মনের সুস্থতায় যে কথাগুলো জাদুর মতো কাজে আসে

আপনি যদি মনে করেন আধুনিক জীবনের গতি অনেক কঠোর এবং অপ্রতিরোধ্য, তাহলে হয়তো আপনি কিছু প্রজ্ঞা ও অনুপ্রেরণার জন্য জাপানের দিকে তাকাতে পারেন।

মারি ফুজিমোটো এ ব্যাপারে “ইকিগাই অ্যান্ড আদার জাপানিজ ওয়ার্ডস লিভ বাই” নামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে বলা হয়েছে জাপানের যেসব শব্দ জীবনকে সহজ করে তোলে।

জাপানের গ্রামে বেড়ে ওঠা ফুজিমোটো একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভাষাবিদ সেইসঙ্গে নিউইয়র্ক সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানি স্টাডিজের পরিচালক।ফুজিমোটোর মতে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনটাকে দেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ, এভাবে আরেক রকমের জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়।ফুজিমাটো বিশ্বাস করেন, অন্য সংস্কৃতির কিছু শব্দ বা বাক্যাংশ জীবন নিয়ে বড় ধরণের উপলব্ধি অর্জনে সাহায্য করতে পারে।

“পশ্চিমের দেশগুলোয় সবার ঝোঁক থাকে সব ব্যাপারে পারফেক্ট বা পরিপূর্ণ হতে এবং আমরাও চাই যেন আমাদের সবকিছু নিখুঁত হয়। অন্য মানুষের প্রত্যাশা পূরণে আমাদের যতটা সম্ভব তা করতে হবে। কিন্তু আমরা একটু থেমে চারপাশে তাকাতে পারি এবং যেটাকে আমরা সচরাচর স্বাভাবিকভাবে নিতে চাইতাম না এবার সেটাকে তার মতো করে মেনে নিতে পারি। যেমন: বয়স বেড়ে যাওয়াকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি।”

এক্ষেত্রে ফুজিমোটো তার সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে একটি পথ দেখিয়েছেন যা বিদেশীদের কাছে সেকেলে মনে হতে পারে।তিনি মূলত ৪৩টি ভিন্ন ভিন্ন জাপানি চিন্তা-ধারণার কথা বলেছেন। যেগুলো সারা পৃথিবীর মানুষকে ভিন্নভাবে বাঁচতে সাহায্য করবে। এর মধ্যে থেকে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কয়েকটি ধারণা উল্লেখ করা হল:

মুগন-নো জিও: নীরবতার পুরষ্কার

মুগন-না জিও এর অর্থ হচ্ছে “নীরবতার অনুশীলন”। এটি মূলত নীরব ধ্যানের অনুশীলন যা আপনাকে কোন কাজ করার আগে কিছু সময় দেয়। যেন আপনি প্রতিক্রিয়া দেখানোর পরিবর্তে কাজ করতে পারেন। শান্তভাব বা নিস্তব্ধতা হল এমন একটি বিষয় যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা উপাদানগুলিকে গ্রহণ করতে বা যেকোনো সংঘাতময় পরিস্থিতিতে শ্রদ্ধাশীল থাকতে সাহায্য করে।

শিবুই: সময়ের সাথে সাথে যে সৌন্দর্য প্রকাশ পায়

আমাদের বয়সের সাথে সাথে যে-বিষয়গুলোর উন্নতি হয়, সেগুলোকে কদর করা, এই শব্দটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়।”, লিখেছেন ফুজিমোটো। “বয়স হওয়ার মধ্যেও একটি মাধুর্য আছে, এবং জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো সুখ সমৃদ্ধির চিহ্ন রেখে যায়। শীতের শুরুতে গাছের প্রথম পাতাগুলোর রং অথবা একটি টেবিলে পুরানো চায়ের কাপ থেকে আপনি শিবুইয়ের অভিজ্ঞতা পেতে পারেন।”

ফুকিনসেই: অসমতাই সৌন্দর্য

সমান্তরাল বা ভারসাম্য যেকোনো বিষয়, পারফেকশন বা পরিপূর্ণতাকে প্রতিনিধিত্ব করে। তবে মানুষের জীবনে এই তত্ব কাজে আসেনা।

– যদি আপনি শান্তি এবং সুখ খোঁজেন, তাহলে আপনার অপরিপূর্ণতা বা অসমতাকে আলিঙ্গন করাই ভালো হবে। একেই বলে ফুকেনসেই।

