পুরুষের মনোঃযৌন সমস্যা ও চিকিৎসা

0
183

মনোবিজ্ঞানী, সিয়েরা লিওন

ক্ষুধা, তৃষ্ণাসহ অন্যান্য জৈবিক শারীরবৃত্তীয় চাহিদাগুলোর মতই যৌন চাহিদাও আমাদের জীবনে স্বাভাবিক এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা চাহিদা। প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেও যৌন চাহিদা বিদ্যমান। কিন্তু আমাদের কিছু কিছু ধর্মীয় গোঁড়ামী, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ নানা কৃষ্টি কালচারের কারণে যৌনতাকে খুবই নেতিবাচক গোপনীয় বিষয় হিসেবে আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়। যে জন্য আমরা খোলামেলাভাবে যৌনতা এবং যৌন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে লজ্জাবোধ করি।

যৌনতাকে খুব খারাপ এবং গোপনীয় একটা ব্যাপার বলে আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আর এ গোপনীয়তার সুযোগ নিয়ে যৌনতা নিয়ে একশ্রেণির মানুষ অপচিকিৎসার স্বীকার হচ্ছে। অদ্যাবধি আমাদের দেশে যৌনতার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ নাই। কোনোদিন হবে কিনা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

সমবয়সী বন্ধু বান্ধব, কবিরাজ, ফুটপাতের ক্যানভাসার, পর্নোগ্রাফী ছবি, বই, বাসের জানালা দিয়ে ছুড়ে মারা লিফলেট ইত্যাদির মাধ্যমেই আমরা যৌনতা সম্পর্কে অনেকসময়ই অপশিক্ষা লাভ করি।

যৌনতা নিয়ে এরকম suppression এর কারণেই আমাদের দেশে ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ছে কারণ মনোবিজ্ঞানীদের মতে যেটা আমরা নেতিবাচকভাবে মনে অবদমিত করে রাখবো সেটা বিভিন্ন নেতিবাচকভাবে প্রকাশিত হবে।

যেহেতু আমাদের দেশে যৌনতা নিয়ে স্বাভাবিক আলোচনা হয় না তাই কারো কোনো যৌন সমস্যা হলেও আমরা সেটা বুঝতেই পারি না। লুকিয়ে লুকিয়ে অপচিকিৎসা করে আরো বিষয়টাকে জটিল করে ফেলি। আমাদের মধ্যে সাধারণত দুইটা কারণে যৌন সমস্যা দেখা দিতে পারে। যথা :

১. Primary sexual problems : এটা শারীরিক বা মেডিক্যাল সমস্যার কারণে হয়ে থাকে যেটার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়। যেমন STD, STI ইত্যাদি।

২. Secondary sexual Problem : নন মেডিক্যাল বা মানসিক কারণে এ সমস্যা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বেশীরভাগ যৌন সমস্যা হল Secondary sexual problems. মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে মনোঃযৌন সমস্যা বা Psychosexual dysfunction (PSD) বলা হয়। আর এটার অন্যতম একটা কারণ হলো যৌনতা সম্পর্কে কুসংস্কার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান থেকে পরিচালিত একটা গবেষণায় (Mozumder K. and Rahman M 2004) দেখা যায় যে বাংলাদেশের ৯২% মানুষের মধ্যে যৌনতা সম্পর্কে নানারকম কুসংস্কার এবং বিশ্বাস রয়েছে। আর এ কুসংস্কারের কারণে যৌন সমস্যাগুলো বেশি দেখা দেয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মনে করা হয় শুধু পুরুষদের মধ্যেই যৌন সমস্যা দেখা যায়। কিন্তু ধারণাটি একদমই অমূলক। নারীদের মধ্যেও যৌন সমস্যা দেখা দেয় প্রবলভাবে। এমনকি এসমস্ত সমস্যার পিছনে শারীরিক কোনো কারন থাকে না। তার মানে শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ ফিট হওয়া সত্ত্বেও কোনো একজন নারী বা পুরুষ যৌনজীবন উপভোগ নাও করতে পারে।

