রোগের ইতিহাস অনুযায়ী আপনি কৈশোরকাল থেকেই মানসিক সমস্যায় ভুগছেন

সমস্যা:
আমার সালাম নিবেন। কোথা থেকে শুরু করবো সেটা ভাবছি। আমার সমস্যা শুরু হয় যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। সে সময় মানসিক সমস্যাগুলো আমাদের সমাজে অত বেশি প্রচলিত ছিল না। আমি ভারত, সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডে চিকিৎসা গ্রহণ করি। ডাক্তার বলেছিলেন আমার বেশ গুরুতর স্নায়বিক সমস্যা রয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শমতো আমি সম্পূর্ণ বিশ্রামে ছিলাম এবং কোন ধরনের মানসিক চাপ যাতে না নিতে হয় তার কারণে পড়াশুনাও বন্ধ করে দেই। তারপর ২০ বছর বয়সে আমার অবস্থার উন্নতি ঘটে এবং বর্তমানে আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। কিন্তু বিয়ের পর জীবনযাপনের পরিবর্তন, দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলোকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারিনি। আমি ঢাকায় আমার স্বামীর সাথে বসবাস করি। কিন্তু আমার স্বামী আমাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারে না। উল্লেখ্য আমার স্বামী একজন ফার্মাসিস্ট এবং পারিবারিক পছন্দে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের আগে আমি বেশ ভালো ছিলাম কিন্তু পড়াশুনায় বিরতির কারণে আমার ভালো কোন বন্ধু ছিল না। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে আমি ঘুমের ঔষধ খাই। এখন আমি আবার সাইকোলজিস্টের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছি এবং প্রচুর পরিমাণ ঔষধ খাচ্ছি। কিন্তু সত্যি বলতে আমি আমার বর্তমান জীবনযাপনে সম্পূর্ণ ক্লান্ত। বেড়ানো, মন রিফ্রেশ রাখা এবং পর্যাপ্ত ঘুম আমার প্রধান ঔষধ। ছোটবেলায় এসবের মাধ্যমে আমি ভালো থাকতাম। এখন মনে হয় দিনদিন আমার হার্ট দুর্বল হয়ে আসছে, শক্তি কমে যাচ্ছে, কাজে শক্তি পাই না। আমার পরিবার (ভাই, বোন) আমার সমস্যা বুঝতে পারে না এবং আমাকে সমর্থন করে না। শুধু আমার বাবা আমার স্বাস্থ্যের জন্য কষ্টভোগ করেছেন। আমার মাও আমার শারীরিক ও মানসিক সমস্যার ব্যাপারগুলো বুঝতে পারে না। মা সবসময় বলেন তাঁর কাছে সব সন্তান সমান। তাদের থেকে আমার মানসিক সাপোর্ট খুব প্রয়োজন ছিল কিন্তু তারা তা করেনি। তাদের সাথে আমি খুব একটা কথা বলিনা কারণ তাঁরা বাবাকে এই বলে দোষারোপ করেন যে বাবা আমার প্রতি তুলনামূলক বেশি এটেনশন দিয়েছে।
এখন আমি একটি বাচ্চা নিতে ইচ্ছুক কিন্তু আমার শারীরিক অবস্থা বাচ্চা নেয়ার পক্ষে উপযোগী নয়। আমার বয়স এখন ২৭ চলছে। PCOS সমস্যা, থাইরয়েড সমস্যা, মানসিক চাপ, ঘুমের সমস্যা, হার্ট-বিট সমস্যা, ব্লাড প্রেশার কম ইত্যাদি নানা ধরনের সমস্যায় আমি আক্রান্ত। মাঝে মাঝে নিজের উপর এতটাই রাগ হয় যে মনে হয় জীবনটা সম্পূর্ণ অর্থহীন এবং কেন আমি আমার জীবনের জন্য যুদ্ধ করছি? কেন আমি বেঁচে আছি? আমি কাজ করতে চাই কিন্তু কোন চাপ নিতে বা কোন ধরনের আদেশ গ্রহণ করতে পারিনা। আমার বাবা ছিলেন বডিগার্ডের মতো, তিনি সবসময় আমার সাথে থাকতেন। আমার মনে হয় যত্ন, ভালোবাসা এবং বোঝাপড়াই পারে আমাকে কাজের ব্যাপারে প্রস্তুত করতে। আমার স্বামী আমাকে সহযোগিতা করে এবং বর্তমানে আমার বাবা বয়সের কারণে অসুস্থ। তাদের কারো পক্ষেই আমাকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এখন আমি কি করতে পারি?
