সবচেয়ে মূল্যবান এবং দুর্লভ যে জিনিসটি পেয়েছি সেটা হলো ভালোবাসা

0
96
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এম এস আই মল্লিক

দীর্ঘ এবং বর্ণিল কর্মজীবন পার করে গত ৩০ মার্চ দীর্ঘদিনের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করেন প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এম এস আই মল্লিক। নিজের কর্মময় জীবনের অভিজ্ঞতা, জীবনবোধ, তাঁর প্রিয় বিষয় চাইল্ড সাইকিয়াট্রি এবং সাহিত্যচর্চা নিয়ে ‘মনের খবর’ এর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রখ্যাত এই মনোচিকিৎসক। ‘মনের খবর’ এর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন সাদিকা রুমন।

একটি সফল কর্মজীবন পার করার পর ‘অবসর’ বিষয়টিকে কীভাবে গ্রহণ করেছেন?

আমার কাছে অবসর মানে জীবনকে নতুনভাবে দেখা, উপলব্ধি করা, উপভোগ করা, নতুনভাবে সময় কাটানো। আসলে অবসর বলতে যেটা বোঝায় আমি তো চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি, চাকরি বলতে যেটা বোঝায়- চাকর-ই, এর মধ্যে থাকে দায়বদ্ধতা, শৃঙ্খলা। এখন এই শৃঙ্খলটুকু নেই। তাই অবসরের আনন্দটা পাচ্ছি। আর অবসরের অর্থ হচ্ছে, একটা পেশা থেকে আরেকটা পেশায় যাওয়া, এক ধরনের সক্রিয়তা থেকে আরেক ধরনের সক্রিয়তায় যাওয়া। পাশ্চাত্যে অবসর অনেক বেশি উপভোগ্য, কাম্য এবং অবসরকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে তারা মনে করে। আমরা দেখি পৃথিবীতে যাঁরা গিভার, মানবজগৎকে যাঁরা দিয়েছেন তাঁরা কিন্তু ষাট/সত্তর বছর বয়সে তাঁদের ভালো কাজগুলো করেছেন। এই মনস্তত্ত্বটা আমাদের বুঝতে হবে এবং অন্যদেরও বোঝাতে হবে। অবসর যে একটা ইতিবাচক ব্যাপার সেটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। সেই সঙ্গে একটা পরিকল্পিত অবসরের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।

যেরকম জীবন চেয়েছিলেন সেই জীবনটাই কি পেয়েছেন?

আমার মনে হয়, জীবনে আসলে কী পেয়েছি এবং কী করা দরকার ছিল সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। সে হিসেবে অনেক কিছুই আমি পেয়েছি। মনোবিজ্ঞানে মাজলোর যে হাইয়ারার্কি নিড আছে সেই যে জৈবিক চাহিদা থেকে সামাজিক চাহিদার বিভিন্ন স্তর তার সবই তো আমি অর্জন করেছি। আমি উঁচু পর্যায়ের বিভিন্ন ডিগ্রী অর্জন করেছি আমার পেশাতে, পদ-পদবি বলো সেটাও পেয়েছি। কাজের সুযোগও পেয়েছি অনেক। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আমি কাজ করেছি। বিএসএমএমইউ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) এ আমি কাজ করেছি জীবনের দীর্ঘ সময়। সম্ভবত দুই দশকের ওপরে। এখানে আমি চেয়ারম্যানও ছিলাম। এখানে টিচিং, ট্রেনিং এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এখানে কোর্সগুলোর উন্নতি করার চেষ্টা করেছি। চাইল্ড সাইকিয়াট্রি কোর্সটা খুলেছিলাম। আমি যখন স্টুডেন্ট ছিলাম তখন সাইকিয়াট্রির কোনো কারিকুলাম ছিল না। আমি প্রথম এই কারিকুলামটা করি। নিজের হাতে আমি লিখেছিলাম। এই যে এখন ন্যাশনাল ইন্সিটিটিউট অব মেন্টাল হেলথ প্রজেক্ট এটা ছিল প্রস্তাবিত এই প্রজেক্টের প্রস্তবনা থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত আমার বড়ো ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রি একসময় স্থবির ছিল সেটাকে সচল করেছি। বর্তমানে তার যে গঠনতন্ত্র এবং অন্যান্য যা কিছু আছে এগুলো আমার হাতেই করা। বাংলাদেশ চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলসেন্ট মেন্টাল হেলথও আমি গড়েছি। সামান্য মানুষ আমি। সে জায়গা থেকে পেয়েছি অঢেল। তবে আমি সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছি শিক্ষকতা করে। আবার জন্ম নিলেও আমি শিক্ষক হতে চাইতাম এবং সাইকিয়াট্রিস্ট হতে চাইতাম। গবেষণাতেও আমি আমার প্রাণ ঢেলে দিয়েছি। দেশেবিদেশে প্রায় শতাধিক গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হয়েছে। দেশে এবং বিদেশে নানারকম সম্মান স্বীকৃতি পেয়েছি। যেটা একটা জীবনের জন্য যথেষ্ট। তবে সবচেয়ে মূল্যবান এবং দুর্লভ যে জিনিসটি পেয়েছি সেটা হলো ভালোবাসা। সুতরাং সে হিসেবে আমার জীবনটা সুখেই কেটেছে বলতে হবে এবং আমি তৃপ্ত।