আজকে এখানে পুরুষদের মনোঃযৌন সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করবো। পরবর্তী লেখায় নারীদের মনোঃযৌন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবো ইনশা আল্লাহ।

পুরুষদের মনোঃযৌন সমস্যাগুলো : 

1. Impaired Sexual Interest (যৌন আকাংক্ষার অভাব) : এখানে পুরুষদের মধ্যে যৌন উত্তেজনা আসে এবং যৌন সুখ লাভ করেন কিন্তু তাদের যৌন কাজের প্রতি আগ্রহ তীব্রভাবে কমে যায়। নিজের মধ্যে যৌন আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণে সঙ্গীর সব ধরণের যৌন আবেদন বা আচরণ তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করে এবং পুরুষ নিজে উদ্যোগী হয়ে কখনো সঙ্গীর সাথে যৌনতায় লিপ্ত হয় না।

কিছু কিছু পুরুষ সঙ্গীর সাথে যৌনতায় আগ্রহ না পেলেও Masturbate করে যৌন সুখানুভূতি লাভ করে। অনেক নারী অভিযোগ করে থাকেন যে, তাদের স্বামী তাদের সাথে যৌন মিলন না করলেও তাদের সামনেই হস্তমৈথুন করে। একজন নারী এ ধরণের আচরণ কখনোই মেনে নিতে পারে না এবং এতে করে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ শুরু হয় যেটা অন্যান্য ছোটোখাটো বিষয় দিয়ে প্রকাশিত হয়।

স্বামী স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক কলহ, ঝগড়াঝাঁটি, বিষন্নতা, সঙ্গীর প্রতি সন্দেহবাতিকতা ইত্যাদি কারণে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।

2. Erectile Dysfunction : DSM- 5 (Diagnostic and Statistical Manual for mental disorders) এর মতে সঙ্গীর সাথে যৌনসহবাস করার জন্য বা যোনীপথে লিঙ্গ প্রবেশ করানোর জন্য লিঙ্গ প্রয়োজনীয় পরিমান শক্ত হয় না।

Foreplay (যৌন আদর) করার পরও তাদের লিঙ্গ শক্ত হয় না, অথবা হলেও যোনিতে লিঙ্গ প্রবেশ করানোর সময় লিঙ্গটা নেতিয়ে বা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এতে করে লিঙ্গ যোনীতে ঢুকে না। অথবা ঢুকাতে পারলেও বীর্য বের (Ejaculate) হওয়ার আগেই লিঙ্গ নিস্তেজ হয়ে যায়।

ফলাফল, সঙ্গীকে চূড়ান্ত যৌন সুখ দিতে পারে না। ৭-১৮% পুরুষদের মধ্যে জীবনে কোনো না কোনো সময়ে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটাকেই মূলত Impotance বা পুরুষত্বহীনতা বলা হয়।

Childhood abuse অথবা Sexual trauma, দীর্ঘ মেয়াদি চাপ, সঙ্গীকে যৌনসুখ না দিতে পারার অপরাধবোধ, বিষন্নতা, দাম্পত্য কলহ ইত্যাদি কারণে Erectile dysfunction হতে পারে।

পড়ুন…
নারীর মনোঃযৌন সমস্যা এবং কিছু ভুল ধারণা

3. Premature Ejaculation (দ্রুত বীর্যপাত) : Masters & Jhonson, sex therapist (1970) এর মতে পুরুষদের মধ্যে এটা খুবই কমন সমস্যা। এখানে যৌন আদরের কারণে পুরুষদের লিঙ্গ উত্থিত হয় কিন্তু যৌন সহবাসের নিমিত্তে নারীর যোনিপথে লিঙ্গ প্রবেশ করানোর পরপরই বীর্য বের হয়ে যায়।

সময়ের হিসেবে বললে ১ মিনিটের ও কম সময়ের মধ্যে Orgasm হয়ে যায়। যদিও যৌনসঙ্গমের নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নাই তবুও যদি দ্রুত বীর্যপাত হয়ে যায় তাহলে সঙ্গীর মনে হতে পারে যৌনসুখের সময়টা খুবই ক্ষনস্থায়ী ছিল বা পরিপূর্ণ/চূড়ান্ত সুখ লাভ করতে পারেনি।

