টেকসই উন্নয়নে মানসিক স্বাস্থ্য

টেকসই উন্নয়নে মানসিক স্বাস্থ্য

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার জন্য সুস্বাস্থ্য আর কল্যাণ অর্জনের জন্য আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুহার হ্রাস, মাদকের অপব্যবহার কমিয়ে আনা, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার নিশ্চিতকরণ, অসমতা হ্রাস করতে হলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ) অর্জনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব না দেওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যসেবার ইতিহাসে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই উপেক্ষিত ছিল। বিগত কয়েক বছরে স্বাস্থ্য খাতের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টির দিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।

সাধারণ স্বাস্থ্যশিক্ষা কখনোই পূর্ণাঙ্গ হবে না, যতক্ষণ মানসিক স্বাস্থ্যশিক্ষা না হচ্ছে। রোগনিয়ন্ত্রণ করতে হলে শারীরিক-মানসিক সব রোগকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিশেষত কিছু শারীরিক সমস্যায় মানসিক রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। আবার কিছু মানসিক সমস্যা শারীরিক লক্ষণ নিয়ে প্রকাশ পেতে পারে।

মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারলে শিশুর মানসিক প্রতিবন্ধিতাসহ নানাবিধ জন্মগত ত্রুটির পাশাপাশি মায়ের প্রসব–পরবর্তী মানসিক সমস্যা দূর করা সম্ভব। পুষ্টিমান নিশ্চিত করা না গেলে বুদ্ধির বিকাশ ও মানসিক বৃদ্ধি যেমন ব্যাহত হয়, তেমনি অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মানসিক সুস্থতা বজায় থাকে না।

কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সর্বত্র মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি নানা কারণে অন্ত্যজ হয়ে আছে। আর আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে মানসিক রোগ নিয়ে আছে নানা অন্ধবিশ্বাস, মিথ ও অপচিকিৎসার ছড়াছড়ি।

নেই নেই করেও আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এগিয়ে চলেছে। বিশেষ করে গত ১০ বছরে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল মানসিক স্বাস্থ্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। ২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয় এবং এর শয্যাসংখ্যা দ্বিগুণ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বহু খাতভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবায় মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

মানসিক স্বাস্থ্য বলতে সবাই মানসিক রোগের কথা মনে করে। বস্তুত মানসিক স্বাস্থ্য অর্থ কেবল মানসিক রোগ নয়, বরং মনের যত্ন নেওয়া, নিজের সক্ষমতা আর দুর্বলতা বুঝতে পারা এবং দৈনন্দিন চাপের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে উত্পাদনশীল থাকাটাই মানসিক স্বাস্থ্য। যখন একজন মানুষের চিন্তা, আবেগ আর আচরণ সুষম আর স্বাভাবিক থাকে, তখন ধরে নেওয়া যায় সে মানসিকভাবে স্বাস্থ্যবান।

আমরা যেমন প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ করি, শরীরের যতœ নিই, সুষম খাবার খাই, তেমনি আমাদের মনেরও যতœ নিতে হবে। যেসব কারণে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতেই হবে, সেগুলো হচ্ছে-

মানসিক স্বাস্থ্য বলতে কেবল মানসিক রোগ বোঝায় না। মনে কোনো রোগ না হলেও মনের যতেœর প্রয়োজন আছে। যার কোনো মানসিক রোগ নেই, তার মনটিকে সুস্থ রাখার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতেই হবে।

মনোদৈহিক স্বাস্থ্য সমস্যা ও দেহ–মনের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের সমস্যা, হাঁপানি, স্ট্রোক, এসএলই, আর্থ্রাইটিস, ক্যানসারসহ বেশ কিছু শারীরিক রোগ আছে, যার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক আছে। এসব রোগে বিষণ্ণতাসহ নানাবিধ মানসিক উপসর্গ থাকতে পারে। তাই শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো মানসিক স্বাস্থ্যকেও গুরুত্ব দিতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা বাংলাদেশে তো বটেই, এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও মানসিক রোগ নিয়ে রয়েছে নানা ভ্রান্ত বিশ্বাস। তাই একদিকে যেমন মানসিক রোগী ও তার পরিবার চিকিৎসা গ্রহণে অনাগ্রহী থাকে, অন্যদিকে কার্যকরী মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় সব রোগী সুচিকিৎসা পায় না। ফলে মানসিক সমস্যার প্রকোপ বৃদ্ধি ও চিকিৎসাহীনতার দুষ্টচক্র চলতেই থাকে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কুসংস্কার দূর করতেই হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি সবার মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়টি বর্তমানে পুরোপুরি বিশেষজ্ঞনির্ভর। বিশেষায়িত হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ আর কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগগুলো ছাড়া মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ কম। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সব পর্যায়ের চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষক, সমাজসেবক, সংবাদকর্মী, জনপ্রতিনিধিসহ প্রত্যেকেরই কিছু প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন। নইলে এটি মেডিকেল মডেলে সীমাবদ্ধ থাকবে, সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছাবে না।

মানসিক রোগীর মানবাধিকার নিশ্চিত করা। মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে। এতে মানসিক রোগীদের প্রতি বৈষম্য কমবে, তাদের প্রতি সমাজের ভ্রান্ত ধারণা পাল্টাবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের যে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, তা রোধ করা সম্ভব হবে।

কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য কর্মীদের মানসিক টানাপোড়েন আর স্ট্রেসের কারণে উৎপাদনশীলতা কমে যায় বলে গবেষণায় প্রমাণিত। ফলে কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।

ঝুঁকিপূর্ণ আর নাজুক জনগোষ্ঠীর জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা। দুর্যোগ-দুর্ঘটনার পর উদ্ধার করা ব্যক্তিদের জন্য খাবার, ওষুধ, আশ্রয়ের পাশাপাশি তাদের মনের দিকেও নজর দিতে হবে। কারণ, যেকোনো দুর্যোগের পর উদ্ধার করা ব্যক্তিদের মধ্যে মানসিক সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যায়।

মানসিক স্বাস্থ্য যেন কেবল মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের বিষয় না হয়, এটি সবার বিষয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে যে ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে রোগের বোঝার (ডিজিজ বার্ডেন) ১ নম্বর কারণ হবে বিষণ্ণতা আর সে সময় বছরে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর শিকার হবে।

ভবিষ্যতে উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করতে হলে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দিতেই হবে। কারণ, আগামী দিনের পৃথিবী হবে মানসিক স্বাস্থ্যের পৃথিবী। এ কারণে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আমরা যতটুকু এগিয়েছি, তার চেয়ে আরও বেশি গতিতে এগোতে হবে। কারণ, একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যখন পিছিয়ে থাকে, তখন তাকে খুঁড়িয়ে চললে হবে না, অন্য বিষয়ের সঙ্গে সমান তালে চললেও হবে না, এটিকে রকেটের গতিতে এগিয়ে নিতেই হবে।

Previous articleকরোনায় শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য খেয়াল রাখা প্রয়োজন
Next articleসঠিক মূল্যবোধের অভাবেই মাদকাসক্তে পরিণত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here