মাদকাসক্তি ও আসক্তি – অভ্যাস নাকি প্রবল ইচ্ছা

মাদক, মাদকতা ও মাদকাসক্তি কি আসলেই আসক্তি
মাদক, মাদকতা,মাদকাসক্তি ও আসক্তি সম্পর্কযুক্ত ।আসক্তি হলো এক ধরনের অভ্যাস, আচরণ বা পরিণতি। মাদক হলো বিশেষ বিশেষ ধরনের কিছু কেমিকেল। এসব কেমিকেল শরীরে ঢুকার পর কোনো না কোনোভাবে মানুষটিকে এক ধরনের মাদকতার অনুভূতি দিতে পারে।

সহজ করে বলতে গেলে বলা যায়, মাদকতা হলো সাময়িক এক ধরনের উত্তেজনা, এক ধরনের বিশেষ অনুভূতি। শরীর কিংবা মন সবখানেই এই অনুভূতির রেশ ছড়িয়ে পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাময়িক এক ধরনের ভালো লাগা অনুভবও তৈরি হয়। আশপাশের অনেক কিছুই হয়তো তখন তাকে স্পর্শ করেনা। এসব অবশ্য নির্ভর করে অনেক কিছু উপর। তবুও সাধারণত মাদকতা বিষয়টি এমনি হয়। বিভিন্নজন এই অনুভূতিগুলোকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেন। কেউ বলেন, ফিলিং। কেউ বলেন, হাইপ। কারো কারো ক্ষেত্রে বিষয়গুলো আবার বর্ণনারও বাইরে চলে যায়। এক ধরনের ঝিম মেরে পরে থাকতে তাদেরকে দেখা যায়।
মাদকতা বিষয়টিকে, এভাবে বলা সম্ভব আসক্ত কেউ সেই সময়ে আশপাশের অনেক কিছু থেকে আলাদা হয়ে যায়। আলাদা থাকতে পছন্দ করেন এবং নিজস্ব এক জগতের ভেতর ঘুরপাক খেতে ভালোবাসেন। অনেকে শরীর ও মনের এই অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে নিজের মতো করে কিছু করতে ভালোবাসেন।

আসক্তি বলতে কী বুঝি?
যখন মানুষ কোনো একটি নির্দিষ্ট কাজে, চিন্তায় বা আচরণে অভ্যস্ত হয়ে যায়। যে কাজটি বা অভ্যাসটি থেকে চেষ্টা করেও বের হয়ে আসতে পারেনা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা পেশাগত জীবনে যে আচরণটি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ সেই কাজটি করার জন্য মনের ভেতর এক ধরনের তোলপাড় চলতে থাকে, তখন সেটা আসক্তির পর্যায়েই পরে। নির্দিষ্ট সেই কাজ বা চিন্তাটি সম্পন্ন করার জন্য অত্যন্ত প্রবল এক ধরনের ইচ্ছা ভেতরে কাজ করে। সাধারণত সেটি ক্ষতিকরই হয়ে থাকে।

আসক্তি একটি সাধারণ শব্দ হলেও এই শব্দের ভেতরই লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। আসক্তি শুধু মাদকেই নয়, আসক্তি আরো অনেক রকম হতে পারে। খাদ্যবস্তু থেকে শুরু করে যেকোনো কাজও আসক্তির অর্ন্তভুক্ত হতে পারে।

আসক্তি যেকোনো বয়সেই হতে পারে। শিশুদের যেমন হতে পারে, আবার বৃদ্ধদেরও হতে পারে। আচরণের ধরন-প্রকৃতি সাধারণত বয়সের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে থাকে।

অতিরিক্ত কার্টুন দেখা, পর্নাসক্ত, জুয়া, মাদক এমন কি ক্ষতিকরভাবে সময় কাটানোও আসক্তির পর্যায়ে পরতে পরে। তবে, হ্যাঁ সব আসক্তি সমান ক্ষতিকর না। কোনোটি সাময়িক হতে পারে, কোনোটি আবার জীবনঘাতীও হতে পারে। জুয়া আসক্তি এবং মাদকাসক্তি এসবের ভেতর সবচেয়ে ক্ষতিকর একেকটি।

মাদক শরীরে ঢুকে কী করে?
মাদক বা সেই সব কেমিকেল শরীরে ঢুকে শরীরের সাধারণ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। এসব কেমিকেল শরীরে ঢুকার পর কোনো না কোনোভাবে ব্রেইন বা মস্তিষ্কের কার্জক্রমের সাথে সম্পৃক্ত হয়।
মুখে খাবার হিসেবেই হোক বা অন্য কোনো উপায়ে, যেমন; ইনজেকশান হিসেবেই হোক, শরীরে ঢুকে ব্রেইন সেল বা নিউরনের কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়ে। তারা তখন ব্রেইন এর সাধারণ যে সিগনাল বা যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে তার গতিপথকে বাড়িয়ে বা কমিয়ে দিতে সহায়তা করতে পারে।