ফুজিমোটো বলছেন যে “সৌন্দর্যের অপরিহার্য উপাদানগুলো মধ্যে রয়েছে সমান্তরাল বিন্যাস, কম্পোজিশন অর্থাৎ মাপে মাপে সাজানো, যৌবন এবং প্রাণবন্তটা।”

কিন্তু এই “ইতিবাচক” গুণগুলির প্রতি খুব আকৃষ্ট হওয়ার মাধ্যমে আমরা অন্যান্য “বিরোধিতামূলক গুণাবলি যেমন – কুশ্রীতা, অসম্পূর্ণতা, বয়স ও মৃত্যু – যা পশ্চিমা বিশ্বের কাছে বিরক্তিকর বলে বিবেচিত হয়” সেগুলো থেকে সরে যাচ্ছি।

অথচ ফুজিমোটো বলেন, জাপানের এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যা পাওয়া গিয়েছে প্রকৃতির অনস্বীকার্য সত্যের মাঝে। যেখানে সবকিছু ক্ষণস্থায়ী, কিছুই স্থায়ী হয় না এবং কোন কিছুই নিখুঁত নয়।

ফুজিমোটো বলেছেন, যেকোনো প্রকার শিল্পের মধ্য এই অসমতার প্রতিফলন অবশ্যই হওয়া উচিত । যেন জীবনের বিকল্প সম্ভাবনাগুলোর ক্ষেত্র তৈরি হয়। “জীবনের বৈচিত্র্যময় সব বর্ণের মধ্যেও সৌন্দর্য রয়েছে, সেটা হতে পারে জন্ম থেকে মৃত্যু, অপরিপূর্ণতা থেকে নিখুঁত, কুশ্রী থেকে সুশ্রী।”

তেইনেই: সৌজন্যটা প্রকাশ করুন মনোযোগের মাধ্যমে

তেইনেই এর অনুবাদ হতে পারে, “ভদ্রতা”, এর অর্থ কেবল বিনয় নয়। তার বাইরেও অনেক কিছু। এটি মূলত অন্যের প্রতি আপনার শ্রদ্ধাবোধকে নির্দেশ করে – আপনার আচরণে মাধুর্য এবং চিন্তাশীলতা থাকা এবং আপনার আশেপাশের মানুষকে বিরক্ত না করে আপনি যেভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ করছেন- সেটাকে বোঝায়।

তেইনেই হল এক ধরণের বিনয়ী মনোভাব, যেখানে প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি নিষ্ঠা এবং স্পষ্টতার সাথে সঞ্চালিত হয় -এবং আচরণের ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নশীল হওয়া যেন আপনি আপনার আচরণের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করতে পারেন।

মোনো নো অ্যাওয়্যার: সৌন্দর্যের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতি

মোনো নো অ্যাওয়্যার হল সৌন্দর্যের অস্থায়ী রূপ: চুপিচুপি উল্লাস করা, টক মিষ্টি ঝাল অনুভূতি, জীবনের ঝলমলে সার্কাস প্রত্যক্ষ করা। – এগুলোর কোনটাই স্থায়ী হবে না, সেটা জানা সত্ত্বেও সেগুলো উপভোগ করা।

দক্ষিণ আফ্রিকার শিল্পী ডেভিড বাখলার বলেছেন, “এটি মূলত ক্ষণস্থায়ীত্বের ব্যাপারে সেইসঙ্গে জীবন ও মৃত্যুর ব্যাপারে মানুষকে দু: খিত এবং কৃতজ্ঞ হওয়াকে বোঝায়।”

তিনি বলেন, “জাপানে, চারটি স্বতন্ত্র ঋতু রয়েছে,” এবং আপনি সত্যিই জীবন, মৃত্যু এবং ক্ষণস্থায়িত্বের সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। সেই মুহূর্তগুলি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সে ব্যাপারে আপনি অবগত হয়ে যান।”

শোগানাই: যেসব ঘটনা আপনি পরিবর্তন করতে পারবেন না সেগুলো গ্রহণ করে নেয়া

আক্ষরিক অর্থে “এখানে কোন উপায় বা পদ্ধতি নেই”, শোগানাই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মাঝে মাঝে আমাদেরকে কিছু বিষয়, যেমন আছে তেমনিভাবেই গ্রহণ করতে হয়। যা আমাদেরকে নেতিবাচক অনুভূতি ঝেড়ে ফেলতে সাহায্য করে।

