স্ব-উত্তেজক আচরণ ও অটিজম

স্ব-উত্তেজক আচরণ ও অটিজম

Stimming Behaviour বা স্ব-উত্তেজক আচরণ অটিজম সম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর মানে এই না যে এই বিষয়টি সবসময় অটিজমের সাথে সম্পর্কিত হবে।

এই স্ব-উত্তেজক আচরণ ভালো নাকি খারাপ, এটা শিশুর বৈশিষ্ট্য থেকে বিতারিত করা উচিত নাকি উচিত না, কিভাবে এটা নিত্যদিনের ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা যায়, এগুলো নিয়েই আজকের এই লেখা।

স্বউত্তেজক আচরণ (Stimming Behaviour) কি?

আমাদের শরীরের সংবেদনশীল অঙ্গের (Sensory organs) উদ্দীপনা জনিত কারণে কোনো আচরণের বার বার পুনরাবৃত্তি করাকে স্ব-উত্তেজক আচরণ বা Stimming Behaviour বলে।

Stimming Behaviourএর বৈজ্ঞানিক কারণ

কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাইরের পরিবেশ থেকে পাওয়া প্রভাবক বা আবেগ জনিত কারণে যখন স্নায়ুতন্ত্র প্রভাবিত হয়, তখন মস্তিষ্ক থেকে এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়। এই রাসায়নিক পদার্থটি বিটা-এন্ডোরফিনস নামে পরিচিত। বিটা-এন্ডোরফিনস কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে (Central Nervous System) ডোপামিন তৈরি করে।যা শারিরীক সংবেদনশীলতা বা উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে।

আবার কিছু গবেষকরা বলেছেন যে Stimming শারিরীক সংবেদনশীলতার সিস্টেমকে উদ্দীপনা দিয়ে, শিশু বা ব্যক্তির সংবেদনশীলতার অভাবকে (Sensory need) পূরণ করতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন, Stimming তাদের শান্ত হতে সাহায্য করে। কারণ এই আচরণ তাদের মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করে এবং আশেপাশের অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে নেয়।

অটিজমের সাথে সম্পর্কিত এ ধরনের উদ্দীপনা সর্বদা উদ্বেগের কারণ না। স্ব-উত্তেজক আচরণ অটিজম সম্পন্ন মানুষকে স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারে। এগুলো তীব্রতা এবং প্রকারভেদে পরিবর্তিত হয় এবং বিভিন্ন আবেগের কারণে ঘটতে পারে। এই আচরণ অটিজম সম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের সুখ, দুঃখ, উদ্বেগ, রাগ, ভয় এবং একঘেয়েমির মতো আবেগগুলোকে পরিচালনা করতে সহায়তা করে।

Stimming Behaviourএর প্রকারভেদ

অটিজম সম্পন্ন মানুষের শারিরীক সংবেদনশীলতার (Sensory need) উপর নির্ভর করে Stimming Behaviour -কে নিম্ন লিখিত উপায়ে ভাগ করা হয়েছে:

শ্রবণজনিত উত্তেজক (Auditory stimming)

শ্রবণজনিত উত্তেজক ব্যক্তির শ্রবণশক্তি এবং শব্দের বোধকে প্রভাবিত করে। এর মধ্যে নিম্নের আচরণগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে: আওয়াজ করা, যেমন গুনগুন করা, কর্কশ, বা উচ্চ কম্পাঙ্কে আওয়াজ করা, যেকোনো বস্তু বারবার হাত দিয়ে বাড়ি দেওয়া, হাত দিয়ে কানে বাড়ি দেওয়া, আঙুলে তুড়ি বাজানো, পুনরাবৃত্তিমূলক বক্তৃতা যেমন গানের কথা, বইয়ের বাক্য বা সিনেমার লাইন পুনরাবৃত্তি করা ইত্যাদি।

ভেস্টিবুলার উত্তেজক (Vestibular stimmimg)

ভেস্টিবুলার উদ্দীপনা কোনও ব্যক্তির চলন এবং ভারসাম্য বোধকে প্রভাবিত করে। এর মধ্যে যা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে: বসে বা দাঁড়িয়ে সামনে-পিছনে বা পাশাপাশি দোল খাওয়া, আপন মনে ঘুরতে থাকা বা লাফাতে থাকা, আপন মনে সামনে পিছনে হাঁটতে বা দৌঁড়াতে থাকা ইত্যাদি।