মাদক গ্রহণে মানুষ কেন আনন্দ পায়?
ব্রেইনএ ডোপামিন নামক একটি কেমিকেল বা নিউরোট্রান্সমিটার আছে। মানুষের যেকোনো আনন্দ অনুভূতির জন্য এই ডোপামিনই সবচেয়ে বেশী দায়ী। খাওয়া, গাওয়া, ফুর্তি সবকিছুর পিছনেই এই ডোপামিন দায়ী। যেকোনে ধরনের মাদক ব্রেইনের এই ডোপামিনকে বাড়িয়ে দেয়। সুতুরাং মাদক নেবার সময় মানুষ সাময়িক ভাবে হলেও আনন্দ পেয়ে থাকে।

ডোপামিন মানুষের মুভমেন্ট বা বিভিন্ন এক্টিভিটির জন্যও দায়ী। সুতরাং মাদক মানুষের সাময়িক কার্যক্ষমতাও বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়া মাদক সেরোটনিন ও গ্লুটামেট নামের কেমিকেলের উপরও প্রভাব ফেলে। সেরোটনিন মানুষের ঘুম ও মুডকে প্রভাবিত করে। অপরপক্ষে গ্লুটামেট মেমোরি ও লার্নিং প্রসেস বা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণের উপরও কাজ করে। নেশা এসব বিষয়কে সাময়িকভাবে চাঙ্গা করে তুলতে পারে।

কি ঘটে  যখন আসক্তি  হয় মাদকের ?
সাময়িক আনন্দ বা উত্তেজনা অনুভব করতে করতে মানুষ যখন এই অভ্যাসটি কিছু দিনের জন্যও চলিয়ে যায়। মাদক তখন শুধু আনন্দ দানের কাজেই ব্যস্ত থাকেনা তার নিজের চরিত্রগতভাবে আরো কিছু কাজ সেই ব্রেইন এর ভিতর করতে থাকে। মাদক গ্রহণকারীরা এসব বিষয়ে মোটেও টের পায়না। তারা এসব বিষয়ে খুব বেশী ওয়াকিবহালও থাকেন না। আনন্দ করতে করতে কেউ কেউ যখন মনে করেন এবার বাদ দিতে হবে, তখন তারা সেটা পারেন না। কিংবা হঠাৎ কোনো কারণে কেউ যদি মাদক নিতে না পারেন তখন টের পান মাদক ইতোমধ্যে কতদূর পর্যন্ত পৌঁছেছে।

মাদক  বারবার  নেবার কারণে মানুষের ব্রেইন এর এই অতিরিক্ত কেমিকেলগুলো (ডোপামিন, সেরোটোনিন বা গ্লুটামেট -এর মতো কেমিকেলগুলি) ব্রেইনের বেশ কিছু সার্কিট বা চক্রকে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে পরিবর্তন করে দেয়।

মাদকের অভ্যাসগুলো দীর্ঘদিন যাবত চলতে থাকে। আনন্দ ও মোটিভেশন, এ দুটি চক্র বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই নেশার মাধ্যমে, বারবার আনন্দ পাবার বিষয়ে মানুষটি অভ্যস্ত হয়ে উঠে। আনন্দ পাওয়ার চক্রটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেকারণেই মানুষ নেশা ছাড়তে পারেনা এবং অভ্যাসগুলো দীর্ঘদিন যাবত চলতে থাকে।
মানুষ প্রাথমিকভাবে নিজের ইচ্ছায় মাদক নিলেও, ব্রেইন এর এসব পরিবর্তনের ফলে এবং শারীরিক বিভিন্ন ক্ষতি হবার পরও বাধ্য হয় বারবার নেশা বস্তু গ্রহণ করতে। দু:খজনক হলো, মাদক ব্রেইন এর কাঠামোগত ও ফাংসনাল/কার্যক্ষমতা দু’ধরনের পরিবর্তনই করে থাকে। ফলে মানুষের আচরণেও পরিবর্তন আসে। ইয়াবা বা এ জাতীয় কিছু কিছু নেশাবস্তু আছে, যারা ব্রেইন এর ডোপামিন বহনকারী নিউরন এর গঠন পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলতে পারে।

সুতরাং এটা বুঝা খুব সহজ যে, পরিবর্তিত নিউরন আর আগের মতো স্বাভাবিক ব্রেইন কেমিকেল তৈরি করতে সক্ষম হয় না। মানুষ আরো বেশি করে বাইরে থেকে এসব কেমিকেলের ঘাটতি পূরনের জন্য তাগিদ অনুভব করে। এবং বারবার নেশাদ্রব্য বা মাদক খুঁজে বেড়ায়।

মনের খরব ডেস্ক

Previous articleমাদক মানেই কেমিকেল
Next articleমন ও ফ্যাশন ডিজাইন
চেয়ারম্যান, মনোরোগবিদ্যাি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here