কোনো কি দুঃখ কিংবা অপ্রাপ্তি রয়ে গেল?

একেবারে পরিপূর্ণ তৃপ্তি পাওয়া তো সম্ভব নয় কোনো কাজে। কারণ তৃপ্তি যেখানে পরিপূর্ণ হয় সেখানেই সে কাজের সমাপ্তি ঘটে। অতৃপ্তিই মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। যদি অপূর্ণতা বা দুঃখের কথা বলো তাহলে আমি বলব, ঠিক যতটা আমি দিতে পারতাম পেশাগত বা অন্যান্য জীবনে ততটা দিতে পারিনি। এর পেছনে নানা কারণ আছে। তার মাঝে একটা হলো আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট। দেশ-কাল-পাত্রের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে একজন নাগরিক কতটা অবদান রাখতে পারল বা না পারল তার ওপর। মাঝে মাঝে এরকম একটা অতৃপ্তি আসে যে, আরো হয়ত দিতে পারতাম। তার মধ্যে আমি যতটুকু করেছি সেটা ভালোবেসেই করেছি। এর তুলনায় আমার অপ্রাপ্তির যে খেদ সেটা একেবারেই তুচ্ছ।

আপনি নিজে একজন গোছানো মানুষ। সফলতার জন্য গোছানো হওয়া কতটা প্রয়োজন?

আসলে কাজকর্মে বা পেশাগত জীবনে আমাকে হয়ত গোছানো মনে হয় কিন্তু সার্বিকভাবে বা ব্যক্তিগত জীবনে অতটা গোছানো নই। আমি গোছানো আসলে আমার পেশাগত জীবনে, আমার শিক্ষা দানে, আমার গবেষণায়, আমার চিকিৎসাসেবাতে। আরেকটা আমার গোছানোর জায়গা আছে সেটা হলো স্কাউটিং। বর্তমানে আমি বাংলাদেশ স্কাউটসের একজন নীতিনির্ধারণীর দায়িত্বে আছি। স্কাউটিংটা মানুষ গড়ার একটা ক্ষেত্র, একটা মুভমেন্ট। এই মুভমেন্টটা আমি খুব ভালোবাসি। এখানে আমার যে অবদান, যে কাজকর্ম করেছি সেই জায়গাতে আমি গোছানো। আমি অতটা গোছানো নই আমার লেখালেখিতে, আমার পরিবারের ক্ষেত্রে। সামাজিক ক্ষেত্রেও আমি নিজেকে অনেক দায়িত্বশীল বলব না। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন গোছানো মানুষ। তিনি আমার আদর্শ। তিনি গোছানো ছিলেন বলেই বোধকরি এতটা অবদান রাখতে পেরেছেন। আবার নজরুল ছিলেন অগোছালো। অগোছালো ছিলেন বলেই হয়ত তাঁর কাছ থেকে এত কিছু পেয়েছি। গোছানো হলে হয়ত তাঁর সৃষ্টিশীলতা রুদ্ধ হয়ে যেত। তবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের জীবনের সফলতার জন্য গোছানো হওয়ার দরকার আছে।

আপনি একজন সফল চিকিৎসক। ব্যস্ত কর্মজীবনের পাশাপাশি আপনি কাব্যচর্চা করে এসেছেন কী ধরনের তাগিদ থেকে?

আসলে এটা আমার সহজাত একটি বিষয়। প্রকৃতিগতভাবেই আমি আবেগপ্রবণ। আমার সহজাত প্রবণতা, সহজাত বোধ এবং চৈতন্য আমাকে কবিতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমার জীবনের একটা বৃহত্তর অংশই হলো সাহিত্য। মেডিক্যালের ছাত্র থাকা অবস্থায় আমি কবিতা এবং পড়ালেখা নিয়ে দোটানায় পড়ে গিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হতো, কবিতার জন্য সবকিছু তাচ্ছিল্য করি। কিন্তু তা পারিনি। কারণ আমি তো আসলে একজন সামান্য মানুষই। কিন্তু মায়া ভালোবাসাটা ছাড়তে পারিনি। নিজের জীবনের সাথে তাকে সমন্বয় করে নিয়েছি। আমার প্রায় চৌদ্দটা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি পেয়েছি কাহলিল জিব্রানের প্রফেট অনুবাদ করে। সচেতন জীবনবোধ আর কবিতার প্রতি ভালোবাসাই আমাকে লিখিয়েছে। একটা জীবনের মধ্যে কবিতা আমার আরেকটা জীবন।

আপনার অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা কী অবস্থায় আছে?

এক কথায় বললে একেবারে মন্দ নয়। আমি যখন এই জগতে প্রবেশ করি তখনকার সময় থেকে এখনকার অবস্থার যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। অবশ্য যদি বৃহৎ প্রেক্ষাপটে দেখি তাহলে, অনেক উন্নতি হয়েছে বা বিরাট কিছু হয়েছে এরকম বলতে পারি না। যদি নৈর্বক্তিকভাবে দেখি তাহলে উন্নত বিশ্ব থেকে আমরা বহু বহু পেছনে আছি। উন্নয়নশীল দেশের মধ্যেও পেছনে। প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দু-একটি দেশ ছাড়া বেশিরভাগেরই পেছনে। আমার যেটা উপলব্ধি; সার্বিকভাবে জাতীয় উন্নতির সাথে আর্থসামাজিক উন্নতি বা সাংস্কৃতিক উন্নতি, মানুষের মনোজগতের উন্নতি পরস্পর সংশ্লিষ্ট। সেদিক দিয়ে, আমাদের দেশের যে উন্নতি হচ্ছে তার সমান্তরালেই মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার উন্নতি হয়েছে। আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের নীতি নির্ধারক যাঁরা এ বিষয়ে তাদের যথেষ্ট আগ্রহ আমরা দেখতে পাচ্ছি। ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি, ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ পলিসিও তৈরি হয়েছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা অনেক বেড়েছে। আমাদের পার্টনারশিপও বেড়েছে। প্রাইভেট লেভেলে অনেক ধরনের সার্ভিস ডেভেলপ করেছে। তবে সবকিছুর একটা সমন্বয় দরকার। একটা পলিসির আলোকে মেন্টাল হেলথ সার্ভিস সিস্টেমেটিক উপায়ে গড়ে তোলা দরকার। যে সার্ভিসটি আমরা আমাদের জনগনের কাছে পৌঁছে দিতে পারব।

বাংলাদেশের চাইল্ড সাইকিয়াট্রি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই

চাইল্ড সাইকিয়াট্রি তো সাইকিয়াট্রি বা মেন্টাল হেলথেরই একটা অংশ। বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য বা মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার অবস্থা যা চাইল্ড সাইকিয়াট্রির অবস্থাও সেরকমই। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভুল ধারণা প্রচলিত আছে ব্যাপকভাবে। যেমন-

শিশুদের কি আবার মানসিক চাপ হয় নাকি! অথচ আমি গবেষণা করে দেখেছি, শিশুদের মানসিক চাপ বয়স্কদের সমান বা বয়স্কদের চেয়ে বেশি। বেশির ভাগ মায়েদের শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ধারণা নেই। কেউ কেউ আছেন শিশুকে একেবারে আঁকড়ে ধরেন, তাদের সবকিছু নিজেরাই করে দিতে চান। আবার কেউ কেউ আছেন শিশুদের এমন সমালোচনা করেন যে তাদের মনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। ভাবেন যে, প্রশংসা করলে সন্তানের ক্ষতি হবে। আমাদের সেবা মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সাথেই সম্পৃক্ত। কাজেই সামগ্রিক যে সংকট লোকবল কম, এখানেও তাই। তবু আমি বলব যে, এ বিষয়ে আমাদের সচেতনতা বেড়েছে। শিশুদের মানসিক বিকাশ সম্পর্কে আমাদের ধারণাও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের চাইল্ড মেন্টাল হেলথ সার্ভিস চালু হয়েছে। এটা আমিই চালু করি। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর এটার গতি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন কোর্স খোলা হয়েছে। চাইল্ড সাইকিয়াট্রি সম্পৃক্ত বিভিন্ন প্রশিক্ষণও অনেক ডেভেলপ করছে। চাইল্ড সাইকিয়াট্রি নিয়ে সচেতনতা অনেক বেড়েছে। তবে এই সচেতনতার পরিমাপ রোগীর ভিড় দেখে নির্ধারণ করা যাবে না। সামগ্রিকভাবে এখনো আমরা এতটা সচেতন হতে পারিনি।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের চাইল্ড সাইকিয়াট্রির অবস্থান কোথায়?