দৃষ্টিজনিত উত্তেজক (Visual stimming)

দৃষ্টিজনিত উত্তেজক কোনও ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তিকে প্রভাবিত করে। এর মধ্যে যেই পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে তা হলো: সিলিং ফ্যান বা লাইটের মতো বস্তুগুলোর দিকে আপন মনে তাকিয়ে থাকা, আঙুল দিয়ে নিজের চোখের কোণায় চাপ দিয়ে লাইটের দিকে তাকিয়ে থাকা, দরজা খোলা এবং বন্ধ করা বা সুইচ অন অফ করা, চোখের সামনে আঙুলের বা হাতের নাড়াচাড়া, কোনো বস্তুর ঘূর্ণন দেখতে থাকা ইত্যাদি।

স্পর্শকাতর উত্তেজক (Tactile stimming)

স্পর্শকাতর উত্তেজক ব্যক্তির স্পর্শকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ: হাত বা যেকোনো বস্তু দিয়ে ত্বক-ঘর্ষণ বা স্ক্র্যাচ করা, পাখির ডানার মতো হাতের নড়াচড়া, হাতের মুঠি খোলা-বন্ধ করা, যেকোনো কিছু দাঁতে বাড়ি দেয়া, নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা ইত্যাদি।

ঘ্রাণ স্বাদজনিত উত্তেজক (Olfactory & Gustatory stimming)

ঘ্রাণ ও স্বাদজনিত উত্তেজক ব্যক্তির গন্ধ এবং স্বাদ বোধকে প্রভাবিত করে। এগুলোর মধ্যে যা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে: মানুষের চুলের বা শরীরের বা যেকোনো বস্তুর গন্ধ নেওয়া, যেকোনো বস্ততে জিহ্বা লাগানো, মুখের মধ্যে রেখে বস্তুর স্বাদ গ্রহণ ইত্যাদি।

Stimming Behaviour কীভাবে অটিজম সম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে?

আমাদের সবারই মাঝে মাঝে স্ব-উত্তেজক আচরণ হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যখন কোনো সমস্যা বা উত্তেজনা নিয়ে কাজ করি তখন কেউ কেউ পা ঝাঁকুনি দেই, আবার কেউ কেউ কলম বা নখ চাবাতে থাকি, কেউ হয়তো পায়চারী করতে থাকি, কেউ নিজের সাথে বিড়বিড় করে কথা বলতে থাকি, আবার কেউ বা চুল আঙুলে পেঁচাতে থাকি। এটা এমন একটি অভ্যাস, যা আমাদের শরীর থেকে তৈরী হচ্ছে নিজের অবচেতন মনে।

অটিজম সম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের মধ্যে এই উদ্দীপনাগুলো আরও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। কারণ তারা এই আচরণগুলো বারবার পুনরাবৃত্তি করে ও দীর্ঘ সময় ধরে করে। কেউ Stimming জনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে, তা খারাপভাবে নেয়ার কিছু নেই।

তবে কিছু কিছু সময় স্ব-উত্তেজক আচরণ স্ব-ক্ষতিকারক হতে পারে। যখন তা নিজেকে বা অন্যকে আঘাত করার মাধ্যমে প্রকাশ পায় বা কোনো শিশু বা ব্যক্তির শিখন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। Stimming বাইরের জগতের প্রতি অটিজম সম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের মনোযোগকে প্রভাবিত করতে পারে। যা তাদের শিখন প্রক্রিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতাকে প্রভাবিত করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো শিশু Stimming করতে থাকে, তবে সে তার আশেপাশে ঘটতে থাকা ঘটনার প্রতি উদাসীন থাকে। ফলে অনুকরণীয় শিক্ষা বা পরিবেশগত শিক্ষা গ্রহণে মনোনিবেশ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। দক্ষতার বিকাশ সেখানে বাধাগ্রস্ত হয়।

যখন শিশুটি বড় হয়, সে যদি শ্রেণিকক্ষে Stimming -এ মগ্ন থাকে তবে সে স্কুলের কাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে বাধার সম্মুখীন হয়। যদি শিশুটি খেলার মাঠে বেড়ার চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে তাহলে সে অন্যদের সাথে মূল্যবান সামাজিক দক্ষতা বিকাশের সুযোগগুলো থেকে বঞ্চিত হয়।

ব্যাপারে কি করা যায়?

