একাকীত্ব দূর করতে করণীয়

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে সব থেকে সহজ উপায়

সবার মাঝেই এই ধারণা প্রচলিত আছে যে একাকীত্ব থাকা মানেই সবার থেকে দূরে একা বসবাস করা এবং একা থাকার কারণেই শুধুমাত্র মানুষ একাকীত্ব নামক মানসিক সমস্যায় ভোগে। কিন্তু এই ধারণাটি খুবই ভ্রান্ত একটি ধারণা এবং একাকীত্ব দূর করতে কি কি করণীয় সেটি নিয়ে আজ আলোচনা করব।

আমরা সবাই কোন না কোন সময়ে একাকীত্বের সমস্যায় ভুগেছি। আমাদের ব্যক্তিত্ব যেমন আলাদা আলাদা তেমনি একাকীত্ব সম্বন্ধীয় আমাদের মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতাও আলাদা আলাদা।

অনেকেই একাকীত্বকে কেবল একটি ধারণা বা অবস্থা হিসেবে পরিগণিত করার ভুল করেন। ভাবেন যে একাকীত্ব হল সোজা সাপটা ভাবে মানুষের একা থাকা। যারা অন্যদের থেকে দূরে থাকেন বা একা থাকেন তারাই একাকী। আর যারা পরিবার নিয়ে বসবাস করেন, যাদের আশেপাশে লোকজন রয়েছে তারা একাকী নয়। মানুষের মাঝে প্রচলিত এই ধারণাটি একেবারেই সঠিক নয়।

প্রকৃতপক্ষে একাকীত্ব হল একজন মানুষের মধ্যে অনুভূত মানসিক চাপ বা অস্বস্তি যা বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্কের প্রতি তার প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মধ্যে তৈরি হওয়া দূরত্ব থেকে উদ্ভূত হয়।

কিছু একাকীত্বের অনুভূতি খুব সহজভাবে মানুষের সাথে সামাজিক মেলামেশা বৃদ্ধির মাধ্যমে দূর করা যায়। চেষ্টা করলে কারও সাথে মনের কথা ভাগ করে নেবার মাধ্যমে মনের মাঝে সৃষ্টি হওয়া চাপ এবং অস্বস্তি দূর হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু মানসিক এই অস্বস্তি এবং চাপ যদি খুব বেশী হয় অর্থাৎ দীর্ঘস্থায়ী একাকিত্বে ভুগছে এমন কারও সমস্যার পেছনে অনেক জটিল বিষয়ের প্রভাব থাকে। এ ধরণের মানসিক সমস্যা একজন ব্যক্তিকে এমন ভাবতে বাধ্য করে যে সে একদম রিক্ত, শূন্য, সবার থেকে আলাদা এবং অবাঞ্ছিত।

একাকীত্বে ভোগা মানুষেরা মনে মনে অন্যদের সাহচর্য কামনা করে। কিন্তু তাদের মানসিক অবস্থা অন্যান্যদের সাথে তাদের এই সম্বন্ধের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের একাকীত্ব ঠিক তাদের চারপাশে কেউ নেই সেজন্য নয়। বরং এটি সম্পূর্ণ একটি মানসিক স্থিতি যা তাকে অনেক মানুষের মাঝেও মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে একা করে রাখে। সবার মাঝে থেকেও তার মাঝে একাকী থাকার অনুভূতি কাজ করে।

এভাবেই, একাকীত্ব হল মানুষের মনস্তত্ত্বের এমন এক অবস্থা বা অনুভূতি যা সম্পূর্ণই তার মনের ভাবনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এর সাথে আশেপাশে লোকজন থাকা বা না থাকার কোন সম্পর্কই নেই। তাই একাকীত্ব দূর করতে মন থেকে এই অনুভূতির বদল আনতে হবে।

এক্ষেত্রে একজন ভুক্তভোগী মানুষের নিজের মনের ইচ্ছে সব থেকে বেশী কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারবে। তাকে একাগ্র চিত্তে বিশ্বাস করতে হবে যে একাকীত্ব হয়তো চরমভাবে তাকে ঘিরে ধরেছে কিন্তু এই অবস্থা অবশ্যই পরিবর্তন যোগ্য। এরকমই কিছু কৌশল নিচে উল্লেখ করা হল।

১) নিজের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তনঃ বিভিন্ন গবেষণায় একাকীত্ব নিরসনে যে সকল কৌশল নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে সব থেকে কার্যকরী উপায় হল নিজের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন। নিজের মাঝে ইতিবাচক চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে নিজের সমস্যার সমাধান করার লক্ষ্যে মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করাই সব থেকে বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে একজন দীর্ঘস্থায়ী একাকীত্বে ভোগা মানুষের জীবনে।

