প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতা

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়েদের যে কয় ধরনের মানসিক সমস্যা হয়, সেসবের তীব্রতার হেরফের হলেও কোনটির ভয়বহতাকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। প্রত্যেকটিই মা ও শিশু, দুজনের জন্যই ক্ষতিকর ও অস্বস্থিকর। কখনো কখনো জীবন ঝুকিপূর্ণও হয়ে উঠতে পারে। আশার কথা, প্রয়োজনীয় তথ্য জানা থাকলে অত্যন্ত সাবলীল ও সহজভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব।
প্রসব পরবর্তী মায়েদের মানসিক সমস্যাগুলো তীব্রতার ভেদে হেরফের হলেও এসব সমস্যা কোনটিকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। প্রতিটি সমস্যাই মা ও সন্তানের জন্য ক্ষতিকর ও অস্বস্থিকর। এসব সমস্যা থেকে কখনও কখনও জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তবে প্রয়োজনীয় তথ্য জানা থাকলে সময়মতো সাবলীল ও স্বাচ্ছন্দে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা সম্ভব।
পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন বা পোস্ট পার্টাম মুড ডিজঅর্ডার
এই দুটো নামেই সমস্যাটিকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। ঝুঁকি অথবা ভয়াবহতার দিক বিবেচনা করলে প্রসব পরবর্তী মানসিক সমস্যাগুলোর মধ্যে এর অবস্থান দ্বিতীয়। সন্তান জন্মদান পরবর্তী শতকরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মায়ের এ সমস্যা দেখা যায়। সাধারণত সন্তান জন্মদানের তিন মাসের মধ্যেই এসব সমস্যা শুরু হয়ে থাকে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এটি দুই বা তিন সপ্তাহের মধ্যেই শুরু হতে পারে। ভয়াবহতা ও স্থায়িত্ত্বের দিক থেকে পোস্ট পার্টাম ব্লু থেকে এর মাত্রা অনেক বেশি।
কি হয়?
অন্য বিষণ্নতার সাথে প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতার লক্ষণের ধরণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। দুটো ক্ষেত্রেই লক্ষণ ও উপসর্গগুলো প্রায় একই থাকে। যেমন- মন খারাপ থাকা, অকারণে কাঁদতে ইচ্ছা হওয়া, কোনকিছু ভালো না লাগা, কোন কিছুতে মন না বসা, আগের ভালো লাগা বিষয়গুলো আর ভালো না লাগা, ঘুম না আসা, ঘুমের স্থায়িত্ত্ব কমে যাওয়া, অতিরিক্ত দূর্বল লাগা, খাওয়ায় অনীহা, ঘনঘন মৃত্যু চিন্তা আসা, এমনকি আত্মহত্যার মতো চিন্তাও মনে আসা।
এক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা হলো বেশিরভাগ সময়ই মা তার সন্তানের স্বাস্থ্য ও সুস্থতা নিয়ে এক ধরণের অস্থিরতায় ভুগে থাকেন। এমনকি সন্তানের ব্যাপারে কিছু আজেবাজে চিন্তা যেমন, ‘যদি সন্তানটিকে মেরে ফেলি’ অথবা ‘যদি কোন ক্ষতি করে ফেলি’। এমন সব কষ্টদায়ক ও অস্বস্থিকর চিন্তা বারবার মাথায় আসতে থাকে।
‘পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন’ এর কারণে মা ও শিশু দুজনেরই প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সুবিধা
আমাদের দেশে এমন সমস্যার ক্ষেত্রে মায়েরা অন্যদের কাছ থেকে ভালোই সাহায্য ও সহযোগীতা পেয়ে থাকে। বিশেষ করে আত্মীয় পরিজনদের থেকে। সেজন্য অনেক কষ্ট হলেও সবাই মিলে এমন সমস্যা মোকাবেলায় বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করে থাকে। নিঃসন্দেহে আমাদের দেশ বা আমাদের সমাজব্যস্থার এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ ও সুবিধাজনক দিক। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশের মায়েরাই এমন সাহায্য, সহযোগিতা বা সহমর্মিতা পান না।
তবে আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক সুবিধা কাজে লাগানোর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নেয়া জরুরি। তাতে মা বা সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুঁকি থেকে নিরাপদ থাকার পাশাপাশি মায়ের কষ্টও কমে আসবে। 
কেন হয় এ রোগ?
