“রাত ১২টা! জরুরী ফোন কলের নাম দিয়ে ৩৬ বছর বয়সী মাহফুজ মুঠোফোন হাতে নিয়ে বাড়ির ছাঁদে চলে গেল। কিছুক্ষণ আগে অফিস থেকে পাঠানো ই-মেইল পেয়েছে সে। যেখানে চাকুরী থেকে ছাঁটাই এর নোটিশ দেয়া। আগামী ১০ তারিখে গত মাসের বেতন ব্যাংক একাউন্টে পৌঁছে যাবে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সব প্রস্তুত আছে। সে গত চার বছর ধরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছে, যার ফান্ডিং করেছে একটি বিদেশী সংস্থা। এই “করোনা ভাইরাস” আপদকালীন সময়ে সংস্থাটি আর কোনভাবেই কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চাচ্ছেনা। ই-মেইল পড়ার পর থেকেই তাঁর বুকে ব্যাথা শুরু হয়েছে, সাথে শ্বাসকষ্টও! বুঝতে পারছেনা এমন হচ্ছে কেন! মনে মনে জমানো টাকার হিসেবটা করে ফেলল সে। সংসার খরচ, বাচ্চাদের পড়ালেখা, বাড়ি ভাড়া, বাবা-মার ওষুধ ও চিকিৎসা খরচ ইত্যাদি। এ মাসটা নাহয় ভালোয় ভালোয় কেটে যাবে কিন্তু পরের মাস! এসময়ে কে তাকে নতুন চাকুরী দিবে! ভাবতে ভাবতেই ছাঁদের কোনায় চলে আসে সে। একবার ভাবে, ছাঁদ থেকে লাফিয়ে পরে জীবনটা শেষ করে দিবে! পরক্ষণেই তাঁর আদরের সন্তান, প্রিয় স্ত্রী, বৃদ্ধ বাবা-মার মুখ ভেসে উঠে চোখে! তাঁর কিছু হলে ওদেরকে দেখার আর কেউ থাকবেনা! অনিশ্চয়তা আর হতাশায় চোখের পানি আর আটকাতে পারেনা মাহফুজ!”
বর্তমান সময়ের রুঢ় বাস্তবচিত্র হয়ত এটি যে আমাদের অনেকেই বিগত দিনগুলিতে মানসম্মত প্রতিষ্ঠানে কাজ করে থাকলেও হুট করেই কর্মহীন হয়ে পরেছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসা কিম্বা স্বনির্ভর সংস্থা থেকে শুরু করে নামীদামী প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মীরাই কর্মহীন, বন্ধ হয়ে গেছে নিয়মিত আয়ের উৎস! অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে চাকুরী খোঁজার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রী পড়াতেন। তারাও এখন দুঃশ্চিন্তায় আছেন! তাঁদের হাতে হয়ত তেমন সঞ্চয়ও নেই। এক অনিশ্চয়তায় যেন ছেয়ে গেছে চারপাশটা!
চলুন একটু ভেবে দেখি এসময়টা অতিক্রম করতে কি কি করা যেতে পারেঃ
১. ইতিবাচক চিন্তা করাঃ সারাক্ষণ দুঃশ্চিন্তা না করে নিজের অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতা নিয়ে ভাবা। নিজের আত্নবিশ্বাসকে বাড়িয়ে তোলা। যা গেছে সেটা নিয়ে না ভেবে, সামনে আরো ভাল কি করা যেতে পারে তার পরিকল্পনা করা। অসম্ভব পরিকল্পনা কিংবা যা এই মুহূর্তে নেই তা নিয়ে না ভেবে যা সম্ভব এবং আওতার মধ্যে আছে তা নিয়ে ভাবা। যে অবস্থানে আছেন তা ভেবে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দেয়া।
২. প্রার্থনা এবং মেডিটেশনঃ যার যার ধর্ম অনুযায়ী প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে প্রার্থনা করা, ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করা, মেডিটেশন করা। ইউটিউব থেকে রিলাক্সজেশন মিউজিক শোনা যেতে পারে। ডীপব্রেথ অনুশীলন করা (ঠিক এই মুহূর্তে যেখানে আছেন আরাম করে বসুন। চোখ বন্ধ করে, বুক ভরে শ্বাস নিন, কিছুক্ষণ ধরে রাখুন, ছেড়ে দিন। এভাবে অন্তত ৫ মিনিট)।
৩. ডায়েরী লেখাঃ প্রতিদিনের চিন্তা গুলো আর তা থেকে যে কষ্ট, হতাশা, ভয়, আতংক, চাপ, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি যা যা অনুভূতি মনে আসে, নিজের মত করে ডায়েরীতে লেখা। (যদি লিখতে গিয়ে কান্না পায় তা আটকাবেন না)।
৪. পারিবারিক বন্ধন বৃদ্ধিঃ হয়ত ভাবছেন পরিবারকে কিভাবে জানাবেন যে আপনি কর্মহীন হয়ে গেছেন। বিশ্বাস করতে হবে পরিবারই সবচেয়ে নিরাপদ স্থান, যেখানে আপনি মনের কথা খুলে বলতে পারেন। পরিবারের লোকদের সাথে গল্প করে, টিভি দেখে, বিভিন্ন ইনডোর গেমস যেমন, লুডু, কেরাম, দাবা, চোর-পুলিশ, শব্দ-জব্দ খেলা, পাযেল বক্স মিলান ইত্যাদি খেলে সময় কাটানো যা হয়তো বিগত বছর গুলিতে অনেক চেষ্টা করেও সময়ের অভাবে করা হয়নি।
৫. ইয়োগা এবং এক্সারসাইসঃ দৈনন্দিন জীবনে ইয়োগা এবং এক্সারসাইসের পুর্ব অভিজ্ঞতা থাকলে তা চালিয়ে যাওয়া। ইউটিউব দেখে কিংবা বই পড়েও প্রতিদিন অনুশীলন করা যেতে পারে।
৬. ডেইলী রুটিনঃ হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন কিংবা কর্মহীন হয়ে পরেছেন বলে খাওয়া-ঘুমের নিয়ম যেন বিঘ্ন না হয়। সময় মত ঘুমানো এবং জেগে উঠা, নিয়ম মত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, গোসল ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিজের কাজ করা ও অন্যদের কাজে সাহায্য করা, প্রার্থনা, বাচ্চাদেরকে এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সময় দেয়া, বিনোদনের জন্য সময় রাখা ইত্যাদি দিয়ে ডেইলী রুটিন সাজানো ।
৭. সামাজিকীকরণঃ আত্নীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী, সহকর্মীদের সাথে মুঠোফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশ-বিদেশের আত্মীয়দের নিয়ে গ্রুপ খুলে একসাথে ভিডিও কল করা। গৃহবন্দি সময়টায় তারা কিভাবে সময় কাটাচ্ছেন তা জানা। চ্যটিং এর চেয়ে কথা বলতে বেশি চেষ্টা করা। সু্যোগ থাকলে নিজ এলাকায় “করোনা” প্রতিরোধের উপায় নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মকান্ড, ত্রান বিতরণে সাহায্য করা (অবশ্যই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে)।
৮. সৃষ্টিশীল কাজঃ হয়ত ভুলেই গেছেন আপনার ছাত্র জীবনে কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। সেগুলো আবার একটু চর্চা করা। প্রতিদিন নতুন একটা কিছু করা, হোক সেটা বাচ্চাদের সাথে খেলা, ছবি আঁকা, লেখালেখি করা, রান্না, হাতের কাজ, মিউজিক কম্পোজিশন ইত্যাদি।
৯. সহনশীলতা বৃদ্ধিঃ বিপদে হাল ছেঁড়ে না দিয়ে নিজের সহনশীলতা বাড়াতে হবে। ভাবতে হবে ঠিক এই সময়টায় পৃথিবীতে এমন অবস্থা শুধু আপনার একার নয়। সবচেয়ে বড় কথা যে আপনি এখনও জীবিত আছেন। আপদকালীন সময়টায় মনের জোর বাড়িয়ে, বর্তমানকে সহজ ভাবে গ্রহণ করে নিতে হবে। প্রথমে কঠিন মনে হলেও আপনার সদিচ্ছা থেকেই সফল ভাবে তা করতে পারবেন।
১০. মনোচিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণঃ অনেক সময় অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তা, হতাশা ইত্যাদি থেকে শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হয় যেমন, মাথা ব্যথা, বমি ভাব, ঘুমের সমস্যা, শ্বাস কষ্ট, অতিরিক্ত ক্ষুধাবোধ কিংবা অরুচি ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। আবেগীয় সমস্যার কারণে আত্নহত্যা প্রবণতা, অতিরিক্ত রাগ, চিৎকার, ভাঙচুর, অস্থিরতা, সবকিছু অসহ্য লাগা, দুঃস্বপ্ন দেখা, মৃত্যু ভয় ইত্যাদিও হতে পারে। সেক্ষেত্রে অনলাইনে মনোচিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করে ওষুধ সেবন করার পাশাপাশি মনোবিজ্ঞানীর কাছে উপদেশনা নেয়া যেতে পারে।
যে চিন্তাগুলো দূরে রাখতে হবেঃ
১. আমি ব্যর্থ!
২. সব ভুল আমার!
৩. আমার কপালটাই খারাপ!
৪. জীবনে আর ভাল কিছু হবেনা আমার!
৫. আমার মরে যাওয়াই উচিৎ!
পরিশেষে মনে রাখতে হবে মানসিক চিকিৎসা নেয়া দোষের কিছু নয়। এর মানেই আপনি পাগল নন। একে স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করে এসময়টা সফলভাবে মোকাবেলা করা যেতে পারে।
Home করোনায় মনের সুরক্ষা বিশেষজ্ঞের মতামত হোম কোয়ারেন্টাইনঃ আকস্মিক বেকারত্ব উদ্বেগ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন