রাগ: বন্ধু না শত্রু?

নিতু বেশ রাগান্বিত। সে একজন মনোবিজ্ঞানীর কাছে এসেছে কীভাবে রাগ নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তার উপায় জানতে। কেন তার সাহায্য প্রয়োজন তা বলতে বলতে ২০ মিনিটের মধ্যেই নিতু প্রচণ্ড রেগে গেল। নিতুর রাগ তার স্বামী কেন এতটা নির্বোধ। বলতে বলতে নিতু দেখে তার থেরাপিস্ট বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বসে তার কথা শুনছে। নিতুর রাগ আরো বেড়ে গেল। সে জোরে বলে উঠল, ‘উফ! আপনাকে এভাবে শান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে আমার আরো মেজাজ খারাপ হচ্ছে! আমি রেগে গেলে আমার স্বামীও ঠিক এমনভাবেই শান্ত হয়ে বসে থাকে। যেন তার কিছু আসে যায় না, যে আমি কষ্ট পাচ্ছি!’ তার থেরাপিস্ট তাকে এই পর্যায়ে একটি প্রশ্ন করে, ‘আপনি কি আপনার শেষ কথাটি মনে করে আরেকবার বলতে পারবেন?’ নিতু বলল,‘আমি কষ্ট পাচ্ছি।’
কথাটি বলতে না বলতেই নিতু অঝোরে কেঁদে ফেলল। এবার সে কাঁদতে কাঁদতে তার কষ্টগুলোর কথা বলতে শুরু করল। এক পর্যায়ে নিতু থেমে গিয়ে বলল, ‘বাহ! রেগে যাওয়া কত সহজ!’
ঠিক তাই। রাগ খুব সাধারণ একটি মানবীয় আবেগ। এটি আসলে আমাদের পরিবেশের কিছু নির্দিষ্ট উদ্দীপকের প্রতি একটা প্রতিক্রিয়া। যা আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় করার মাধ্যমে ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ (যুদ্ধ অথবা যাত্রা) প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
‘ফাইট অর ফ্লাইট’ একটি শারীরিক প্রতিক্রিয়া। আমরা যখন পরিবেশের কোনো ক্ষতিকর উদ্দীপকের সম্মুখীন হই তখন আমাদের সহানুভূতিশীল (সিম্প্যাথেটিক) স্নায়ুতন্ত্র সেইসব হুমকির জন্য আমাদের প্রস্তুত করে। ভয় এবং রাগ উভয় ক্ষেত্রেই ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স বা প্রতিক্রিয়াটি কাজ করে। যেমন, ভয় আমাদের মধ্যে পলায়নের ইচ্ছা জাগায় (ফ্লাইট), আর রাগ আমাদের ক্ষতিকর উদ্দীপকটির মুখোমুখি হতে সাহায্য করে (ফাইট)।
রাগ এক ধরনের সক্রিয় শক্তির উদ্রেক করে। মাঝে মাঝে এর সাথে যুক্ত হয় প্রেরণা বা মোটিভেশন। অতএব রাগ বা ক্রোধ শক্তি আর সাহস বাড়ায়। তাই কেউ রেগে গেলে আমরা বলি ‘রেগে আগুন হয়ে উঠেছে’ বা ‘রাগে জ্বলে যাচ্ছে’। অর্থাৎ উত্তাপের সাথে রাগের সম্পর্ক দেখানো হয়।
অনেক সাইকোথেরাপিস্ট বলে থাকেন রাগ আবেগটি বৈধ। অর্থাৎ রাগের কারণ আছে বলেই মানুষ রেগে যায়। আবার অনেকে মনে করেন, ভয় বা দুঃখবোধকে ঢাকার জন্য মানুষ রেগে যায়। তবে এটি সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই পার্থক্যটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নিজের অনুভূতিগুলোর সম্মুখীন হওয়া এবং মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রাগ ব্যাবস্থাপনা বা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এমনকি তা কাটিয়ে ওঠাও সম্ভব।
আমাদের গল্পের নিতুকে কিন্তু তার থেরাপিস্ট বলেননি নিতুর রাগ করা উচিত না বা জানতেও চাননি কেন সে রেগে যাচ্ছে। বরং তা না করে তিনি আগ্রহ সহকারে নিতুর কথা শুনেছেন, তার পাশে থেকেছেন। এর কারণ হলো রাগ কাটিয়ে ওঠার প্রথম ধাপ হলো রাগকে চিনতে পারা এবং মেনে নেওয়া। নিতু তখন তাই করেছিল।
গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, ‘রাগ বা ক্রোধ হলো একখণ্ড তপ্ত কয়লা হাতে নেওয়ার সমান, যা তুমি কারো দিকে ছুরে মারতে চাইছ; এতে তুমি নিজেই জ্বলে যাবে।’ কারণ রাগের উত্তাপ আমাদের সহজেই গ্রাস করে ফেলতে পারে। এটি আমাদের মধ্যে আক্রমণাত্মক বা প্রতিশোধের মানসিকতা তৈরি করতে পারে। গৌতম বুদ্ধের বাণীর মর্মার্থ হলো-আমরা যদি অন্যের ক্ষতির উদ্দেশ্যে রাগ ধরে রাখি, তাতে আমরা নিজেরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হই।
