রকাশ করে অন্যকে কষ্ট না দিয়ে, অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ন না করে, অন্যকে ছোটো না করে। অর্থাৎ অন্যের অধিকার, অনুভূতিগুলোকে ব্যক্তি কনসিডার করেই নিজের মতামত প্রকাশ করে এবং নিজের জন্য যা করা দরকার সেটা করে। ব্যক্তির ব্যবহারে দৃঢ়ভাব থাকে, আক্রমণাত্বক ভাষা থাকে না। ব্যক্তি নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সহজেই ‘না’ বলতে পারে বাট এতে অন্যের চাওয়া পাওয়াকে অসম্মান করা হয় না। ব্যক্তির চিন্তা চেতনায় থাকে- ‘তুমি ঠিক, আমিও ঠিক’। You are ok, I am also ok…

Assertive ব্যক্তিদের কয়েকটি গুণাবলি :

১. এরা যেকোনো ঘটনার উভয় দিক দেখে। আমি দেখি 9 এটাও ঠিক, আমার বিপরীতে যে আছে সে দেখে 6, তারটাও ঠিক।
২. এরা অন্যের অধিকার এবং প্রয়োজনীয়তা চিনতে পারে।
৩. এরা নিজেদের একশন এর দায়িত্ব নিজেই নিতে পারে। বিফলের জন্য অন্যকে দোষারোপ করে না।
৪. এরা নিজের ভালোর জন্য অন্যকে ছোটো (put down) করে না।
৫. তারা সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করে।

এখন আমরা দেখবো কিভাবে অন্যকে কষ্ট না দিয়ে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ‘না’ বলা যায়।
how to say ‘NO’…

১. ভদ্রভাবে বলা।
২. যা বলার দৃঢ়ভাবে বলতে হবে।
৩. আঘাত করে কথা বলা যাবে না।
৪. অন্যের অনুভূতি চিনা এবং সম্মান করা।
৫. না বলার জন্য মিথ্যে কোনো (lame excuse) অজুহাত না দেয়া। সঠিক কারণটা দৃঢ়ভাবে বলা।
৬. সবসময় সম্মান প্রদর্শন করা।
৭. Eye contact, steady and firm voice maintain করা।

How to make request-কাউতে অনুরোধ যেভাবে করতে হবে :

১. যাকে অনুরোধ করবো তার অনুরোধ রাখার মতো অবস্থা আছে কিনা সেটা আগে যাচাই করা।
২. চোখে স্বাভাবিক চোখ রেখে প্রপার মুখভঙি করা।
৩. প্রয়োজনটা দৃঢ়ভাবে, পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করা।
৪. ভদ্রভাবে, সরাসরি এবং লজ্জাবোধ না রেখে বলা।
৫. তার প্রয়োজনীয়তাকেও সম্মান করা।
৬. এমন ভাব না করা ‘যেন যা চাইবো সেটা আমার পাওয়ার অধিকার আছে’। যেমনটা আমরা ব্যাংকে টাকা তোলার সময় করি।

How to Cope with Refusal-অনুরোধ করে না পেয়ে কিভাবে পরিস্থিতি সামলাবো :

১. ভদ্রতা বজায় রাখা।
২. ব্যক্তির প্রয়োজনীয়তাকে সম্মান করা।
৩. আঘাত দিয়ে কথা না বলা।
৪. সমালোচনা না করা যাতে পরবর্তীতে আবার অনুরোধ করতে আপনারই লজ্জা লাগবে।
৫. অনুরোধ করলেই পাব না, এই বাস্তবতা মেনে নেয়া।
৬. সুন্দরভাবে বিদায় নেয়া। ‘‘ও আচ্ছা, ঠিক আছে, অন্য সময়ে হবে তাহলে, এরকম বলা।’’

আসুন আমরা সবাই assertive হই। প্রয়োজনে ‘না’ বলি। অন্যের মতামতকে সম্মান করে নিজের মতামত প্রকাশ করি।

Be asseetive, practice asseetive and enjoy every relationship…

আরো পড়ুন…
নারীর মনোঃযৌন সমস্যা এবং কিছু ভুল ধারণা

পুরুষের মনোঃযৌন সমস্যা ও চিকিৎসা

মন খারাপ মানেই কি বিষণ্নতা?

আত্মহত্যা! কতগুলো বিলম্বিত প্রশ্নের হতাশাজনক উত্তর

লেখক
মেন্টাল হেল্থ এক্সপাট
এএসএফ- হল্যান্ড
সিয়েরা লিওন ও উজবেকিস্তান মিশন।

/এসএস/মনেরখবর/

Previous articleপেশা পরিবর্তন ,পেশাহীনতা, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
Next articleকার্ল সেগান : যিনি বিশ্বাস করতেন মহাবিশ্ব একটি মমতাপূর্ণ জায়গা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here