মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
রহস্যময় এই পৃথিবীতে কত কিছুই না ঘটেছে যার সব হিসাব কি বিজ্ঞানীরা মেলাতে পেরেছে? কিছু হয়ত পেরেছে কিন্তু সবকিছু নয়। অজানা অনেক কিছুর হিসাব মেলাতে বছরের পর বছর লেগেছে। এখনো কত কিছুই না জানার বাহিরে রয়ে গেছে। মানুষের জীবনেও তেমনি বিভিন্ন সময়ে বিভ্রম আর বিভ্রান্তি এসে যেন উঁকি মারে। কোনোটার হিসাব মেলানো যায় আবার কোনোটার যায় না। মানসিক রোগে ঠিক তেমনি অদ্ভুত একটি সমস্যা হচ্ছে ‘ডিলুশন’ যার বাংলা অর্থ বিভ্রম। ডিলুশন বা বিভ্রম কোনো ব্যক্তির মধ্যে থাকলে তা জটিল মানসিক রোগকে ইঙ্গিত করে।
- ডিলুশন বা বিভ্রম হলো কোনো বিষয়ে ব্যক্তির এমন দৃঢ় বিশ্বাস যা বাস্তবতার নিরিখে ভিত্তিহীন। ব্যক্তির এই বিশ্বাস তার কৃষ্টি কালচার কিংবা সমাজের প্রচলিত ধারণার সাথে মেলানো যায় না এবং পরস্পরবিরোধী প্রমাণের আলোকেও তা পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। মানসিক অনেক রোগেই এবং শারীরিক কিছু কিছু রোগে ডিলুশনের উপস্থিতি দেখা যায়। যেমন, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, সাইকোটিক ডিপ্রেশন, ডিমেনশিয়া ইত্যাদি।
যাদের এই মানসিক রোগ আছে তারা কল্পনা থেকে বাস্তবতাকে আলাদা করতে পারে না। তাদের এমন কিছুতে অটল বিশ্বাস থাকে যা সত্য নয় বা বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি নয়। যেমন, ব্যক্তি মনে করে তার পরিবার বা পরিবারের কেউ তার ভালো চায় না, সবাই তার সাথে শত্রুতা করে বা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু বাস্তবে খোঁজ নিলে দেখা যায় এর সত্যতা নেই। যুক্তি তর্ক কিংবা হাজারটা প্রমাণেও ব্যক্তিকে এই বিশ্বাস হতে টলানো যায় না।
হতেই পারে পরিবার বা পরিবারের বাহিরের কেউ শত্রুতা করছে এবং এটা অন্যরাও বিশ্বাস করে তবে এটা ডিলুশন হবে না। আবার কেউ অনুভব করতে পারেন যে, পোকা-মাকড় তার সারা শরীরে চামড়ার নিচ দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। ব্যক্তি একাধিক চিকিৎসকের সাথে দেখা করে এবং নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা করে কিছু না পেয়ে অভিযোগ করতে থাকেন যে কোনো ডাক্তার এই অবস্থাটি নির্ণয় করতে পারছেন না। মূলত বিভ্রম ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এমন বিশ্বাস পোষণ করেন, যার সাথে বাস্তবতার কোনো সম্পর্কই নেই।
- এবার আসা যাক ধর্ম নিয়ে বিশ্বাস। ধর্মের প্রতি বিশ্বাস কি ডিলুশনাল? না, ধর্মের প্রতি বিশ্বাস ডিলুশনাল নয়। কারণ ব্যক্তি মনে করেন, সে যে ধর্ম বিশ্বাস করে তা অন্যরা বিশ্বাস নাও করতে পারে। ব্যক্তির অন্যান্য স্বাভাবিক কাজ বা চিন্তার সাথে ধর্ম বিশ্বাস একটি স্বাভাবিক অনুষঙ্গ হিসেবে থাকে। অন্য কোনো বিষয়ে ব্যক্তির চিন্তা বা কাজে কোনো অস্বাভাবিকতা থাকে না। কিন্তু ডিলুশনাল ব্যক্তির মধ্যে অন্য কোনো কাজ বা চিন্তায় অস্বাভাবিকতা থাকে।
আমরা অনেক সময় বলি সৃষ্টিকর্তা আমার মধ্যে আছেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা বাস্তবিক অর্থে কোনো ব্যক্তির মধ্যে থাকতে পারে না। এটা অনেকেই আক্ষরিক অর্থে বলে থাকেন যা ডিলুশন হবে না। তবে একজন ধার্মিক ব্যক্তির মধ্যেও ডিলুশন হতে পারে কোনো না কোনো মানসিক সমস্যার জন্য। যেমন ব্যক্তি মনে করেন সে নিজেই সৃষ্টিকর্তা এবং এই পৃথিবীর সবকিছুই তার নির্দেশে চলে তবে তা ডিলুশন হবে।
জাম্বিয়ার লুসাকায় একবার এক হাসপাতালে মানসিক ওয়ার্ডে নার্স নিয়োগ দিতে গিয়ে বিপত্তি দেখা দিল। কারল কোনো নার্সই মানসিক ওয়ার্ডে কাজ করতে রাজি হচ্ছিল না। তাদের বিশ্বাস ছিল মানসিক ওয়ার্ডে কাজ করলে সে নিজেও মানসিক রোগী হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের বিশ্বাসকে বলা হয় শেয়ারড বিলিভ (Shared belief)। এমনতর কিছু কিছু বিশ্বাস আমাদের অনেক সমাজ ব্যবস্থায় দেখা যায়।
আমাদের দেশে গ্রামে-গঞ্জে এ রকম বিশ্বাস-অবিশ্বাস কিংবা মঙ্গল-অমঙ্গল নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা বা বিশ্বাস প্রচলিত আছে যা অন্য কালচারে গ্রহণযোগ্য নয়। ধর্মের ক্ষেত্রেও অনেক দেশে গুটি কয়েক ব্যক্তির সম্মিলনে একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী গ্রুপ দেখতে পাওয়া যায় যা প্রধান প্রধান ধর্মের সাথে মেলানো যায় না।
খেতে খেতে মৃদু কাশি, দরজায় বাধা পাওয়া, মরা গাছে কাক ডাকা, শেষ রাতে শিয়াল ডাকা, গভীর রাতে পেঁচার ডাক, যাত্রাপথে খালি কলস দেখা, পিছন থেকে ডাকা এ রকম নানাবিধ প্রচিলত বিশ্বাস কিন্তু আমাদের দেশে আছে যা কিন্তু ডিলুশন নয়।
- সমাজে অনেক সময় দেখা যায় কেউ কেউ নিজের সম্পর্কে এমনতর ধারণা পোষণ করে যা অন্যদের চোখে একেবারেই বেমানান। যেমন একজন ব্যক্তি যে কিনা মনে করে তিনিই অফিসের সবকিছু, তার কারণেই অফিস টিকে আছে এবং উনিই ওই প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কর্ণধার; অথচ তার অফিসের অন্যরা তা মনে করে না। এ ধরনের বিশ্বাসকে অতিমূল্যায়িত বিশ্বাস বা ওভারভ্যালুড আইডিয়া (Overvalued ideas) বলা হয়।
এ ধরনের বিশ্বাস ডিলুশনের মতো মনে হলেও আসলে ডিলুশন নয়, কারণ এখানে ব্যক্তি তার এই ধারণার পক্ষে যুক্তি দেখাতে পারে এবং বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও তা ডিলুশনের মতো এতটা দৃঢ় হয় না। এটা মূলত ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সমস্যার জন্য হয় এবং এতে ব্যক্তির নিজের সক্ষমতা ও জীবন সম্পর্কে ধারণা কম থাকে। তবে ওভারভ্যালুড আইডিয়া অনেক মানসিক রোগেও থাকতে পারে।
আমাদের কাছে অনেক কিছুই বিভ্রম বা ডিলুশন মনে হতে পারে। এক কালচার হতে অন্য কালচারে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসগুলোকে অবাস্তব মনে হতে পারে। প্রচলিত অনেক ধ্যান-ধারণাই এখন যুগের পরিবর্তনে অস্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু এসব অবাস্তব, অস্বাভাবিক চিন্তা কিংবা ধ্যান-ধারণা ডিলুশন বা বিভ্রম কিনা তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
কারণ ডিলুশন বা বিভ্রম থাকলে তা আমাদের জটিল মানসিক বা শারীরিক রোগকেই ইঙ্গিত করে। সুতরাং ডিলুশন বা বিভ্রম এবং প্রচলিত অন্যান্য বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা থাকলে আমরা খুব সহজেই রোগীর রোগ সম্পর্কে ধারণা করতে পারব এবং চিকিৎসার আওতায় আনতে পারব।
লেখক : ডা. ওয়ালিউল হাসনাত সজিব
সহকারী অধ্যাপক
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ, সিরাজগঞ্জ।
সূত্র : মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন সেপ্টেম্বর ২০২২ সংখ্যা
- মাসিক মনের খবর প্রিন্ট ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতে চাইলে কল করুন : 01797296216 এই নাম্বারে। অথবা মেসেজ করুন পেজের ইনবক্সে। লেখা পাঠাতে পারেন monerkhaboronline@gmail.com বা এই 01844618497 হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে।
/এসএস/মনেরখবর/