এরকম দ্রুত বীর্যপাত নারী এবং পুরুষ দুজনের জন্যই চরম লজ্জাকর ও হতাশাজনক হতে পারে। ৩০-৪০% পুরুষের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এ সমস্যা হতে পারে। তবে DSM-5 অনুযায়ী কারো মধ্যে এ সমস্যাটা ৬ মাস ধরে থাকলে ডাক্তার অথবা চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হওয়া দরকার।

যদি এ সমস্যার সঠিক কারন এখনো অজানা তবুও মানসিক চাপ, বিষন্নতা, দুশ্চিন্তা, সঙ্গীকে সুখি করতে না পারার জন্য guilt feelings, নিজের শরীরের ইমেজ নিয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাব, যৌন সহবাসের সময় সম্পর্কে ভুল ধারণা ইত্যাদি কারণে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।

4. Retarded Ejaculation (বিলম্বিত বীর্যপাত) : DSM-5 এর মতে এটা পুরুষের এমন একটি সমস্যা যেখানে দীর্ঘক্ষন যৌনসঙ্গম করার ফলেও বীর্যপাত করতে পারে না বা বীর্যপাত হয় না। এমনকি ২৫/৩০ মিনিট পরেও বীর্যপাত হয় না। এতে করে পুরুষ কখনও ক্লাইমেক্স বা চরমপুলক লাভ করে না। ঐ দিকে সঙ্গীর orgasm হয়ে resolution (শারীরিক স্বাভাবিক অবস্থা) পর্যায় শুরু হয়ে যায়। কিন্তু পুরুষের বীর্যপাত না হওয়ায় বা খুবই দেরিতে হওয়ার কারণে নারী সঙ্গীর অবস্থা তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হয়ে যায়।

এ অবস্থা যদি কোন পুরুষের মধ্যে ৬ মাসের বেশি সময় ধরে থাকে তাহলে DSM-5 অনুযায়ী এটা Sexual Disorder বা Delayed Orgasm (DO) বলা হয়। যেটার জন্য মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা জরুরি। এ সমস্যার কারণে অনেক নারী বিবাহবিচ্ছেদ ঘটায়। কিন্তু এটার চিকিৎসা করলে সুফল পাওয়া যায়।

5. Sexual Aversion (যৌন বিতৃষ্ণা বা বিরাগ) : এখানে পুরুষের মধ্যে যৌন কাজের প্রতি মারাত্মক অনীহা চলে আসে। যৌন কাজের বা যৌন সঙ্গমের প্রতি অনীহাটা ঘৃণা, অপমান, লজ্জা এবং আত্মসম্মানের সাথে জড়িত থাকে।

এ বিতৃষ্ণা বা অনীহা যেকোনো স্পেসিফিক কাজ যেমন ওরাল সেক্স অথবা যৌনিতে লিঙ্গ ঢুকানো নিয়ে হতে পারে, এটা হতে পারে বীর্যের গন্ধ, চুমো দেয়ার সময় লালার গন্ধের প্রতি। এটা হতে পারে সঙ্গীর যৌন অঙ্গ যেমন স্তন বা যোনির প্রতি। এটা হতে পারে যৌন সঙ্গম করার সময় সঙ্গীর বিভিন্ন শব্দ বা চিতকারের প্রতি।

যৌন বিরাগ পুরো যৌন কাজের প্রতিও (generalized) হতে পারে আবার হতে পারে নির্দিষ্ট একটা কাজের প্রতি (Situational)। যেমন কোনো পুরুষ হয়তোবা শুধু যৌন সঙ্গম করতে পছন্দ করে, কিন্তু যৌন আদর (foreplay) যেমন চুমু দেয়া, স্তন ঘর্ষন করা, যোনিতে চুমু দেয়া ইত্যাদি পছন্দ করে না।