রাগের মূল সমস্যা হলো রেগে গেলে আমরা ক্ষতিকর কিছু করতে চেষ্টা করি। কিন্তু আমরা যদি এই আবেগটিকে ধরে রাখার বদলে মুক্ত করে দেই, আমরা নিজেদের সম্পর্কে অনেক কিছু শিখতে পারব। রাগ বা ক্রোধ একটি মাধ্যমিক আবেগ। এর সাথে মিশে থাকে আরো অনেক ধরনের আবেগ। যেমন- দুঃখবোধ, পরাজয়, অপমানবোধ, হতাশা, ভয় এই সবকিছুই রাগের সাথে জড়িত থাকে।
আমাদের গল্পের চরিত্র নিতু কিন্তু শুধু রাগান্বিতই ছিল না। সে তার স্বামীর কাছ থেকে কষ্টও পেয়েছে। রাগ অনুভব করা তার জন্য সহজ ছিল। যতক্ষণ সে রাগান্বিত ছিল, অন্যান্য আরো গভীর অনুভূতিগুলো সে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু রাগ কাটিয়ে ওঠার পর সে বুঝতে পারল তার রাগের উৎস কী ছিল। যখন সে মনোবিজ্ঞানীর চেম্বার থেকে বের হলো, সে খুব শান্তি অনুভব করল। সব কিছু তার কাছে আরো পরিষ্কার হয়ে গেল এবং সে নিজেই বুঝতে পারল সে কীভাবে তার স্বামীর সাথে হওয়া সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবে।
রাগ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের অনেক গভীর চিন্তা-ভাবনা ও আবেগের জায়গাগুলো আবিষ্কার করতে পারি। নিতু যদি তার রাগের উৎস নিয়ে না ভেবে রাগের বশে তার স্বামীর ক্ষতি করতে চেষ্টা করত তাহলে সে কখনই বুঝতে পারত না আসলে সে কতটা কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাগের গভীরে গিয়েই সে নিজেকে চিনতে পেরেছে। নিতু যদি তার রাগকে পুষে রাখত তাহলে কোনো একসময় তা বিশালাকার ধারণ করত এবং সে এমন কিছু করে ফেলতে পারত যা নিয়ে পরে সে আফসোস করত। কিন্তু যেহেতু সে রাগের গভীরে যেতে পেরেছে, রাগের কারণগুলো তার কাছে আরো পরিষ্কার হয়েছে। সে নিজের অনুভূতিগুলোর মুখোমুখি হতে পেরেছে।
ভিয়েতনামি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী থীচ নাত হান তাঁর বই ‘ক্রোধ’ (Anger) –এ বলেছেন, ‘রাগকে নম্রতার সাথে গ্রহণ কর। রাগ তোমার শত্রু নয়, এটি তোমার সন্তান। এটি তোমার পাকস্থলী বা ফুসফুসের মতো। পাকস্থলী বা ফুসফুসে কোনো সমস্যা হলে তুমি তা ফেলে দেওয়ার কথা ভাব না। রাগের ক্ষেত্রেও তাই। রাগকে গ্রহণ কর, কারণ তুমি তাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে কাজে লাগাতে পারবে।’
প্রতিটি আবেগই আমাদের নিজস্ব সত্তার সাথে পরিচিত হতে সাহায্য করে। নিজেকে বোঝার মাধ্যমেই আমরা জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখীন হওয়ার অনুপ্রেরণা পাই। অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে চালিত করতে পারি। রাগের সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে। তবেই আমরা তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারব।
তাহলে পরবর্তীতে আমরা রেগে গেলে আমাদের করণীয় হলো রাগকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা। রেগে যাওয়া ব্যক্তির প্রতি উল্টো রাগ প্রকাশ না করে সে কী বলতে চায় তা শুনতে চেষ্টা করা। কে জানে, এতে হয়তো আমাদের নিজেদের ব্যক্তিত্বেরও কোনো নতুন দিক আমাদের সামনে উন্মোচিত হবে।
 
তথ্যসূত্র: https://www.psychologytoday.com/blog/mindfully-present-fully-alive/201711/fanning-the-flames-anger
 
এমজেএস/এফএস /এমএসএ

Previous articleপ্রতিবন্ধী শিক্ষাটাকে এদেশে সমাজকল্যাণ ইস্যু হিসেবে দেখা হয়
Next articleঅর্থনৈতিক সাম্য ও বিষণ্নতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here