একটি দেশের জলবায়ু দেশটির শব্দভাণ্ডারকে কতোটা প্রভাবিত করতে পারে সেটা বইয়ে জোর দিয়ে বলা হয়েছে। ফুজিমোটো বলছে, “জাপান একটি ছোট দেশ, দ্বীপটিতে বসবাসের মতো স্থান খুব সীমিত এবং এর চারপাশ সমুদ্র দিয়ে ঘেরা।”

“প্রাক-আধুনিক জাপানে বসবাসের পরিস্থিতি বেশ কঠিন ছিল। মানুষকে এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে বসবাস করতে হবে তা শিখতে হয়েছিল – প্রকৃতি যা দিচ্ছে বা দেবে সে ব্যাপারে আপনি সবসময় বিরক্ত হতে পারেন না।

বিপর্যস্ত হওয়া বা প্রতিরোধের চেষ্টা করার পরিবর্তে, ওই পরিস্থিতিকে কদর করে যা আছে তার সঙ্গে মানিয়ে চলাটাই বিচক্ষণ উপায় বলে বইটিতে উল্লেখ করা হয়।”

ফুজিমোটো লিখেছেন, “আমার মনেহয় টাইফুনের কথা যেটা সব ফসল ধ্বংস করে দিয়েছিল। আর একটি প্রকাণ্ড ভূমিকম্পের কথা মনে হয় যেটা আমার দেশের হাজার হাজার মানুষের প্রাণ নিয়ে গেছে। কিন্তু এরইমধ্যে জাপানিরা তাদের জীবনযাপনের বিকাশ ঘটিয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তারা জীবনযাপন করে।”

জাপানের এই দর্শন শিন্টোর হৃদয়ে আসন গেড়েছে। শিন্টো হল জাপানি মানুষের প্রাচীন আদিবাসী আধ্যাত্মিকতা। এই বিশ্বাস পদ্ধতি বিকশিত হওয়ায় জাপানিরা আজ সৌন্দর্যের এতো প্রশংসা করতে পারে।

কোদাওয়ারি: খুঁতখুঁতে হওয়া

কোদাওয়ারি বলতে এমন এক মানসিকতাকে বোঝায় যেখানে কোন বিষয়ের সূক্ষ্মতার ব্যাপারে দৃঢ় মনোযোগ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে স্বভাবও হয় খুঁতখুঁতে।

এই ব্যাপারগুলো মূলত আসে ব্যক্তির আন্তরিকতা ও শৃঙ্খলা-বোধ থেকে। তাদের এই প্রচেষ্টার বেশিরভাগের কোন স্বীকৃতি দেয়া হবেনা এমনটা জানা সত্ত্বেও তারা এই শ্রম দিয়ে থাকেন।

কোদাওয়ারি শব্দটি এক বিশেষ ধরণের ব্যক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ব্যবহার করা হয় যারা তাদের সারা জীবনে একনিষ্ঠভাবে নিজেদের শিল্পবিদ্যার পেছনে ব্যয় করে।

ইউগেন: রহস্যময় এবং গভীর বিষয়গুলোকে সামনে আনা।

ইউজেন হল এমন এক ধরণের সৌন্দর্য যা কথার সারমর্ম থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এটি মূলত সরাসরি কথা বলার ক্ষমতার চাইতে, কথা প্রকাশ করার ক্ষমতাকে মূল্যায়ন করে।

এটি ঐতিহ্যবাহী জাপানি নান্দনিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা: যদিও শব্দটির অর্থ “ধীর”, “গভীর” বা “রহস্যময়” হতে পারে, এটি কেবলমাত্র সূক্ষ্মতা ও গভীরতা বর্ণনা করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

ইউজেনের নীতি অনুযায়ী, প্রকৃত সৌন্দর্য তখনই ধরা দেয় থাকে যখন কয়েকটি শব্দে সেটার গভীরতা প্রকাশ পায়।নঠিক যেমনটা কয়েকটা তুলির আঁচড়ে শিল্পকর্ম ফুটে ওঠে। এর মাধ্যমে উন্মোচিত হয় যে কোন বিষয়টি বলা বা দেখানো হয়নি। যা অনেক অভ্যন্তরীণ চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।

ইউজেন গভীরভাবে কানসোর ধারণার সাথে যুক্ত। কানসো হল মানুষ সচরাচর যা দেখে তার থেকে বাইরের কিছু গভীরভাবে উপলব্ধি করা।”

সূত্র: বিবিসি

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন’

Previous articleবর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার
Next articleকোয়ারেন্টাইন যেভাবে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here