অন্যান্য জৈবিক চাহিদাগুলোর মতো যৌন চাহিদাও আমাদের জীবনে স্বাভাবিক বিষয়। মানব জাতির বংশপরম্পরায় ধারা টিকিয়ে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আমাদের যৌন চাহিদা।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ নানা কারণে যৌনতাকে খুবই নেতিবাচকভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়। যার জন্য খোলামেলাভাবে যৌনতা এবং সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যায় না। যৌনতাকে খুব খারাপ এবং গোপনীয় একটা ব্যাপার বলে আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়।
আমাদের মধ্যে সাধারণত ২ কারণে যৌন সমস্যা দেখা দিতে পারে-
প্রাইমারি সেক্সুয়াল: এটা শারীরিক বা মেডিকেল সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। ফলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়। যেমন এসটিডি, এসটিআই ইত্যাদি।
সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল: মানসিক কারণে এ সমস্যা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বেশিরভাগ যৌন সমস্যা হলো সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল প্রবলেমন্স। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে মনোযৌন সমস্যা বলা হয়। আর এটার অন্যতম কারণ হলো যৌনতা সম্পর্কে কুসংস্কার।
পুরুষদের মনোযৌন সমস্যাগুলো এবং যৌনতা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা আলোচনা করব। পুরুষদের মনৌযৌন সমস্যাগুলো-
যৌন আকাঙ্ক্ষার অভাব: পুরুষদের মধ্যে যৌন উত্তেজনা আসে এবং যৌন সুখ লাভ করেন কিন্তু তাদের যৌন কাজের প্রতি আগ্রহ তীব্রভাবে কমে যায়। নিজের মধ্যে যৌন আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণে সঙ্গীর সবধরনের যৌন আবেদন বা আচরণ তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করে এবং পুরুষ নিজ উদ্যোগী হয়ে কখনও সঙ্গীর সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হয় না।
অনেক নারী অভিযোগ করে থাকেন যে তাদের স্বামী তাদের সঙ্গে যৌন মিলন না করলেও তাদের সামনেই হস্তমৈথুন করে। একজন নারী এ ধরনের আচরণ কখনও মেনে নিতে পারে না এবং এতে করে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ শুরু হয় যেটা অন্যান্য ছোটখাট বিষয় দিয়ে প্রকাশিত হয়। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক কলহ, ঝগড়াঝাঁটি, বিষণ্ণতা, সঙ্গীর প্রতি সন্দেহবাতিকতা ইত্যাদি কারণে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ইরেক্টাইল ডিসফাংশন: সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সহবাস করার জন্য বা যোনিপথে লিঙ্গ প্রবেশ করানোর জন্য লিঙ্গ প্রয়োজনীয় পরিমাণ শক্ত হয় না। আদর করার পরও তাদের লিঙ্গ শক্ত হয় না অথবা হলেও যোনিতে লিঙ্গ প্রবেশ করানোর সময় লিঙ্গটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
এতে করে লিঙ্গ যোনিতে ঢোকে না অথবা ঢোকাতে পারলেও বীর্য বের হওয়ার আগেই লিঙ্গ নিস্তেজ হয়ে যায়। ফলাফল সঙ্গীকে চূড়ান্ত যৌন সুখ দিতে পারে না। ৭-১৮ শতাংশ পুরুষদের মধ্যে জীবনে কোনো না কোন সময়ে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটাকেই মূলত পুরুষত্বহীনতা বলা হয়।
শৈশব নির্যাতন অথবা যৌন আঘাত, দীর্ঘমেয়াদি চাপ, সঙ্গীকে যৌনসুখ না দিতে পারার অপরাধবোধ, বিষণ্নতা, দাম্পত্য কলহ ইত্যাদি কারণে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন হতে পারে।
দ্রুত বীর্যপাত: মাস্টার অ্যান্ড জনশন, সেক্স থেরাপিস্ট (১৯৭১) এর মতে, পুরুষদের মধ্যে এটা খুবই কমন সমস্যা। এখানে যৌন আদরের কারণে পুরুষদের লিঙ্গ উত্থিত হয় কিন্তু যৌন সহবাসের নিমিত্তে নারীর যোনিপথে লিঙ্গ প্রবেশ করানোর পরপরই বীর্য বের হয়ে যায়। সময়ের হিসেবে বললে ১ মিনিটের ও কম সময়ের মধ্যে অর্গাজম হয়ে যায়। যদিও যৌনসঙ্গমের নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। তবুও যদি দ্রুত বীর্যপাত হয়ে যায় তাহলে সঙ্গীর মনে হতে পারে যৌনসুখের সময়টা খুবই ক্ষণস্থায়ী ছিল বা পরিপূর্ণ/চূড়ান্ত সুখ লাভ করতে পারেনি।
এ রকম দ্রুত বীর্যপাত নারী এবং পুরুষ দুজনের জন্যই চরম লজ্জাকর ও হতাশাজনক হতে পারে। ৩০-৪০ শতাংশ পুরুষের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এ সমস্যা হতে পারে। কারো মধ্যে এ সমস্যাটা ৬ মাস ধরে থাকলে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীদের শরণাপণ্ন হওয়া দরকার।
যদিও এর সঠিক কারণ এখনও অজানা তবুও মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা, সঙ্গীকে সুখী করতে না পারার জন্য দোষী, নিজের শরীরের ইমেজ নিয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাব, যৌন সহবাসের সময় সম্পর্কে ভুল ধারণা ইত্যাদি কারণে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বিলম্বিত বীর্যপাত: এটা পুরুষের এমন একটি সমস্যা যেখানে দীর্ঘক্ষণ যৌনসঙ্গম করার ফলেও বা বীর্যপাত হয় না। এতে করে পুরুষ কখনও ক্লাইমেক্স বা চরমপুলক লাভ করে না। ওদিকে সঙ্গীর অর্গাজম হয়ে যায় (শারীরিক স্বাভাবিক অবস্থা)।
কিন্তু পুরুষের বীর্যপাত খুবই দেরিতে হওয়ার কারণে নারী সঙ্গীর অবস্থা তখন ভয়াবহ হয়ে যায়। এ অবস্থা যদি কোনো পুরুষের মধ্যে ৬ মাসের বেশি সময় ধরে থাকে তাহলে মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা জরুরি। এ সমস্যার কারণে অনেক নারী বিবাহবিচ্ছেদ ঘটায়। কিন্তু এটার চিকিৎসা করলে সুফল পাওয়া যায়।
যৌন বিতৃষ্ণা: যৌন সঙ্গমের প্রতি অনীহা, ঘৃণা, অপমান, লজ্জা আত্মসম্মানের সঙ্গে জড়িত থাকে। এ বিতৃষ্ণা যে কোনো স্পেসিফিক কাজ যেমন ওরাল সেক্স অথবা যৌনিতে লিঙ্গ ঢুকানো নিয়ে হতে পারে, এটা হতে পারে বীর্যের গন্ধ, চুমু দেয়ার সময় লালার গন্ধের প্রতি। এটা হতে পারে সঙ্গীর যৌন অঙ্গ যেমন স্তন বা যোনির প্রতি। এটা হতে পারে যৌন সঙ্গম করার সময় সঙ্গীর বিভিন্ন শব্দের প্রতি।
কোনো পুরুষের মধ্যে এ সমস্যা থাকলে সেটা তাদের সঙ্গীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কটা খারাপ করে দিতে পারে। তাদের ভালো যৌন সম্পর্ক হয়ে উঠে না। সম্পর্কটা তখন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়। এ অবস্থা যদি কারও মধ্যে ৬ মাস চলতে থাকে এবং এজন্য যদি তাদের বৈবাহিক সম্পর্কে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তাহলে এটা যৌন বিপর্যয় ডিসঅর্ডার।
চিকিৎসা: আমাদের দেশে যেহেতু যৌন সমস্যা বা রোগ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয় না তাই অনেকেই অপচিকিৎসার ফাঁদে পড়ে। যার কারণে যৌন জীবন পুরোটাই শেষ হয়ে যেতে পারে। তাই কারো মধ্যে উপরোক্ত যৌন সমস্যাগুলো দেখা দিলে সরাসরি ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া দরকার।
আপনি যদি নিশ্চিত থাকেন আপনার যৌন সমস্যাটা শারীরিক কোনো কারণে নয়, তাহলে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে দেখা করুন। তবে মনোবিজ্ঞানীদের কাছে প্রথমে স্বামী গেলেও চিকিৎসার ধাপে ধাপে স্ত্রীকেও যেতে হতে পারে।
বলা হয়ে থাকে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যতই সমস্যা থাকুক, মতের অমিল থাকুক, চাওয়া পাওয়া না মিলুক, কিন্তু দিন শেষে তাদের মধ্যে চমৎকার একটা রোমান্টিক যৌন-সম্পর্ক বাকি সব সমস্যাকে গৌণ করে দিতে পারে। যৌন সম্পর্ক শুধুই শারীরিক নয়, মানসিকও। তাই আপনাদের মধ্যে কারও যৌন সমস্যা থাকলে মনোবিজ্ঞানীর সহযোগিতা নিন, যৌন জীবন উপভোগ করুন।