শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়: নিজের তৈরি চরিত্রের ভেতর যিনি নিজেই ঘুরে বেড়াতেন

শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়: নিজের তৈরি চরিত্রের ভেতর যিনি নিজেই ঘুরে বেড়াতেন
শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়: নিজের তৈরি চরিত্রের ভেতর যিনি নিজেই ঘুরে বেড়াতেন

তিনি অপরাজেয় কথাশিল্পী। জনপ্রিয়তায় সমসাময়িক অনেক স্বনামধন্য লেখককে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তাঁর জীবদ্দশাতেই। বঙ্কিম ও রবীন্দ্রযুগের আলো তাঁকে ম্লান করতে পারেনি আজও। নীতি বা প্রচলিত সংস্কার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পক্ষপাতশূন্য; বঙ্কিম দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন সংস্কারকে; শরৎচন্দ্র তখন সংস্কার ভাঙার সাহস দেখালেন! তিনি রমা, রাজলক্ষী, অভয়ার মতো চরিত্রের পক্ষ নিয়ে প্রীতিহীন নীতি ও ক্ষমাহীন সমাজকে প্রশ্ন করেছেন, তারা মানুষের কোন মঙ্গল সাধন করেছে? সচেতন ও অর্ধসচেতন মনের ওপর বাইরের ঘটনা আঘাত করলে যেসব গভীর অনুভূতির জন্ম হয়, তারই প্রকাশ ঘটে উপন্যাসে, গল্পে, কবিতায়। তাই লেখকের সৃষ্ট চরিত্রে অবশিষ্ট হিসেবে থেকে যায় তাঁর মনস্তত্ত্বের খানিকটা ছাপ। তা যে সবসময়ই ঠিক তা নয়, তবে অনুমান করা যায়, নিজের তৈরি চরিত্রের ভেতর তিনি নিজেই ঘুরে বেড়াতেন।
শরৎচন্দ্রের সৃষ্ট চরিত্রে লক্ষ করলে দেখা যায়, তাদের মনের ভেতর দুটি দিক পাশাপাশি কাজ করে। প্রথমটি বুদ্ধি-যা সমাজ ও সংস্কার হতে পাওয়া, দ্বিতীয়টি মনের গভীর থেকে উঠে আসা আবেগ ও অনুভূতি। সচেতন বুদ্ধি আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বটে, কিন্তু আবেগের উত্থান এত গভীর প্রবৃত্তি থেকে আসে যে তা সবসময় সংস্কার আশ্রিত বুদ্ধির ধার ধারে না। এই পরস্পরবিরোধী শক্তির চিত্রণেই শরৎচন্দ্রের প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ। বিশেষ করে নারী চরিত্রে প্রবৃত্তির সাথে সংস্কারের সংঘাত বড়ো হয়ে উঠে এসেছে। যে মীমাংসাহীন দ্বন্দ্বের মধ্যে নারীজীবনের সব ঐশ্বর্য মহিমা নিঃশেষ হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেটাই সবচেয়ে বড়ো ট্র্যাজেডি। হিন্দুঘরের বিধবা রাজলক্ষীর সত্যিকার মনের বিয়ে যদি কারো সাথে হয়ে থাকে তবে তা শ্রীকান্তের সাথে, তবে তা বিবাহমন্ত্রে পাওয়া নয়। কিন্তু যখন মিলনের সময় এলো তখন রাজলক্ষীর মধ্যে ধর্মবুদ্ধি এমনভাবে সচেতন হলো যে সেটাকে আর থামানো গেল না। একদিকে তার প্রাণাধিক ভালোবাসা ও অন্যদিকে সামাজিক শক্তির নিপীড়ন। এর মাঝেই জীবনের অপচয়, আর তা নিয়েই ঘটনাপ্রবাহ। অনড়বদাদিদি, নিরূদিদি, অভয়া, রাজলক্ষী-এই নারীদের সঙ্গে সমাজের অনুভূতিহীন নিয়মের সংঘর্ষ হয়েছে। কিন্তু এদের প্রত্যেকের মন এত স্বাধীন যে সামাজিক নীতি বা আইনে পিষ্ট হয়েও এদের জীবনের গৌরব অক্ষুণ্ণ থেকে গেছে। এই বিষয়টি থেকে শরৎচন্দ্রের মননের অনেকখানিই আভাস পাওয়া যায়।
তৎকালীন সমাজ সংস্কারের সঙ্গে তাঁর সংঘাত লেখক মানসে অবিরাম দ্বন্দ্বের তৈরি করলেও তিনি হয়ত বিশ্বাস করতেন-একদিন নির্দয় সমাজনীতির ওপর হৃদয়ের ভাবাবেগের জয় অবশ্যম্ভাবী। যে প্রণয়াকাঙ্খা মনের অনেক গভীর থেকে উঠে আসে তার জন্য কোনো আইন প্রযোজ্য নয়! তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের সংস্কার আসে বাইরের সমাজ, সভ্যতা ও ধর্ম থেকে; কিন্তু সে আশ্রয় নেয় তার মনে। আর প্রেমানুভূতির সঙ্গে সংস্কারের সংঘর্ষ সবচেয়ে বেশি হয় নারীর মনে। শরৎচন্দ্র সম্ভবত ধারণ করতেন, নারীর সমস্ত চেষ্টার মূলে থাকে প্রেম আর স্নেহ! তাই রাজলক্ষীর ক্ষমতালিপ্সা পূরণ হয় শ্রীকান্তকে পেয়ে আর সাবিত্রীর অধিকারবোধ সীমাবদ্ধ থাকে সতীশকে নিয়ে। নারীর মনকে তিনি দেখেছেন চলমান সংঘাত হিসেবে, যেখানে স্বতঃস্ফূর্ত আকাঙ্খা বাধা পেয়েছে চিরায়ত সংস্কারের দেয়ালে। পল্লীসমাজে-এ রমা রমেশকে ভালোবাসত, বিয়ের কথাও হয়েছিল। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে পল্লীসমাজের নানান দলাদলি ও সংকীর্ণতার মধ্যে রমার একান্ত প্রিয় মানুষও তার শত্রুতে পরিণত হয়। আবার রমা তাকে ভালোও বাসত খুব। এটাই রমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ট্র্যাজেডি।শরৎচন্দ্র সচেতনভাবেই এই মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে নিপুণভাবে তুলে এনেছেন। হতে পারে এটা তাঁর একান্ত নিজস্ব অভিজ্ঞতার ফল অথবা গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার ফসল।
প্রত্যেক খেয়ালি মানুষই স্নেহ ও কৃপার পাত্র, হয়ত মাঝে মাঝে এমনটাই ভাবতেন শরৎচন্দ্র। তাই বড়দিদি মাধবীর সুরেন্দ্রনাথের প্রতি ভালোবাসা জন্মেছিল তার অদ্ভুত চরিত্র দেখে-কোনো কিছুরই খেয়াল খবর সে রাখত না। বিধবা মাধবীর হৃদয়ে প্রমে জেগেছিল খানিকটা মাতৃস্নেহ , পরে তাই রূপান্তরিত হলো প্রেমে। খুব একটা সহজ বিষয় নয় এটা, অন্তত সেই সময়ের জন্য তো অবশ্যই। লেখক এভাবে ভাবতে পেরেছিলেন কারণ মানব আবেগের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তিনি ভালোই ওয়াকিবহাল ছিলেন। আর মানুষ হিসেবে তিনি নিজেও ছিলেন খেয়ালি ও বোহেমিয়ান প্রকৃতির। তিনি হয়ত মনে করতেন পুরুষের মনে প্রেমের আকাঙ্ক্ষা বহু প্রবৃত্তির মধ্যে একটি, পুরুষের অধিকাংশ কাজ বাইরের জগতের সঙ্গে; সেখানে সে অর্থ চায়, ক্ষমতা চায়। তাই গঙ্গামাটিতে যখন শ্রীকান্তের দিন কাটত না, রাজলক্ষী নিজেই বলেছে, ‘গঙ্গামাটির অন্ধকূপে মেয়েমানুষের চলে, পুরুষমানুষের চলে না।’ শ্রীকান্ত আর লেখকের জীবনের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে অনেক মিল থাকলেও, একথা বলা সম্ভব নয় যে শ্রীকান্ত উপন্যাস লেখকের জীবনের ছবি। বরং এটা ভাবাই যুক্তিসঙ্গত যে, এখানে লেখকের মনস্তাত্ত্বিক ছায়া পড়েছে বেশিমাত্রায়।
শরৎচন্দ্রের মননে যেমন নারীর প্রণয়িনী রূপ ছিল, তেমনই ছিল নারীহৃদয়ের বাৎসল্যের রূপ। তাঁর লেখায় নারীহৃদয়ের বাৎসল্য তথা সন্তান স্নেহের বহু চিত্র ফুটে উঠেছে। জননীর যে স্নেহ বহু বাধা অতিক্রম করে তা তাঁকে মুগ্ধ করেছে সবসময়। তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়, আর সেটা হচ্ছে-মাতৃস্নেহ যতটা প্রকাশিত হয়েছে ঈষৎ দূরসম্পর্কিত সন্তানস্থানীয় আত্মীয়ের জন্য; গর্ভজাত সন্তানের জন্য ততটা নয়। রামের সুমতির নারায়ণীর সমস্ত স্নেহ সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে উপচে পড়ত তার সৎ দেবর রামলালের জন্য। তাতে তার স্বামী বা নিজের মা কারোরই সমর্থন ছিল না। তারপরও সে তার নিজের মায়ের নির্মমতা থেকে শিশু দেবরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। রাজলক্ষী তার সন্তানের তৃষ্ণা মিটিয়েছে পরের ছেলে বঙ্কুকে নিজের ছেলে কল্পনার ছেলেখেলা দিয়ে। লেখকের নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা হয়ত তাঁকে নারীর এই মহৎ দিকের পরিচয় দিয়েছিল। তাঁর মনের গভীরে নারীদের মাতৃরূপের এক অনন্য প্রদীপ জ্বলত সবসময়, যা উদ্ভাসিত হয়েছে তাঁর সব সাহিত্যকর্মে। অনেক সময় মনে হতে পারে, তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্রদের কাছে প্রণয়ের পরিণতি হচ্ছে সন্তানকামনা। গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তির অধিকারী লেখক শরৎচন্দ্র তাঁর বিশ্লেষণী মনের সাহায্যে এমন অনুসিদ্ধান্তেই হয়ত পৌঁছেছিলেন।
শরৎচন্দ্রের পুরুষ চরিত্ররা গৌণ। তাদের আবির্ভাব যেন অনেকটা নারী চরিত্রবিকাশের সহায়ক হিসেবে। একদল সরল প্রকৃতির, বৈষয়িক লাভালাভ সম্পর্কে অসচেতন, আরেকদল নিষ্কর্মা ও চরিত্র কালিমালিপ্ত। অনেকেই বাল্যপ্রেমের অভিশাপে নিপীড়িত। দেবদাসের কাহিনিতে মনের দুর্বলতা আর পরাজয়ের গ্লানির আধিক্য। তবু লেখক তাকেই নায়ক করেছেন, সচেতনভাবেই তার প্রতি পাঠকের প্রীতি ও সহানুভূতি আকর্ষণ করেছেন। হয়ত লেখকের মনে এইরকম প্রেমের প্রতি কিংবা প্রেমের ট্র্যাজেক পরিণতির প্রতি গভীর ভালো লাগার বোধ ছিল, ভালোবাসার জন্য জীবনের এই ক্ষয়ের মহানুভবত্ব ছিল। তাঁর এই বোধের প্রকাশ ঘটেছে দেবদাসে। চরিত্রহীন-এ লেখক অনেক সাহসী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি এই নামকরণ করেছিলেন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সতীশকে উপজীব্য করে। তিনি দেবদাসের জন্য সবার অনুকম্পা চেয়েছিলেন, কিন্তু সতীশের জন্য তার কোনো সংকোচ নেই। সম্ভবত তিনি বলতে চেয়েছিলেন প্রচলিত নীতি যাকে চরিত্রহীন বলে ঘৃণা করবে, মতের উদারতায়, মনের গভীরতায়, অনুভূতির ব্যাপকতায় সে অনন্যসাধারণ হতে পারে! হতে পারে সামাজিক সংস্কার আর আচারের বিরুদ্ধে তাঁর মনে যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত ছিল বহুদিন, তাই এখানে বিদ্রোহী হয়ে বের হয়ে এসেছে।
ইন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের অপরূপ সৃষ্টি। সে একজন সত্যিকার মহামানব। নানা প্রতিকূল অবস্থায় সে পড়েছে, খেলার মাঠে মারামারি, গঙ্গায় মাছচুরি, সাপ, বুনো শুয়োরের বন্য পথে বেড়ানো-এসব তার প্রতিদিনের কাজ। জীবন সংগ্রামে ক্ষত-বিক্ষত মানুষের পক্ষে তার অবস্থান। তার আছে নিঃশঙ্ক সাহস, লাভ লোকসান সম্পর্কে নির্লিপ্ততা। তাকে কল্পনা করলে মনে হয়, সে যেন শরৎচন্দ্রের কল্পলোকের আদর্শ মানুষ। লেখক নিজেও হয়ত কল্পনায় এমন মানুষই হতে চাইতেন। তাঁর নিজের কল্পনায় মনের গভীর থেকে উঠে এসেছে ইন্দ্রনাথ। শরৎচন্দ্র এমন মানুষের কথা ভেবেছেন যার মধ্যে মহামানবের বলিষ্ঠতা এবং শিশুর চঞ্চলতা ও সারল্য পাশাপাশি থাকবে। সেই চরিত্রই ইন্দ্রনাথ, যে গভীর রাতে অচেনা মৃতদেহ সৎকারের জন্য তুলে নিয়ে বলতে পারে-‘মড়ার আবার জাত কি?’
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত

Previous articleআশাহীন হওয়া দূর করতে করণীয়
Next articleমানসিকভাবে শক্ত- বোঝার উপায়
রেসিডেন্ট, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here