২০১৮-১৯ সালের মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১৭% বা দুই কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নানা ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত৷ তাদের ১০০ জনের মধ্যে ৭ জন ভুগছেন বিষণ্ণতায় এবং তাদের ৯২ শতাংশই রয়েছেন চিকিৎসার আওতার বাইরে৷
আমাদের দেশে মনোরোগ এখনো ট্যাবু৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে না গেলে এটা নিয়ে আমরা মুখ খুলতে চাই না, চিকিৎসা তো দূরের কথা৷ মহামারির ধাক্কায় মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা মনের স্বাস্থ্য আরো খারাপ করে তুলেছে৷
গত বছর আগষ্টে ঢাকার একটি আবাসিক হোটেল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আদনান সাকিবের ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়৷ লাশের পাশে পড়ে থাকা চিরকুট থেকে জানা যায় ‘মানসিক চাপের’ কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন৷
পরের মাসেই ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহদী অপুর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হয় ঢাকার একটি মেস থেকে৷ লেখাপড়া শেষ করে যিনি চাকরির পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন৷ তার মৃত্যুর পর জানা যায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে পরীক্ষায় এমসিকিউ এবং লিখিত পরীক্ষায় তিনি প্রথম হয়েছেন৷
তবে কেন তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিলেন৷ সহপাঠীরা জানান, অপু সম্মান প্রথম বর্ষে থাকার সময়ও একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন৷ তবে কি মানসিক কোনো রোগে ভুগছিলেন অপু? তার মধ্যে কী আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল৷
সাকিবের আত্মহত্যা বা অপুর আগেও একবার আত্মহত্যা চেষ্টা সবই মানসিক চাপ থেকে৷ কে তাদের উপর এই মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছিল? পরিবার, সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয় নাকি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা৷
সন্তানের ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে গিয়ে বাবা-মা তাদের উপর এতটাই চাপ দেয় যে পরীক্ষার ফল খারাপ হলে কেউ কেউ লজ্জায় ভয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়৷ বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন যেমন ছাত্রছাত্রীদের উল্লাসের খবর-ছবি মহাসমারোহে প্রকাশ পায়৷ তেমনি পরীক্ষায় ফেল করে লজ্জায় আত্মহত্যার খবরও ছোট করে প্রকাশ করতে হয়৷ বুকের মানিক হারিয়ে বাবা-মা বুক চাপড়ে কাঁদে৷
কিংবা স্বামী ঘরে নির্যাতিত মেয়েটি যখন নিজ বাড়িতে ফিরে আসার আকুতি জানায়৷ সমাজের চাপে বাবা-মা তাকে মানিয়ে নিতে বলে৷ নির্যাতিত হতে হতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মেয়েটি আত্মহত্যা করলে মৃতদেহ নিয়ে বিলাপ করে তার পরিবার৷ অথচ তাকে ফিরতে দিলে হয়তো সে বেঁচে যেত৷
প্রেমঘটিত কারণেও অনেক উঠতি বয়সের ছেলে মেয়ে আত্মহত্যা করছে৷ তবে আমার অভিজ্ঞতা বলছে, এই প্রবণতা বেশ খানিকটা কমে এসেছে৷ বিয়ে নিয়ে অভিভাবকরা এখন অনেক বেশি উদার৷ তারা ছেলে-মেয়ের পছন্দের সম্মান দিচ্ছেন৷
নানা গবেষণায় দেখা গেছে, আত্মহত্যা করা মানুষদের ৯০ শতাংশই সে সময়ে মনরোগে ভোগেন; বিষন্নতা যার অন্যতম৷ নানা কারণে তার মধ্যে বিষন্নতার সৃষ্টি হতে পারে৷
শীত প্রধান উন্নত দেশগুলোতে আবহাওয়ার কারণেও অনেক মানুষ বিষন্নতায় ভোগে৷ তাদের কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নেন৷ সেখানে সমাজ ব্যবস্থা অনেক উদার, পরিবার থেকেও তেমন চাপ নেই৷ রাষ্ট্র তার প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব নেয়, নিরাপত্তা দেয়৷ কিন্তু আত্মহত্যা ঠেকাতে পারে না৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যায় করেন৷ শুধু মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে আত্মহত্যার এ হার অনকেটা কমিয়ে আনা সম্ভব৷
আত্মহত্যা করার আগে সেই মানুষের মধ্যে নানা রকম লক্ষণ দেখা যায়৷ গবেষকেরা এমনটাই বলেছেন৷ কাছের মানুষরা একটু খেয়াল করলে তা বুঝতে পারবেন৷ সে লক্ষণ হতে পারে, স্বভাববিরুদ্ধভাবে চুপচাপ বা খিটখিটে হয়ে পড়া৷ নিজেকে দোষারোপ বা নিজের ক্ষতির চেষ্টা৷ রাগ, জেদ, অভিমান বেড়ে যাওয়া, বিনা কারণে কান্না করা বা খুশি হয়ে ওঠা৷ নিজের সব কিছু গোছাতে বা কাউকে সব দেখে রাখতে বলা ইত্যাদি৷
করোনা মহামারীর এ বন্দি সময়ে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে৷ বাংলাদেশে এই প্রথম এক বছরে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ১০১ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা সেটা প্রমাণ করেছে৷ প্রতিটি আত্মহত্যার পেছনের কারণ খুঁজতে গেলে বেরিয়ে আসবে এক একটি বেদনা কাব্য৷
দুঃখ, কষ্ট, রোগ-শোক, বিপর্যয়, অবহেলা-অপমান সব মানুষের জীবনেই থাকে৷ শুধু আমি কষ্টে আছি, বাকি দুনিয়া হাসছে বিষয়টা কখনোই তেমন নয়৷ তাই আসুন ঘুরে দাঁড়াই৷ নিজের যত্ন করি৷ শরীরের পাশপাশি মনের যত্ন করি৷ যখন মনে হবে এ জীবন আর বইতে পারছি না তখন কারো সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি৷ প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই৷ মনোরোগ মানেই আমি পাগল নই বা পাগল হয়ে যাচ্ছি না৷ সমাজের এই ট্যাবু ভেঙ্গে বেরিয়ে আসি৷
সূত্রঃ ডয়েচ ভেলে
করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে