ডা. সৃজনী আহমেদ
হাসপাতালের বিছানায় নির্বাক শুয়ে আছেন পঁয়তাল্লিশ বছরের জাহান বেগম। ধীরে ধীরে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হলে বিড়বিড় করে একটা কথাই উনাকে বলতে শোনা যায়, ‘মেয়েটা কী বলতে চেয়েছিল, ও বাঁচতে চেয়েছিল, কেন আমি পারলাম না বাঁচাতে’।
এক মাস আগে তার সতেরো বছরের মেয়ে আত্মহত্যা করে। প্রথম কিছুদিন যেন বুঝেই ওঠার সুযোগ হয়নি, থানাপুলিশ, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী সকলের প্রশ্নে কৌতুহল। সহানুভতিতে মোড়ানো একরকম যেন বিদ্রুপ মেশানো করুণা এসব পার করে বিছানায় পড়লেন।
তারপর থেকে খাওয়া-দাওয়া, কথাবার্তা বন্ধ, সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকলেও ঘুমাতে পারেন না। মাঝে মাঝে শ্বাস আটকে আসে যেন, আর যেন অনুভব করতে পারেন যে মেয়েটা মৃত্যুর আগে কত কষ্ট পেয়েছিল। তার আরো দুই সন্তান, স্বামীর জীবনও থমকে গেছে।
সকল মৃত্যুই বেদনার। কিন্তু প্রিয়জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু ওলটপালট করে দেয় জীবন। স্বাভাবিক মৃত্যু তথা বৃদ্ধ বয়সে অথবা দীর্ঘদিন অসুস্থতায় ভুগে মৃত্যুর ক্ষেত্রে আপনজনেরা অনেকটাই যেন তৈরি থাকেন, শেষ বিদায় জানাতে পারেন, আবেগ অনুভূতির টানাপোড়েনগুলো আলোচনা করে নিতে পারেন। শোক থাকলেও সেটার ভার বহন সম্ভব হয়।
কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যু তথা দুর্ঘটনা, হত্যা বা আত্মহত্যায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে শোক হয়ে ওঠে জটিল। এই মৃত্যুগুলোতে মৃতদের শেষ মুহূর্তের কষ্টের এক ধরনের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে আপনজনদের মনে।
‘কতটা কষ্ট পেয়েছিল’, ‘কী বলতে চেয়েছিল’, ‘বাঁচতে চেয়েছিল কীভাবে’ এরকম প্রশ্ন এবং সেইসঙ্গে অনুভবগুলোও তাড়া করতে থাকে। শেষ সময়ের স্মৃতিচারণ করতে না চাইলেও বারবার বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। পুলিশ, সাংবাদিক-গণমাধ্যমকর্মী, আইনজীবী, আদালত, পরিচিতজনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়; মৃত্যুর ঘটনা, বিভিন্ন স্মৃতির পুনরাবৃত্তি করতে হয়।
শোকের সঙ্গে যোগ হয় এমন কিছু প্রশেড়বর যেটার উত্তর হাজারবার খুঁজেও পাওয়া সম্ভব হয় না। এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তা মনকে গ্রাস করে। এইরকম শোকের আরেকটি দিক হচ্ছে হারানোর বেদনা। স্বাভাবিক মৃত্যুতে এরকম থাকলেও অস্বাভাবিক মৃত্যুতে বিদায় না দেয়ার আক্ষেপ, হঠাৎ আসা অনিশ্চয়তা কাজ করে।
প্রিয়জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু যেমন সড়ক দুর্ঘটনা, হত্যা সরাসরি দেখা বা ঘটনা শোনার পর পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার হতে পারে। এছাড়াও শোকস্তব্ধ ব্যক্তির মধ্যে বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে। বেদনাদায়ক পরিস্থিতিতে শোকাহত ব্যক্তি, পরিবারকে সাহায্য করতে পারে পরিবারের সদস্যরা। একে অপরকে ভরসা দেয়া, বাস্তবিক সাহায্য করা, আবেগ প্রকাশের নির্ভরযোগ্য স্থান হয়ে উঠতে পারে পরিবার।
এছাড়াও পরিচিতজন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সাংবাদিকদের দায়িত্বশীল আচরণ এসব ক্ষেত্রে খুব প্রয়োজন। যদি স্বাভাবিক জীবনযাপনে একেবারেই ফেরত আসতে না পারেন শোকাগ্রস্থ ব্যক্তি, খাওয়া-দাওয়া-ঘুম ব্যাহত হয়ে শারীরিক সমস্যা তৈরি হয় তাহলে শারীরিক এবং মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন হয়।
লেখক : ডা. সৃজনী আহমেদ
সহকারী অধ্যাপক- মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা কমিউনিটি মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা।
এটা পড়ুন…
কিশোরী দেহে অবাঞ্চিত লোম ও অনিয়মিত মাসিক : কারণ ও প্রতিকার
আরো জানতে ভিজিট করুন…
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে
/এসএস