অনেক নারী অভিযোগ করে থাকেন তাদের সঙ্গী কোনোরকম শারীরিক অন্য আদর ছাড়া লিঙ্গ যোনিতে প্রবেশ করিয়ে দেন। হাত না ধুয়ে ভাত খাওয়ার মত অবস্থা। কোনো পুরুষের মধ্যে এ সমস্যা থাকলে সেটা তাদের সঙ্গীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্কটা খারাপ করে দিতে পারে।

তাদের রোমান্টিক রিলেশন বা ভালো যৌন সম্পর্ক হয়ে উঠে না। সম্পর্কটা তখন কেবল একটা অভ্যাসে পরিনত হয়।

DSM-4 TR মতে এ অবস্থা যদি কারো মধ্যে ৬ মাস চলতে থাকে এবং এর জন্য যদি তাদের বৈবাহিক সম্পর্কে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পেলে তাহলে এটা Sexual Aversion Disorder (SAD). তবে DSM-5 এ এটাকে সংযুক্ত করা হয় নি।

এটাও পড়ুন…
আত্মহত্যা! কতগুলো বিলম্বিত প্রশ্নের হতাশাজনক উত্তর

চিকিৎসা : 

আমাদের দেশে যেহেতু যৌন সমস্যা বা রোগ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয় না, তাই অনেকেই অপচিকিৎসার ফাঁদে পড়ে। বাংলাদেশের হার্বাল কোম্পানিগুলোর লোভনীয় ও আকর্ষনীয় বিজ্ঞাপন, ২৪ ঘন্টায় সমাধানের নিশ্চয়তা প্রদানের লোভে অনেকেই প্রতারিত হন। অনেকেই পাশের ফার্মেসির বন্ধু থেকে ঔষধ নিয়ে সেবন করেন।

এসব হার্বাল বা ঔষধ প্রাথমিকভাবে একটু সন্তোষজনক ফলাফল দিলেও দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব অনেক। যার কারণে যৌনজীবন পুরোটাই শেষ হয়ে যেতে পারে। তাই কারো মধ্যে উপরোক্ত যৌন সমস্যাগুলো দেখা দিলে সরাসরি ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া দরকার।

আপনি যদি নিশ্চিত থাকেন আপনার বা আপনার সঙ্গীর যৌন সমস্যাটা শারীরিক কোনো কারণে নয়, তাহলে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীদের সাথে দেখা করুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীদের আলাদা ভাবে Sex therapy এর উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে।

যারা এ সব সমস্যার কারণে বিভিন্ন অপচিকিৎসা করে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পান নাই, তারা সরাসরি চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীদের কাছে যেতে পারেন।

বলা হয়ে থাকে একজন স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যতই সমস্যা থাকুক, মতের অমিল থাকুক, চাওয়া পাওয়া না মিলুক, কিন্তু দিন শেষে তাদের মধ্যে চমৎকার একটা রোমান্টিক যৌন সম্পর্ক বাকি সব সমস্যাকে গৌন করে দিতে পারে।

যৌন সম্পর্ক শুধুই শারীরিক নয়, মানসিকও। তাই আপনাদের মধ্যে কারো যৌন সমস্যা থাকলে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীর সহযোগিতা নিন, যৌনজীবন উপভোগ করুন। জীবনকে উপভোগ করুন।

লেখক :
মো. আকবর হোসেন, মনোবিজ্ঞানী
এমএসএফ- হল্যান্ড, সিয়েরা লিওন মিশন।

  • মনের খবর অনলাইনে লিখতে পারেন আপনিও। মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক যেকোনো লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদেরকে। আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলেও আমাদের লিখতে পারেন। সমস্যার বিস্তারিত লিখুন। উত্তর দিবেন বিশেষজ্ঞগণ। লেখা পাঠাবেন monerkhaboronline@gmail.com এই ঠিকানায়।

/এসএস/মনেরখবর/

Previous articleআমি বাইপোলারে আক্রান্ত, ঔষধ খাচ্ছি কিন্তু এখন ডিপ্রেশন হচ্ছে
Next articleঢাবিতে চলছে ‘পজিটিভিটি এন্ড হ্যাপিনেস’ ওয়ার্কসপের রেজিস্ট্রেশন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here