যদি আমরা ইতিহাস দেখি, পৃথকভাবে চাইল্ড মেন্টাল হেলথের ইতিহাস একশ বছরের কিছুটা বেশি হবে। তবে র‍্যাপিড ডেভেলপমেন্ট সারা বিশ্বে হচ্ছে। আমাদের দেশে চাইল্ড সাইকিয়াট্রির ইতিহাস বিশ বছরের। বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে আমরা অনেক পেছনে আছি। আমাদের তো জনশক্তিই নেই। হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র চাইল্ড সাইকিয়াট্রিস্ট এবং চাইল্ড মেন্টাল হেলথ ওয়ার্কার আছেন। সাইকিয়াট্রিস্টরাই সাধারণত এই দায়িত্ব পালন করেন। তবে অর্জন একেবারে কম নয়। আমাদের কোর্স হয়েছে। জনবল তৈরির ব্যবস্থা হয়েছে, ট্রেনিং সেন্টার বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমাদের সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। সে হিসেবে আমি বলব, আমরা পিছিয়ে আছি বটে তবে যেভাবে অগ্রসর আমরা হয়েছি সেটা আশাব্যঞ্জক। তবে বৈশ্বিক চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলসেন্ট মেন্টাল হেলথের যে ধারণা সেটা আমাদের বুঝতে হবে এবং এর সাথে আমাদের সংযুক্ত হতে হবে। কারণ বিছিন্নভাবে কোনো দেশ মেন্টাল হেলথ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।

শিশুর মনোবিকাশের বিষয়টিকে উপেক্ষা করার পরিণাম কী?

আমাদের দেশে তো শিশুর বিকাশের ওপর গুরুত্ব তেমন একটা দেয়া হয় না। বিকাশ সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণাই আমরা দেখতে পাই। বিকাশ সম্পর্কে বেশির ভাগ বাবা-মায়ের মনোভাবই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বই-পুস্তক বা কালিকুলামেও এ সম্পর্কে তেমন কিছু নেই। বিশেষ করে বাবা-মায়ের বিকাশ নিয়ে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই ছেলেমেয়েদের বিকাশের ব্যাপারটিকে বুঝি। শিশুর বিকাশে যে সবার বিভিন্ন ভূমিকা আছে সেটা আমরা অনেক সময় ভুলে যাই। শিশুর বিকাশে যে পিতা-মাতা, শিক্ষক, সমবয়সী, সহপাঠী, স্কুল, পারিপার্শ্বিক এলাকা, খেলাধুলা, সৃজনশীল কাজ ইত্যাদির ভূমিকা রয়েছে সেটা আমরা সেভাবে বুঝি না। আমরা পড়াশুনাই করাতে চাই। একটা শিশুর যে অবসর সময় দরকার, তার যে একটা নিজস্ব জগৎ আছে সেটাকে আমরা একেবারেই পাত্তা দিতে নারাজ। আমরা কেবল বুঝি স্কুল, পড়াশোনা। ‘লেখাপড়া করে যে-ই গাড়িঘোড়া চড়ে সে-ই’ এই মন্ত্র আমাদের মনে এতটাই গেঁথে আছে যে এই মন্ত্রে তাড়িত হয়ে আমরা ছেলেমেয়েদের শুধু তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াই। এই তাড়িয়ে নেয়াটা তাদের বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আর শিশুদের মানসিক বিকাশকে উপেক্ষা করার পরিণাম ভয়ানক। যখন শিশুর বিকাশ ব্যাহত হয় এবং সে রোগে ভোগে তখন পরিবারের জন্য সে একটা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। আর্থিক বোঝা তো বটেই, শারীরিকভাবেও সমাজের বোঝা। মানসিক বিকাশজনিত সমস্যার জীবনব্যাপী একটা ধারাবাহিক প্রভাব থাকে। কাজেই শিশুবিকাশকে উপেক্ষা করলে জাতির অগ্রগতিই ব্যাহত হবে।

পেশাগত অভিজ্ঞতাকে অবসর জীবনে কীভাবে কাজে লাগাতে চান?

