মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসায় মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার

0
208
মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসায় মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার

সারা বিশ্বে অসংক্রামক অসুস্থতার মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে মানসিক রোগ। সারা বছর রোগের কারণে যত মানুষের সক্ষমতা নষ্ট হয় তার এক তৃতীয়াংশ হয় মানসিক রোগের কারণে। কিন্তু মানসিক রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে সাইকোসিস বা গুরুতর মানসিক রোগাক্রান্তদের শতকরা ৩২ জন চিকিৎসার আওতার বাইরে, বিষণ্ণতা রোগের জন্য সংখ্যাটি শতকরা ৫৬ ভাগ, মাদকাসক্তির ক্ষেত্রে শতকরা ৭৮ ভাগ।

এই হিসেবগুলো এক একজন ব্যক্তির জীবনের ক্ষেত্রে যদি আমরা দেখি তাহলে সেটা অনেক কষ্টকর ব্যক্তির নিজের জন্য, তার পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট সমাজের জন্য। নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে অবস্থা আরো হতাশাজনক। চাদ, লিবিয়া, রুয়ান্ডাতে সারা দেশের জনগণের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন একজন বা দুইজন।

এরকম অবস্থায় মানসিক রোগের চিকিৎসায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে ডিজিটাল প্রযুিক্তর ব্যবহার। সারা বিশ্বেই মোবাইল, কম্পিউটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়াতে মোট জনসংখ্যার অন্তত শতকরা ৮০ ভাগ মোবাইল ব্যবহার করছে। আরো দেখা গেছে, সারা বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারের শতকরা ৪০ ভাগ মোবাইল দিয়ে হচ্ছে। প্রযুিক্তর এই সহজলভ্যতা মানসিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক সফুল বয়ে আনছে। মোবাইল, কম্পিউটার ব্যবহার করে অল্প সময় এবং অল্প খরচে যা যা করা সম্ভব হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :

  • মানসিক রোগ নির্ণয়
  • রোগ সম্পর্কে সচেতন এবং শিক্ষিত করে তোলা
  • বিভিন্ন রকম মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা দেয়া
  • মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের নিজেদের মধ্যে চিকিৎসা বিষয়ক যোগাযোগ
  • গবেষণা করা
  • প্রযুিক্তর এই ব্যবহারে সুবিধাগুলো হচ্ছে :
  • অল্প সময়ে অনেক জনগণকে সেবা দেয়া সম্ভব হয়
  • গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে শঙ্কিত হয়ে যারা মানসিক রোগের কোনো চিকিৎসা সেবা নেন না অথবা নিলেও ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন না তাদেরকে এইরকম সেবার আওতায় আনা যায়
  • লোকবল সংকট অনেকাংশে কাটানো সম্ভব হয়
  • উন্নত প্রযুিক্তর ব্যবহারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির ঘুম, মেজাজের পরিবর্তন, আচরণ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়
  • মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট, পিসি, স্মার্ট ঘড়ি এগুলো সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় যেকোনো সময় এগুলোর সাহায্য নেয়া যায়। যেমন : একজন উদ্বিগ্নতায় আক্রান্ত রোগী একবার থেরাপিস্টের কাছে রিলাক্সেশন শিখে এই ধরনের অ্যাপ ব্যবহার করে নিয়মিতভাবে নিজের সুবিধাজনক সময়ে চর্চা করতে পারবেন।

বর্তমানে বিষণ্ণতা রোগ, উদ্বিগ্নতাজনিত রোগ, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, ইটিং ডিজঅর্ডার, আত্মহত্যা প্রতিরোধ, অটিজম, ভাষা-উচ্চারণের সমস্যা, স্মৃতিভ্রংশতার জন্য ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন পরীক্ষিত সেবা চালু আছে বিভিন্ন দেশে। এই সেবাগুলোর মধ্যে আছে :

সেল্ফ হেল্প সেবা : ব্যক্তি নিজেই ইন্টারনেটে ওয়েবসাইটে তথ্য জেনে বা অ্যাপের মাধ্যমে মানসিক সমস্যাগুলোর চিকিৎসয় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারবে।