প্রসব পরবর্তী বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তনের কারণে বিষণ্নতা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। প্রসব পরবর্তী ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন ও কর্টিসোল হরমোনের মাত্রা অনেক কমে আসে। এদিকে কম ঘুম বা ঘুম ভেঙ্গে সন্তানকে খাওয়ানো বা অন্যান্য দেখাশোনার কারণে পরিপূর্ণ ঘুম অনেক সময় না হওয়ার কারণেও এ সমস্যা হতে পারে। অপূর্ণ বা অপর্যাপ্ত ঘুম এবং সেই সাথে ক্লান্তি এ দুটোকে অনেকে প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতার একটি সহযোগি কারণ বলে মনে করে থাকেন।
যে সব মায়েরা পারিবারিক সহযোগিতা কম পেয়ে থাকে, অথবা আগে কোন না কোন মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে তাদের ক্ষেত্রে প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতার সম্ভাবনা বেশি হয়ে থাকে। যেসব মায়েদের আগে বিষণ্নতার ইতিহাস আছে কিংবা পরিবারের কারো মধ্যে বিষণ্নতার ইতিহাস আছে তাদের ক্ষেত্রে এ সমস্যার ঝুঁকির মাত্রা বেশি হয়ে থাকে। এদিকে যেমন মায়েদের ‘পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন’-এ আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস আছে তাদের ক্ষেত্রে প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯০ শতাংশ।
চিকিৎসা ও সতর্কতা
‘সন্তান জন্মদানের পর এমন সমস্যা হতেই পারে’ এমন ধারণা অনেকের মধ্যেই দেখা যায় যা মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। বরং এ ধরণের সমস্যায় চিকিৎসা না হওয়াটা মা ও সন্তান উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। তবে এর সাথে একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে, অন্য যেকোন শারীরিক কারণ বা সমস্যাগুলোকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সাধারণ বিষণ্নতার চিকিৎসার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। তবে চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করার আগে সদ্যোজাত সন্তানটির কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রথমবার এমন সমস্যায় আক্রান্ত হওয়া মায়েদের ক্ষেত্রে এর চিকিৎসা ছয় মাস থাকে এক বছর পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া উচিত। চিকিৎসা যতো তাড়াতাড়ি শুরু হবে, চিকিৎসার ফলাফল তত ভালো হবে। আবার যারা আগেও এমন সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসার সময় দীর্ঘতর হতে পারে। মনে রাখতা প্রয়োজন বিনা চিকিৎসার মতো অসম্পুর্ণ চিকিৎসাও মা ও সন্তান উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। এমনকি হত্যা বা আত্মহত্যার মতো ঘটনাও এর থেকে ঘটতে পারে।
আরেকটি অতিপ্রয়োজনীয় তথ্য হলো, এসব ক্ষেত্রে যেহেতু দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠা উচিত বা সুস্থ হয়ে উঠতে পারলে শিশুটির সেবা দ্রুত নিশ্চিত করা যায় তাই দ্রুত চিকিৎসার ক্ষেত্রে ইসিটি (ECT) একটি অত্যন্ত ফলপ্রসু পদ্ধতি। ইসিটি একটি ঝুঁকিমুক্ত ও কার্যকরী পদ্ধতি, বিশেষ করে যেসব মায়েদের মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা দেখা যায়।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleকাজের সময়সীমা মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব রাখতে পারে
Next articleমানসিক স্বাস্থ্যসেবায় মোবাইল এপ
চেয়ারম্যান, মনোরোগবিদ্যাি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here