(অনুগ্রহ করে আমার নাম প্রকাশ করবেন না)
পরামর্শ:
প্রশ্ন করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার রোগের ইতিহাস অনুযায়ী আপনি দীর্ঘদিন অর্থাৎ কৈশোরকাল থেকেই মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তবে তখন আপনার কি সমস্যা বা উপসর্গ ছিল তা ঠিক স্পষ্ট করে বলেন নি। মানসিক সমস্যার পাশাপাশি কোনো স্নায়ুরোগ ছিল কিনা তাও স্পষ্ট না। তবে এটা একটা ভালো দিক যে, আপনি আপনার কৈশোরকালের গুরুতর সমস্যা অনেকটা কাটিয়ে উঠে আবার পড়াশুনা তথা কিছুটা স্বাভাবিক জীবন শুরু করেছিলেন।
কিন্তু এখন আপনার প্রশ্ন  থেকে মনে হচ্ছে যে, আপনি বর্তমানে বিষণ্ণতা রোগ (Depressive Disorder) এ ভুগছেন। কোনো কিছুতে উৎসাহ বা আনন্দ না পাওয়া, কিছু ভাল না লাগা, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসা, জীবনটাকে মূল্যহীন মনে হওয়া, দুর্বলতা, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি সবই কিন্তু বিষণ্ণতা রোগের জন্যে হয়ে থাকে। বিষণ্ণতা এমন একটি রোগ যা বংশগত, দীর্ঘকালীন মানসিক চাপ, ব্রেইনে কিছু রাসায়নিক পদার্থের তারতম্য ইত্যাদি কারণে হতে পারে। আবার শরীরে কিছু হরমোনের তারতম্যর জন্যেও বিষণ্ণতা হয়ে থাকে। আপনার যেহেতু কিছু শারীরিক সমস্যা যেমন থাইরয়েড সমস্যা, PCOS সমস্যা আছে, কাজেই আপনার ক্ষেত্রে বিষণ্ণতা রোগ এর চিকিৎসার পাশাপাশি এসব রোগেরও চিকিৎসার প্রয়োজন আছে। এসব সমস্যার জন্যে বর্তমানে আপনি কি চিকিৎসা নিচ্ছেন তা বলেননি। আপনি বলেছেন যে দীর্ঘদিন যাবত ঘুমের এবং মানসিক রোগের ঔষধ খাচ্ছেন, কিন্তু কোনো ঔষধের নামও উল্লেখ করেন নি।
এ অবস্থায় আপনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখাতে পারেন। উনিই আপনার অন্যান্য তথ্য, বর্তমান মানসিক ও শারীরিক অবস্থা পরীক্ষার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ও উপযোগী চিকিৎসা পরামর্শ দিবেন। এ ধরনের রোগ চিকিৎসায় সাধারণতঃ বিষণ্ণতা রোগের ঔষধ ও শারীরিক রোগের ঔষধ একইসাথে চালিয়ে যেতে হয়। প্রয়োজনবোধে আপনাকে একজন হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ (এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট) এর পরামর্শও নিতে হতে পারে। আবার এর পাশাপাশি সাইকোথেরাপিরও প্রয়োজন আছে যা আপনার মনোরোগ বিশেষজ্ঞই করবেন।
বিষণ্ণতা একটি নিরাময়যোগ্য রোগ। আশা করি, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়ে আপনি দ্রুত বিষণ্ণতা থেকে মুক্ত হতে পারবেন।
পরামর্শ দিচ্ছেন,
ডা. সুস্মিতা রায়


 দৃষ্টি আকর্ষণ- মনেরখবর.কম এর প্রশ্ন-উত্তর বিভাগে, মানসিক স্বাস্থ্য, যৌন স্বাস্থ্য, মাদকাসক্তি সহ মন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আপনার কোনো জানার থাকলে বা প্রশ্ন থাকলে বা বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দরকার হলে question@www.monerkhabor.com এই ইমেলের মাধ্যমে প্রশ্ন পাঠাতে পারেন।

Previous articleফিজিতে মানসিক স্বাস্থ্য সমর্থনে কর্মশালা
Next articleমানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে হাঁটা
অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ, সিলেট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here