ই-থেরাপি: বিভিন্নরকম মনোবৈজ্ঞানিক সেশন এই ইথেরাপিগুলোর মাধ্যমে দেয়া হয়। এটা পেশাদার থেরাপিস্টের সাথে সেশনের পর চালানো যায়। আবার প্রথম থেকেই ইন্টারনেটের মাধ্যমেই চালানো যায়-ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম, চিন্তা, আচরণের রেকর্ড পূূরণ করার পর সফটওয়্যার অথবা ওয়েবসাইটটি ফলাফল জানাতে থাকে। বর্তমানে ইসিবিটির (কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি) ব্যবহারে গবেষণায় অনেক ভালো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে।

মস্তিষ্কের কার্যক্রমকে নির্দিষ্ট শিক্ষা দেয়ার সফটওয়্যার, অ্যাপ। যেমন : ফার্স্ট ফরওয়ার্ড (First ForWord) নামে সফটওয়্যার ব্যবহার করে শিশু-কিশোরদের ভাষাগত সমস্যায় ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণ দেয়া যায়। লুমোসিটি নামক অ্যাপটি মোবাইলে ব্যবহার করে মস্তিষ্কের আলাদা আলাদা অংশের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া যায়। ইন্টারনেটভিত্তিক সেবার মাধ্যমে এক ধরনের রোগী/সমস্যায় থাকা ব্যক্তিরা দলীয়ভাবে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারেন। মাদকাসক্তি, স্ট্রেসডিজঅর্ডারের ক্ষেত্রে এরকম নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চিকিৎসার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয়।

রোগ নির্ণয় করার জন্য ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ : এসব সেবার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট তথ্য পূরণ করার পর রোগ নির্ণয় করা এবং কোথায় যোগাযোগ করতে হবে সেই পরামর্শ পাওয়া যায়।

মোবাইলে ক্ষুুদে বার্তার মাধ্যমে : ইন্টারনেটের আওতার বাইরে মোবাইল ব্যবহারকারীদেরকে ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন করা, চিকিৎসার বিষয়ে জানানো এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য মনে করিয়ে দেয়া যায়। ফোন এবং অনলাইনে দূর থেকে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শ নেয়া সম্ভব। তবে প্রযুিক্তর মাধ্যমে এই সেবাগুলো মানসিক রোগের প্রচলিত চিকিৎসার বিকল্প নয়, সহায়তাকারী-এই বিষয়টা মনে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও বাণিজ্যিকভাবে মুনাফার জন্য এর অতিরিক্ত ব্যবহার, উপযোগিতা যাচাই না করে সকলের জন্য গড়পরতা একইরকম সেবা দিয়ে ব্যক্তির দুর্ভোগ আরো বৃদ্ধি পাওয়া, যন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা তৈরি হওয়া, বাণিজ্যিক বিষয়কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ এবং সুিবধাবঞ্চিত জনগণ সেবার আওতার বাইরে থাকার মতো অসুিবধাগুলো মাথায় রাখাটাও প্রয়োজন।

বিটিআরসির তথ্য অনযুায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে ১৫ কোটি মোবাইল ব্যবহারের নিবন্ধন আছে। আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছে ৯০ মিলিয়ন। সুতরাং এই দেশে মানসিক রোগের বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে এবং চিকিৎসার অপ্রতলুতা দূর করতে প্রযুক্তির ব্যবহার নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে। ইতিমধ্যে সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো থেকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভিডিও কলের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এছাড়াও আছে ‘মাইন্ডটেল’, ‘জিয়ন’ এরকম ফোনভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ দেয়ার কেন্দ্র। যদিও চাহিদার তলুনায় অপ্রতুল এবং চিকিৎসার কার্যকারিতা এবং উপযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য আরো গবেষণা প্রয়োজন।

তথ্যসূত্র : লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleআত্মহত্যা বিষয়ক সাধারণ কিছু তথ্য
Next articleশারীরিক স্পর্শে মানসিক সুস্থতা
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল, মগবাজার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here