নিঃসঙ্গতম মানব!

এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সাত জন মানব নিঃসঙ্গতার সর্বোচ্চ দূরত্বে পৌঁছেছেন। এটা ভেবে অবাক হচ্ছেন যে কেন ও কিভাবে এত নিশ্চিত ভাবে এই সাতজন মানুষের কথা বলা হচ্ছে? ভেবে দেখুন চন্দ্রযান এ্যাপোলো ১১ তে চড়ে তিনজন মানুষ প্রথমবারের মতো চাঁদে যাচ্ছে। চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছানো মাত্রই মূলযান কলম্বিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দু’জন নেমে গেলেন চাঁদের বুকে। কলম্বিয়াতে থেকে গেলেন কমান্ড মডিউল পাইলট মাইকেল কলিন্স। এবার আরো আড়াই হাজার মাইলের অধিক তাঁকে যেতে হবে সম্পুর্ণ একা। এবার বলুন তো সাধের এই পৃথিবী ছেড়ে, চেনা পরিবেশ চেনা মানুষ ছেড়ে, একাকী প্রায় আড়াই লক্ষ মাইল দূরে আর কে গিয়েছে?
হ্যাঁ, কলিন্সের পদাংক অনুসরণ করে অন্যান্য এ্যাপোলো মিশনে আরো গিয়েছেন ছয়জন পাইলট। রেকর্ড বইয়ে যাদের নামের পাশে উল্লেখ আছে “মোস্ট আইসোলেটেড হিউম্যান বিং”। যাদের মধ্যে পাঁচজন এখনও জীবিত রয়েছেন। তাঁদেরী একজন হলেন এ্যাপোলো ১৫-এর আলফ্রেড ওয়ার্ডেন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ওয়ার্ডেন আরো দুই সঙ্গীসহ চাঁদের কক্ষপথের দিকে রওনা দেন। আসুন ওয়ার্ডেনের মুখে আমরা শুনি সেই বিচ্ছিন্নতার সময়ের অভিজ্ঞতা ও মনের অনুভূতির কথা।
আপনার কি মনে হয়না যে চাঁদে অবতরণকারীগণ যতটা আলোচনায় আসেন, কমান্ড মডিউলে থেকে যাওয়াগণ ততটা আসেন না?
এটা ঠিক যে চাঁদে অবতরণকারীদের দিকে মানুষের আগ্রহ যতটা থাকে কমান্ড মডিউলের পাইলটদের দিকে সে আগ্রহ থাকে না। কিন্তু তাই বলে আমাদের কাজও কিন্তু কম নয়। অবতরণকারীগণ চাঁদের বুকে যখন পাথর কুড়াতে থাকেন তখন আমাদের কাজ থাকে চাঁদের কক্ষপথে থেকে চাঁদের মানচিত্র তৈরি করা, প্রয়োজনীয় ফটোগ্রাফ নেয়া ইত্যাদি প্রচুর তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয় খুবই অল্প সময়ের মধ্যে।
চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছানোর পর লুনার মডিউলটি যখন মূল যান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আপনার দুই সঙ্গীকে নিয়ে চাঁদের বুকে নেমে যেতে থাকলো আর আপনি জানালা দিয়ে দিয়ে দেখতে লাগলেন লুনার মডিউলটি আপনার দুই সঙ্গীকে নিয়ে ধীরে ধীরে ছোট  হচ্ছে। তখন আপনার মনের অনুভূতি কি ছিল?
প্রথমে যেটি মনে এসেছিল তা হলো, আশাকরি তারা ভালোভাবে চাঁদের বুকে নামতে পারবে। দ্বিতীয় যা ভেবে তৃপ্ত হয়েছিলাম তা হলো, আমি আমার কাজ এখন পর্যন্ত সফল ভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি এবং যানটি সঠিক কক্ষপথে রয়েছে।
এটা কি নিঃসঙ্গতা ছিল না?
এখানে দুটি বিষয় রয়েছে। একটি হলো একাকীত্ব, আরেকটি হলো নিঃসঙ্গতা। এবং দুটো সম্পুর্ণ ভিন্ন জিনিষ। সেখানে আমি একাকী ছিলাম কিন্তু নিঃসঙ্গ ছিলাম না। এখানে হয়তো আমার অভিজ্ঞতা আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। প্রথমে আমি ছিলাম যুদ্ধ বিমানের একজন পাইলট। পরবর্তীতে পরিক্ষামূলক বিমানের পাইলট হিসেবে কাজ করি, যে বিমানগুলোর সবগুলোই ছিল যুদ্ধ বিমান। যার কারণে নিজের সাথে থাকার ব্যাপারে আমি আগের থেকেই অভ্যস্ত ছিলাম এবং ব্যাপারটি আমি উপভোগই করতাম। এমনকি কক্ষপথে থাকা অবস্থায় ডেভ ও জিমকে একবার ‘হাই’ বলা ছাড়া আর কোনো কথোপকথনও হয় নি। এছাড়াও হিউস্টনের সাথেও সে সময় আমার যোগাযোগের আগ্রহ ছিল না।
ঘর থেকে আপনি প্রায় আড়াই লক্ষ মাইল দূরে রয়েছে একাকী, এই অনুভূতি আপনাকে আলোড়িত করেনি?
হ্যাঁ, এতদূরে যাওয়ার ব্যাপারটি তো আলোড়িত করেছেই, তবে সবচাইতে বেশি আলোড়িতে করেছে যে বিষয়টি সেটি হলো আমি এখন চাঁদের কক্ষপথে রয়েছি এই অনুভূতিটি। আরেকটি বিষ্ময়কর অনুভূতি হলো চাঁদের কক্ষপথ থেকে পৃথিবীর উদয় দেখা। তাছাড়া চাঁদের কক্ষপথে থেকে আকাশের তারা বা আমাদের গ্যালাক্সি দেখার ব্যাপারটিও ছিল সম্পুর্ণ ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। যা মহাবিশ্বের ব্যাপারে আমার ধারণা বদলে দেয়।
মহাবিশ্বের এই ব্যাপকতা আপনাকে কি আরো ক্ষুদ্র বা আরো বেশি নিঃসঙ্গ ভাবায়নি?
হ্যাঁ, আমি বলবো আপনি নিজের তুচ্ছাতাকে জানতে চান? তাহলে কিছু সময়ের জন্য চাঁদের কক্ষপথে থেকে আসুন। তাহলে আপনি সত্যিই অনুভব করতে পারবেন যে আপনি কতটা তুচ্ছ!
আপনি বলেছেন হিউস্টনের সাথে সে সময় আপনার যোগাযোগ করার আগ্রহ ছিল না। কেন?
আমার কানের কাছে সবসময় কেউ কথা বলুক এটা আমি চাইছিলাম না। আমার তখন প্রচুর কাজ ছিল। আমি চাইছিলাম আমার কাজগুলো শেষ করতে। তাছাড়া যদি বিশেষ প্রয়োজন হতো তাহলে অবশ্যই যোগাযোগ করতাম, কিন্তু সবকিছু ভালোমতোই চলছিল তাই যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি।
কেমন ব্যস্ততা ছিল আপনার? আমি আরো ভাবছি আপনি সেখানে থেকে পৃথিবী ও মহাবিশ্ব নিয়ে অনেক কিছু ভেবেছেন?
ব্যাপারটি মজার। যখন সেগুলো দেখেছি তখন কিন্তু এতকিছু ভাবার সময় পাইনি। ভেবেছি দেখে আসার পর। আসলে তখন ভাবার মতো সময়ও ছিল না। ২০ ঘন্টা করে কাজ করতে হতো তারপর ৪ ঘন্টা ঘুমানোর সুযোগ পেতাম।
অভিযানের সময় যানে করে আপনি কিছু গানের ক্যাসেট নিয়ে গিয়েছিলেন। সে প্রসঙ্গে কিছু বলুন।
আমাদের কাছে ছোট্ট একটি ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল যাতে যাত্রাকালীন আমরা গান শুনতে পারি। আমি মূলত বিটলের ফ্যান এবং এখনও তাই আছি। এছাড়াও কিছু এলটন জন, কিছু জন ডেনভার এবং ২০০১ এ স্পেস ওসিডি মুভির ব্লু দানিয়ুব ছিল।
আপনি মাত্র সাতজনের মধ্যে একজন যে সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় চাঁদের কক্ষপথে ছিলেন। ভবিষ্যতে যারা চাঁদে অথবা মঙ্গল গ্রহে যাবে তাদের প্রতি আপনার কোনো পরামর্শ রয়েছে কি?
যদিও একেক জনের অভিজ্ঞতা একেক রকম বলেই আমি মনে করি, তারপরও বলবো যারা মহাকাশ যাত্রায় যাবে তারা যেন তার সহযাত্রী বা ক্রুদের সাথে খুব বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না গড়ে ব্যাপারটি সম্পুর্ণ পেশাদারি মনোভাব থেকে নেয়। তাহলে তাদের জন্য অনেক কাজ সহজ হয়ে যাবে। কারণ যাত্রাপথে আপনাদের একটা দীর্ঘ সময় অন্য ক্রুদের খুব কাছাকাছি থাকতে হবে, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যেখানে জটিলতা তৈরি করতে পারে।
অন্তরঙ্গতা তৈরি না হলে তারা একসাথে কাজ করবে কিভাবে? এটা তো ৯টা ৫টা অফিস নয় যে অফিস শেষে সহকর্মীদের থেকে দূরে সরে গেলাম?
ঠিক সে কারণেই দূরত্ব রাখতে হবে। যখন আপনি বিরতি পাবেন তখন বিশ্রাম নিন তাহলে আপনার কাজে স্বাচ্ছন্দ পাবেন এবং একই সাথে একাকীত্বে অভ্যস্ততা তৈরি করতে পারবেন।
আমার ধারণা আমরা সবাই আশা করেছিলাম আপনি অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ একজন মানুষ, কিন্তু এক্ষেত্রে এটা অপ্রয়োজনীয় বলছেন কেন?
এ্যাপোলো ১২-এর ক্রুরা সবাই ছিল বন্ধুর মতো। কিন্তু আমরা ছিলাম তার বিপরীত। আমরা একসাথে প্রশিক্ষণ নিয়েছি, কিন্তু বন্ধুত্ব বলতে যা বোঝায় তা আমাদের মধ্যে হয়নি। এবং আমি মনে করি ঠিক এ কারণেই আমরা আরো বেশি সফল ভাবে আমাদের মিশন শেষ করতে পেরেছি।
আপনার সহযাত্রীদ্বয় ডেভ এবং জিম চাঁদে তাঁদের পায়ের ছাপ রেখে এসেছে যেগুলো হয়তো থাকবে লক্ষ বছর। আপনি কি এমন কোনো স্মারক রেখে এসেছেন?
যখন চাঁদের কক্ষপথে ছিলাম তখন আমাদের বেশকিছু বর্জ্য জমেছিল। ফেরার সময় বর্জ্যগুলো ফেলে দিয়ে আমরা কক্ষপথ থেকে বের হয়ে আসি। সম্ভবত সেগুলো এখনও সেখানে আছে। আবার যেহেতু চাঁদের যথেষ্ট পরিমাণ অভিকর্ষ বল নেই সেহেতু হতে পারে এতদিনে সেগুলো সব বিলীন হয়ে গেছে।
বিবিসি অবলম্বনে


 

Previous articleঘুমের কথা: পর্ব- ২
Next articleবিশ্বাসের রোগ ও রোগের বিশ্বাস

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here