স্বাধীনতার অপব্যবহার জীবনের শৃঙ্খলা বিনষ্ট করে

ফারজানা ফাতেমা রুমি

স্বাধীনতা মানে যদি যা ইচ্ছা তাই করা হয় তাহলে সারাদিনের কর্মব্যস্ত মানুষটাকে একটু স্বাধীনতা দিলে সে হয়ত সব দায়িত্ব ফেলে বনে-বাদাড়ে ছুটে বেড়াতে চাইবে। কিংবা কে জানে হয়তবা দিনভর আলসেমি করে ঘুমাতে চাইবে।

আর ছাত্রজীবনের স্বাধীনতা সেটা কেমন হতে পারে! সব বই-খাতা বন্ধ করে শুধু আড্ডা আর গল্প, কোনো নিয়ম-নীতির বালাই নেই। আর ঠিক এই সময়টায়, উফ কী অসহ্য সারাদিন-রাত বাইরে কোথাও গেলেই মাস্ক পরে ঘুরে বেড়ানো, তাহলে স্বাধীনতা মানে কি নিজের খুশিমতো বাঁধন ছাড়া আরামসে ঘুরে বেড়ানো!

এই কি তবে স্বাধীনতা? নাকি মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সেটা অপব্যবহার? সেই বাবুই পাখির কুড়েঘরে থেকে স্বাধীনতার সুখের মতো বেঁচে থাকার সত্যিকার অর্থ আমাদেরকে জানতে হবে সবার আগে।

স্বাধীনতার অর্থ কি শুধু যেমন ইচ্ছা তেমন আচরণ করা, সমস্ত বাধ্যতামূলক পরিস্থিতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া, নিজের দ্বারা নির্ধারিত শর্তে বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া?

বিশ্বজুড়ে সমস্ত সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এই স্বাধীনতাকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মত প্রকাশের এবং বাকস্বাধীনতা গণতন্ত্রের অন্যতম ফল। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, একাডেমিক স্বাধীনতা, বৌদ্ধিক স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা এবং বৈজ্ঞানিক স্বাধীনতা।

দার্শনিক ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত, যে পরিমাণে মানুষ তার নিজের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম ততটা তার স্বাধীনতা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ- একটি রাস্তা ধরে গাড়ির চলাচলে দুইরকম স্বাধীনতা রয়েছে; দ্রুত বা ধীর যাওয়া।

দিক পরিবর্তন করতে তরঙ্গগুলোতে চলাচলকারী জাহাজের চলাফেরায় চার রকম স্বাধীনতা রয়েছে। কারণ এটি নাক থেকে লেজ এবং পিছু পিছু, পাশাপাশি ঘুরতে পারে। একটি বিমানও আরোহণ করতে পারে এবং চারদিকে স্লিপ করতে পারে, যেতে পারে ওপরে ও নিচে। এটি ছয়টি মাত্রার স্বাধীনতা।

জ্ঞানীয় স্বাধীনতা বা মানসিক আত্ম-নির্ধারণের অধিকার হলো একজন ব্যক্তির নিজস্ব মানসিক প্রক্রিয়া, জ্ঞান এবং চেতনা নিয়ন্ত্রণ করার স্বাধীনতা। নিউরোথিসিস্ট ড. রাই সেন্তেটিয়া এবং বোয়ের জ্ঞানীয় স্বাধীনতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন স্বতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসিতভাবে চিন্তা করা, ব্যক্তির মনের সম্পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করা এবং একাধিক চিন্তাধারায় জড়িত থাকার অধিকার প্রতিটি ব্যক্তির স্বাধীনতা।

সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, বেশিরভাগ মানুষ সত্যই স্বাধীনতা চায় না। কারণ স্বাধীনতার মধ্যে দায়বদ্ধতা জড়িত এবং বেশিরভাগ লোকেরা দায়বদ্ধতায় ভীত।

আমাদের জীবন পরিচালনার জন্য আমাদের কতটা স্বাধীনতা আছে? আমাদের স্বাধীনতার উপলব্ধি আমাদের কী অনুপ্রেরণা দেয়, সে সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি থাকতে হবে। তিন ধরনের স্বাধীনতা রয়েছে। প্রথম ধরনের স্বাধীনতা হলো দাসত্ব থেকে মুক্তি, সমাজের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি।

দ্বিতীয়ত, আমরা যা করতে চাই তা করার স্বাধীনতা। তৃতীয়ত, স্বাধীন থাকার স্বাধীনতা একটি স্বাধীনতা, কেবল আমরা যা চাই তা করার জন্য নয়, আমরা যা হতে চেয়েছি তা হওয়ার স্বাধীনতা।

স্বাধীনতার অপব্যবহারের মাধ্যমে যখন আমাদের মনোভাব ইন্দ্রিয় উপভোগের প্রবণতায় রূপান্তরিত হয়, তখন মানুষ অভিলাষের কবলে পড়ে, ভালো-মন্দ বোঝার জ্ঞান লোপ পায়।

যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার করা হয়, তখন এটি যৌন হয়রানি, ফৌজদারি অপরাধ, কর্মসংস্থানের নিয়মনীতি লঙ্ঘন, অসদাচরণ, শিক্ষার্থীদের অধিকার লঙ্ঘন, আইনী লঙ্ঘন ইত্যাদির দিকে পরিচালিত করে। পাশাপাশি গুরুতর অবৈধ ক্রিয়াকলাপও সংঘটিত হতে পারে।

বাকস্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতায় যদি সীমাবদ্ধতা না থাকে তবে তা থেকে তৈরি হতে পারে অপবাদ, অশ্লীলতা, অশ্রদ্ধা, পর্নোগ্রাফি, রাষ্ট্রদ্রোহ, উস্কানি, লড়াইয়ের শব্দ, কপিরাইট আইন লঙ্ঘন, ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়ের গোপনীয়তা ভঙ্গ, ফুড লেবেলিং সমস্যা, জননিরাপত্তাহীনতা এবং মিথ্যাচার ইত্যাদি।

সীমাহীন স্বাধীনতার সঙ্গে অপরাধ প্রবণতার সংযোগ দেখা যায়। যেখানে জবাবদিহিতা নেই এবং অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা নেই, নেই আইনের সুপ্রয়োগ, সেখানে বিবেক জাগ্রত হবার সুযোগও হ্রাস পায়। সম্পর্কের ন্যায্যতার ক্ষেত্রে সীমাহীন স্বাধীনতা, সমাজের জন্য আপত্তিজনক হতে পারে।

ডিজিটাল যুগের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগের নতুন মাধ্যম তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাকস্বাধীনতার প্রয়োগ আরো বিতর্কিত হয়ে উঠতে পারে। মানুষের চিন্তা-ভাবনাগুলো সবসময় স্বাধীন। স্বাধীনতা মানুষকে ক্ষমতাবান করে তোলে আবার ক্ষমতা মানুষকে অতিরিক্ত স্বাধীনতা এনে দিতে পারে।

ছোটো শিশু যখন কান্নার মাধ্যমে তার মনের ইচ্ছা প্রকাশ করে সকলের মনোযোগ থাকে তার দিকে। তার যা প্রয়োজন আদায় করে নিতে সে ব্যস্ত থাকে। শৈশবে সে বুঝে যায় বাবা-মার ইচ্ছাই তার ইচ্ছা, আর ভাবে কবে যে বড়ো হবে আর যা ইচ্ছা তাই করবে। আর কৈশোরে এই স্বাধীনতা পাওয়ার জন্যই বিদ্রোহী হয়ে ওঠা।

মাঝে মাঝে সীমা অতিক্রম করে স্বাধীনতার আনন্দ লাভ করা। আর যৌবনে শুধু বাহুর শক্তিতেই স্বাধীনতার ব্যবহার এবং অপব্যবহার করা। পরিণত বয়সে যখন জীবনের হিসেব-নিকেশ করতে বসে তখন শুধুই আক্ষেপ, কেন এই অবাধ স্বাধীনতার অপব্যবহারে ভুলের পর ভুল। হয়ত তখন আর কিছুই করার থাকে না।

একটি বাঘ এবং একটি বিড়ালকে সমান স্বাধীনতা দিলে বাঘ কী তাণ্ডব চালাতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই সময়, স্থান, কাল, পাত্র, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম এমনকি রাষ্ট্রভেদে স্বাধীনতার ব্যবহার সীমিত হতে হবে।

শুধুই ব্যক্তির ব্যক্তিগত আনন্দ লাভ মানেই স্বাধীনতা নয়। জানতে হবে কোথায় আমাকে থামতে হবে। অন্য কারো ক্ষতি করছি না তাই বলে ক্রমাগত নিজের ক্ষতি করে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছি কিনা ভাবতে হবে। বুঝতে হবে it’s my life, my choice এর শেষ কোথায়!

স্বাধীন দেশে কেউ স্বাধীনতা পেয়ে, তাকে সদ্ব্যবহার করেছে, কেউ সস্তা ভেবে অসদ্ব্যবহার করেছে। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি এই স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন দিয়েছিলেন তারাও সিদ্ধান্ত নিতে স্বাধীন ছিলেন ব্যক্তিগত আনন্দ-আয়েশে জীবন কাটাবার।

কিন্তু তারা তা করেননি। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই আমরা আজ স্বাধীন। বুঝে কিংবা না বুঝেই তাদের অর্জনের অপব্যবহার আমরা কত শত বার বুক ফুলিয়ে করে যাচ্ছি এই স্বাধীন দেশে।

ফারজানা ফাতেমা রুমি

মনোবিদ

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে

Previous articleযৌন মিলনে অনীহা, মুক্তিতে কাউন্সেলিং
Next articleরেগে গেলে নিজের ওপর অত্যাচার করা কি মানসিক রোগ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here