এখনো আমার পরিষ্কার কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে একটা ছক তো মাথায় আছে। সেখানে পেশাগত কাজের অংশ অনেক কম। আমি আমার পেশাগত কাজকে সীমাবদ্ধ রাখব মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে। বিশেষ করে আমার প্রিয় ছাত্রদের জন্য টেক্সট বুক লিখব কতগুলো। ইতিমধ্যে একটা আমি শুরু করেছি। এছাড়া ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রির ওপরে আমার একটা বই লেখার ইচ্ছে আছে। অন্যান্য কাজগুলোকে আমি অ্যাডভোকেসি এবং অ্যাডভাইজরি রোলের মধ্যে রাখতে চাই। তবে আমার পেশাগত কাজের পরিমাণটা আসলেই আমি কমাতে চাই। তবে আমি বিসিপিএস কলেজের সাইকিয়াট্রি ফ্যাকাল্টির চেয়ারম্যান। সেখানে আমি আরো কিছুদিন সাইকিয়াট্রি বিষয়ে আরো কিছু দেয়ার চেষ্টা করব। স্কাউটিংয়েও আমি আরো কিছু অবদান রাখার চেষ্টা করব। আরেকটা বড়ো জায়গা আগেই বলেছি যে, কবিতা লিখতে সময় দেব এবং সাহিত্যের আরো কিছুতে হয়ত আমি সময় দেব। তবে আমি বই পড়তে ভালোবাসি। পৃথিবীর কত মূল্যবান বই আমার পড়া হয়নি এখনো। সেসব না পড়েই তো চলে যেতে পারি না পৃথিবী থেকে। তাই বই পড়ব। সেইসাথে আরো কিছু কাজের ইচ্ছে আছে। ছোটোবেলা থেকে খুব ইচ্ছে ছিল আর্টিস্ট হবো, এখন হয়ত কাউকে গুরু ধরে ছাত্র হিসেবে ছবি আঁকা শিখব। এত কাজ আছে! আমার পেশাগত অভিজ্ঞতা এই সব ক্ষেত্রেই কিন্তু কাজে লাগবে। কারণ মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দিতে গিয়ে মানুষের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো নিয়ে আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। মন এবং মনন নিয়ে যে অভিজ্ঞতা পেয়েছি সে অভিজ্ঞতা আমার মনে হয় বাদবাকি জীবনের সবকিছুতেই কাজে লাগানো সম্ভব।

মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে চেষ্টা করছে মনের খবর। মনের খবর সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

যদি এক কথায় বলি তাহলে বলতে হয়, মনের খবর এর অবদান অনন্য, অসাধারণ এবং আনপ্যারালাল। আমি যেটা দেখেছি, মনের খবর মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষায় এবং সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। কেতাবি ভাষায় আমরা যাকে বলি ‘পাবলিক সাইকিয়াট্রি’ সেই পাবলিক সাইকিয়াট্রি বিকাশে মনের খবর এর ভূমিকা অসাধারণ। মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রশিক্ষনের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছে। ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও তাই। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত তথ্যও মানুষ মনের খবর এর মাধ্যমে জানতে পারে। এটা আমি অনেক রোগীদের মাধ্যমে জেনেছি। সর্বোপরি, এর যে উন্নত মান এবং উৎকর্ষতা, বিষয়বস্তু-অঙ্গসজ্জা-প্রচ্ছদ-ভাষা, বিশেষ করে বানানের ব্যাপারে আমি একট খুঁতখুঁতে আমি পড়ে দেখেছি মনের খবর-এ বানান ভুল থাকে না। সব মিলিয়ে মনের খবর এর একেকটা প্রকাশনা চমৎকার। মনের খবর আমাদের গর্বের এবং আশারও একটা জায়গা। এর যে টিম আছে যারা সামনে কাজ করছে, পেছনে কাজ করছে তাদের প্রতি আমি মন থেকে ধন্যবাদ জানাই এবং ভালোবাসাও জানাই।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

তোমাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ মনের খবরকে।

সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৫ম সংখ্যায় প্রকাশিত।  

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে  

 

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪
Previous article কোভিডকালীন বাস্তবতা কেমন হবে অভিভাবকত্ব
Next articleআজ রাত ৯ টায় অনুষ্ঠিত হবে ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’ উপলক্ষে ওয়েবিনার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here