অন্যদের সম্বন্ধে তাদের মাঝে নিয়ত বেড়ে ওঠা নেতিবাচক ধারণার পরিবর্তন, ধীরে ধীরে সামাজিক মেলামেশা বাড়ানো এবং নেতিবাচক ধারণা গুলো নিয়ে অন্যান্যদের সাথে কথা বলে মনের মাঝে পরিবর্তন নিয়ে আসার প্রচেষ্টা অবশ্যই একজন মানুষকে এই মানসিক পীড়ার হাত থেকে মুক্তি দিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।

২) সামাজিক জীবন যাপনে উৎসাহ ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা করাঃ কোন ব্যক্তির মাঝে যখন একাকীত্বের অনুভূতি অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যায় তখন সে সামাজিক মেলামেশা এড়িয়ে চলার প্রয়াস করতে শুরু করে। কারণ সব কিছুই তার উপর অতিরিক্ত মানসিক চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করে, সব কিছুই তার কাছে অসহ্য মনে হয়। তারা বিভিন্ন সাংকেতিক সংকেত যেমন কারও চোখে চোখ পড়ে যাওয়া, কারও সাথে হেসে কথা বলা ইত্যাদি এড়িয়ে চলার প্রয়াস করে।

স্বাভাবিকভাবে এগুলোই আমাদের উপর সামাজিক পরিবেশের ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। একাকী মানুষ এই ইতিবাচক প্রভাব গুলোকে নেতিবাচক ভাবতে শুরু করে। আর এটাই পরিবর্তনের মূল বিষয়।

সবার সাথে কথা বললে, হাসলে, সামাজিকভাবে সবার সাথে মিলেমিশে থাকলে যে আরও সুন্দর ভাবে বাঁচা যায় এবং তারা যে এই সমাজেরই একটা অংশ এই অনুভূতি নিজের মাঝে সৃষ্টি করতে হবে। তারা যে অবাঞ্ছিত নয় এটি ধীরে ধীরে নিজেকে বিশ্বাস করাতে হবে।

৩) বিভিন্ন সম্পর্কের মানুষের কাছে আপনার প্রত্যাশা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা তৈরিঃ আমাদের মাঝে অন্যান্যদের কাছে চাওয়া-পাওয়ার যে সমীকরণ কাজ করে সেটিই অনেক সময় একাকীত্বের অনুভূতির পেছনে খুব বড় ভূমিকা পালন করে।

আমরা মনে করি সবার জীবনে আমাদের একটা বিশেষ স্থান থাকবে এবং বিশেষ ভাবে নিয়ে আমাদের একাকীত্ব তারা দূর করে দেবে। যা হয়তো ঠিক সেভাবে হয়ে ওঠেনা আর এখান থেকেই আমাদের মাঝে অসন্তোষ এবং অস্বস্তি এবং সেখান থেকে একাকীত্বের সৃষ্টি হয়। আমাদেরকে এই প্রত্যাশাতেই লাগাম টানতে হবে।

একাকীত্ব যে কারও কাছে বিশেষ স্থান পেলেই মেটানো সম্ভব এমনটা মোটেও নয়। বরং এমন কাজ খুঁজে বের করুন যা আপনাকে মন থেকে শান্তি প্রদান করবে। মন ভালো রাখতে যা যা আপনার পছন্দের সেসব কাজের মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।

আপনি একা, আপনাকে কেউ চায়না, ইত্যাদি চিন্তাভাবনা করা বাদ দিন। কারণ আপনি নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ট। কেন আপনি একা হবেন? মন থেকে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবতে চেষ্টা করুন।

আপনি নিজেই আপনার সব থেকে বড় বন্ধু এটা মেনে নিন। তাই একাকীত্ব বা একাকী অনুভূতি অন্য কারও উপস্থিতি-অনুপস্থিতি বা মনোযোগ দেওয়া-না দেওয়ার উপর নির্ভর করবেন না কখনো।

আপনার মনকে খুশি রাখতে, পরিপূর্ণ রাখতে আপনি একাই যথেষ্ট। তাই নিজের একাকীত্ব দূর করতে নিজেই এগিয়ে আসুন। চেষ্টা করুন। কারণ আপনি একা নন, নিজের মাঝেই নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

Previous articleসঠিক মূল্যবোধের অভাবেই মাদকাসক্তে পরিণত
Next articleমানসিক রোগ চিকিৎসা পদ্ধতিগত পার্থক্য

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here