সঠিক মূল্যবোধের অভাবেই মাদকাসক্তে পরিণত

সঠিক মূল্যবোধের অভাবেই মাদকাসক্তে পরিণত

আসক্তি বা মাদকাসক্তি একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়ে থাক। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন আসক্ত ব্যক্তির মানসিক, শারীরিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষতি সাধিত হয়। সঠিক মূল্যবোধই পারে মাদকাসক্তির মতো ভয়াবহ একটি ব্যধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে।

মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে দোষারোপ করার আগে সেই ব্যক্তির পরিবারে এবং তার জীবনে মূল্যবোধের অভাব অবশ্যই লক্ষণীয়। সঠিক মূল্যবোধের অভাবই একজন ব্যক্তিকে মাদকের দিকে ঠেলে দেয়। তাই শৈশব থেকেই শিশুকে সঠিক মূল্যবোধ শিক্ষা দিন, সেগুলোর পরিচর্যা করুন। যাতে শিশুটি শারীরিক এবং মানসিকভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উচ্চতর মূল্যবোধে শিক্ষিত হয়ে নিজের জীবন পরিচালনা করতে পারে।

একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির সামগ্রিক সুস্থতার জন্য সঠিক মূল্যবোধ চর্চা করার বিকল্প নেই। মূল্যবোধ চর্চার ফলে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির জীবনে যেসব গুনগুলো পরিলক্ষিত হয় তা হলো-

মাদক মুক্ত জীবনের জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে শেখে, সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে, ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রাম নেয়, ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে, চারিত্রিক দুর্বলতাগুলি (ঈর্ষা, হিংসা, লোভ,মিথ্যে প্রভৃতি) নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে, ভদ্র ও বিনয়ী হতে শেখে।

নিজের বিবেককে জাগ্রত করতে শেখে, সৃষ্টিকর্তার সাথে তার সংযোগ বৃদ্ধি পায় অর্থাৎ ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলে, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়ন করতে শেখে।

মাদকাসক্তি প্রতিরোধে আমাদের করণীয়ঃ

মানুষের নৈতিক স্খলন হওয়ার কারণে মাদক এবং মাদকাসক্তি গোটা বিশ্বকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। একটি দেশের উন্নয়ন, সেই দেশের তরুণ সমাজের মেধাকে আমরা কিভাবে ব্যবহার করতে পারি, তার উপরে অনেকখানি নির্ভর করে। মাদক বিলীন করে দিচ্ছে মানুষের মনুষ্যত্বকে, দেশ ও জাতি হয়ে পড়ছে মেধাশূন্য।

প্রত্যেক মানুষই কিন্তু মেধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। অথচ সেই মেধাকে ব্যবহারের কার্যপ্রণালীতে কালো প্রলেপ মেখে দিয়েছে ভয়াবহ মাদক। কাজেই স্বনির্ভরশীল বিশ্ব তথা বাংলাদেশকে উন্নয়নের মানদণ্ডে প্রথম সারিতে নিয়ে আসতে মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার বিকল্প নেই।

মাদকের এই ভয়াবহতা একদিনে আসেনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, কৃষ্টি-কালচার চর্চার প্রতিবন্ধক হিসেবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে মাদক বিরাজ করছে। তাই মাদকাসক্তি প্রতিরোধে মানুষের নৈতিক শিক্ষা অতীব জরুরী। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক পাঠ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার জন্য আলাদা অধ্যায় ভিত্তিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা থাকলেও তার চর্চা হয় না বললেই চলে।

মাদকাসক্তি রোধে সরকার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে সাথে নিয়ে এবং বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় দেশে মাদক নির্মূলের জন্য নানাবিধ সফল কর্মসূচি পালন করছে। বিভিন্ন জেলায় সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রসমূহে নামমাত্র মূল্যে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হয়ে থাকে। তবে এদের সংখ্যাটা অতি নগন্য।

ইদানীংকালে ব্যক্তি পর্যায়ে পরিচালিত মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন সংস্থাগুলোর ভূমিকাও অত্যন্ত প্রশংসনীয়। নিজেকে এবং সমাজকে মাদকমুক্ত রাখার মহান ব্রত গ্রহণ করেছেন তারা। ব্যক্তিগত পর্যায়ে উদ্যোগ নিয়ে কিছু ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে এসব মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুর্নবাসন সংস্থাগুলোতে কাজ করে যাচ্ছেন।

একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে মাদকের প্রভাব থেকে মুক্ত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা চাট্টিখানি কথা নয়। এজন্য প্রচুর মেধা, শ্রম এবং ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। নানাবিধ সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি সংস্থাই পেরেছে এ সফলতা অর্জন করতে। আর্থিক সমস্যার পাশাপাশি দক্ষ জনবলের তীব্র সংকটের কারণে এসব বেসরকারি সংস্থাগুলোকে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে শারীরিক ও মানসিক সকল বাধা অতিক্রম করার কর্মপন্থা শেখানো হয়। যাতে মাদকাসক্ত ব্যক্তি মাদকমুক্ত হয়ে পরিবারের বোঝা না হয়। একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজের, পরিবারের, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে।

ভাবতে অবাক লাগলেও অনেক উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী শুধুমাত্র মাদক গ্রহণ করার ফলে তার উচ্চশিক্ষাকে নিজের এবং দেশের কাজে নিয়োজিত করতে পারে না। এসব শিক্ষিত যুবক যখন মাদক নির্ভরশীলতা দূরীকরণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আসে, অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কর্মের অভাবে তারা নিজেরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পরে।

তাই একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে উচ্চতর মূল্যবোধের শিক্ষার পাশাপাশি তাকে উন্নত জীবনযাপনে সহায়তা করতে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে যোগ্যতা অনুযায়ী যে কোন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেও কিন্তু সরকার ও বিভিন্ন সংস্থাগুলো অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।

আপনার সন্তানকে মাদকাসক্ত হতে দূরে রাখতে আপনার করনীয়ঃ

সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করুন, আপনার সন্তানের সম্পর্কে জানুন কোথায় যায়, কার সাথে মিশে লক্ষ্য রাখুন, তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করুন, তাকে মাদকের কুফল সম্পর্কে শিক্ষা দিন।

কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তার নিজস্ব যোগ্যতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করুন, সন্তানকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলুন, পারিবারিক এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে তার নিজের সক্ষমতা বুঝতে সহায়তা করুন এবং উৎসাহ দিন, অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করতে সাহায্য করুন।

একজন সুস্থ সবল এবং উচ্চতর মুল্যবোধ সম্পন্ন সুনাগরিক সন্তানই আপনার নিজের, পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য মুল্যবান সম্পদ। সবার আগে আপনাকে আপনার নিজেকে চিনতে হবে। একজন অভিভাবক হিসেবে আপনি কেমন? আপনার মূল্যবোধ সঠিক কিনা তা জানুন এবং বুঝুন।

আপনি যা কিছু করছেন সে সবকিছুই কিন্তু শিশুরা অনুকরণ করে প্রতিনিয়ত। আপনি হয়তো মাদক গ্রহণ করেন না ঠিক আছে, তবে আপনার অপ্রয়োজনীয় কিছু বদঅভ্যাস আর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই কিন্তু আপনার সন্তানকে মাদকের দিকে আকৃষ্ট করতে সাহায্য করে।

শিশুর চারিত্রিক মূল্যবোধ শিক্ষা প্রথম আসে তার পরিবার থেকে। তাই পরিবারের মানুষদের নিজেদেরকে আগে সচেতন হতে হবে। নিজের আচার-ব্যবহার, নৈতিকতা, চারিত্রিকতা, সৎ মন-মানসিকতা এসবের সঠিক গঠন এবং জীবনযাপন প্রণালীতে সেসবের বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আপনার সন্তানের মেধা আর মননশীলতা বিকশিত হয়।

তাই মাদক প্রতিরোধে ব্যক্তিজীবনে মূল্যবোধের গুরুত্ব সম্পর্কে জানুন এবং পরিবারে আপনার সন্তানকে উচ্চতর মূল্যবোধের শিক্ষা দিন। নিজে মাদককে না বলুন, অন্যকেও সচেতন করুন।

Previous articleটেকসই উন্নয়নে মানসিক স্বাস্থ্য
Next articleএকাকীত্ব দূর করতে করণীয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here