Stimming একেবারে বন্ধ করতে চাইলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই এটা বন্ধ করার চেষ্টা না করে তার Stimming কে অর্থবহুল করে তুলতে হবে। যেন সে তার ঐ আচরণকে কাজে লাগিয়েই নতুন কিছু শিখে ফেলতে পারে। একটি বিকল্প আচরণ শিখানো যায়, যা একই চাহিদা মেটাতে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ: পাখির ডানার মতো হাতের নড়াচড়া স্যান্ড বল বা অন্যান্য সূক্ষ মোটর ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে।

Stimming হওয়ার কারণগুলো খুঁজে বের করে, সেই কারণগুলো যেন তার সামনে না ঘটে সেই ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে হবে। ডাক্তার, পেশাগত থেরাপিস্ট, শিক্ষাবিদ এবং অন্যান্য আচরণগত বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করতে হবে। উত্তেজনার পিছনে কারণগুলো নির্ধারণ করতে তারা অটিজম সম্পন্ন মানুষটিকে মূল্যায়ন করে তার সঠিক ব্যবস্থাপনা গ্রহণে সাহায্য করবেন।

Positive Reinforcement ব্যবহার করে, তার Stimming শুরু হওয়ার সাথে সাথে মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে ফেলতে হবে। কখনো কখোনো কিছুই কাজ না করলে Stimming করতে দিন এবং তার এই আচরণ এমনভাবে এড়িয়ে যান, যেন সে বুঝতে পারে যে তার আচরণ কোনোভাবেই আপনাকে প্রভাবিত করছে না।

Stimming যখন নিজেকে আঘাত করার মাধ্যমে প্রকাশ পাবে তখন তাকে এড়িয়ে চলা যাবে না। তখন তার সাথে বসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার সাথে কথা বলতে হবে এবং তাকে সান্তনা দিতে হবে। এক্ষেত্রে এড়িয়ে চললে তার বড় ধরণের শারিরীক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। প্রতিদিন নিয়মিত একটি রুটিন মেনে চলতে হবে। একটি উপযুক্ত রুটিন যেকোনো মানুষের উদ্বেগ হ্রাসের সহায়ক। গ্রহণযোগ্য আচরণ এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণকে উৎসাহিত করতে হবে।

শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। যদি আপনি এর পেছনের কারণগুলোকে সম্বোধন না করে একটি স্ব-উত্তেজক আচরণকে বন্ধ করে দেন। তবে এটি অন্য আরেকটি স্ব-উত্তেজক আচরণের সাথে প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনা আছে, যা ভালো নাও হতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থায়ও তাদের আচরণগত ব্যবস্থাপনা অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।

স্ব-উত্তেজক আচরণ অটিজম সম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের পরিস্থিতি অনুসারে হ্রাস ও বৃদ্ধি পেতে পারে। অনেক সময় শিশুদের বেড়ে উঠার সাথে সাথে এই আচরণগুলোর পরিবর্তন হয়। তবে অতিরিক্ত চাপের মুখে এগুলো আরও খারাপ হয়ে উঠতে পারে।

ভালোবাসা, ধৈর্য এবং বোধগম্যতার সাথে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে চললে অটিজম সম্পন্ন অনেকেই স্ব-উত্তেজক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে পারে। সময়ের সাথে সাথে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অর্জন স্কুল, কর্মক্ষেত্র এবং সামাজিক পরিস্থিতিতে তাদের জীবনের মানের উন্নয়ন ঘটাতে পারে।

ডা. আইরিন বিনতে আজাদ

জেনেরেল ফিজিশিয়ান (এমবিবিএস)

প্যারেন্ট এডুকেটর, কিডিরকস স্পেশাল স্কুল

সার্টিফাইড প্যারেন্টিং কোচ (ডেভেলপমেন্টাল, ইফেক্টিভ এ্যান্ড এনকারেজিং প্যারেন্টিং, ভারত)

Previous articleআমার ২ বছর আগে ব্রেকাপ হয়
Next articleইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here