মানুষের মনে মনস্তাত্ত্বিক অপরাধ

মানুষের মনে মনস্তাত্ত্বিক অপরাধ

প্রতিটি মানুষের মন মুক্তবিহঙ্গ যা ইচ্ছা ভাবতে পারে। মনের আবার অপরাধ কিসের? মন কি আসলেই অপরাধ করে? নাকি সব অপরাধের পেছনে মনই আসল কারণ?

দীর্ঘদিন ধরে অপরাধবিজ্ঞানীরা মনের অপরাধ বা মনস্তাত্ত্বিক অপরাধ নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। অপরাধবিজ্ঞানীদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন, জৈবিক ও জন্মগত ত্রুটির কারণে মানুষ মনস্তাত্ত্বিক অপরাধে জড়ায়। আবার কেউ বলেছেন, পারিপার্শ্বিক ও পরিবেশগত কারণই এ অপরাধের পেছনে দায়ী।

সম্প্রতি আমাদের দেশে কিছু অস্বাভাবিক ধরনের অপরাধের ঘটনা দেখা গেছে। যেমন সন্তান মা-বাবাকে হত্যা করেছে আবার মা সন্তানকে হত্যা করেছে, প্রেমিকাকে হত্যার চেষ্টা, স্ত্রীকে পাচার করা, শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতন, আত্মহত্যায় প্ররোচনা প্রভৃতি। অপরাধবিজ্ঞান এ ধরনের অপরাধের পেছনে মানুষের মনকেই দায়ী করেছে। আর এ মন নিয়ন্ত্রণ করে অনেকাংশে পরিবেশ পরিস্থিতি।

মানুষের মন কিভাবে মনস্তাত্ত্বিক অপরাধে জড়িত হয় তা নিয়ে আজকের আলোচনা। নিন্মে কিছু মনস্তাত্ত্বিক অপরাধ তুলে ধরা হলো:

দুষ্টু মন

আইনে মেনস রিয়া নামে একটি শব্দ আছে, যার অর্থ হচ্ছে দুষ্টু মন। এ দুষ্টু মনকে অপরাধ সংঘটনের পেছনে অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। এ দুষ্টু মন হচ্ছে অপরাধটি সংঘটনের সময় দায়ী ব্যক্তির ইচ্ছা, অভিপ্রায় কিংবা উদ্দেশ্য। অপরাধীর অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে মনের ইচ্ছা বা অভিপ্রায় কতখানি তা আইন খুঁটিয়ে দেখে। নিছক আবেগের বশে কোনো অপরাধ আর পূর্বপরিকল্পনা করে অপরাধের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

এ জন্য দণ্ডবিধিতে নরহত্যা এবং খুনের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য টানা হয়েছে। নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য যদি কোনো অপরাধ ঘটে যায় তাহলে এটি আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও অপরাধের মনস্তত্ত্ব বিষয়টি অস্পষ্ট তবুও বিচারের ক্ষেত্রে একজন বিচারককে এ বিষয়টি সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হয়।

মানুষের কামনা, বাসনা, ইচ্ছা, অভ্যাস এসবের সঙ্গে পরিবেশ পরিস্থিতি কীভাবে মনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং আইন ভাঙার ক্ষেত্রে তা কীভাবে ভূমিকা রাখে তা বিচার-বিশ্লেষণ করতে হয়। মানসিক বিকারগ্রস্তদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, মানসিক বিকারগ্রস্ত লোকদের হিতাহিতজ্ঞান লোপ পেয়ে এমন একপর্যায়ে পৌঁছায় যে কোনটা অপরাধ বা ঘৃণিত কাজ তা বুঝতে পারে না।

ব্যক্তি বিশেষের অপরাধের ধরন অনুযায়ী শাস্তির মাত্রাও তারতম্য হয়। যেমন একটি কিশোর বা কিশোরীর অপরাধ আর পূর্ণবয়স্কের অপরাধ এক হবে না। আবার পাগল বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অপরাধের মাত্রাও ভিন্ন হবে। শাস্তির ক্ষেত্রেও রয়েছে ভিন্নতা।

নারী পুরুষের মনের অপরাধ কি ভিন্ন?

নারী ও পুরুষের অপরাধের ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। যদিও অপরাধীর সংজ্ঞায় নারী বা পুরুষের অপরাধের ভিন্ন কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা নারীদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টিকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।

নারীর অপরাধের ক্ষেত্রে শারীরিক ভিন্নতা, পুরুষের ওপর নির্ভরশীলতা, প্রেমে ব্যর্থতা, নিরাপত্তাহীনতা, নির্যাতনের শিকার, উচ্চ বিলাসিতা ইত্যাদিকে দায়ী করা হয়। নারীদের বিয়ে সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত হতে দেখা যায়। অনেক সময় আগের বিয়ের ঘটনা লুকিয়ে নতুন বিয়ে করে মিথ্যা নারী নির্যাতন বা যৌতুকের মামলা দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করে।

আবার প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে অনেক টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করে পরবর্তী সময়ে তালাক দিয়ে দেনমোহরের টাকা দাবি করতে থাকে। অনেক সময় মামলা দায়ের করে তা আদায়ের ঘটনা দেখা দেয়। এছাড়া চুরি, চোরাচালান, মাদক গ্রহণ এবং ব্যবসার ক্ষেত্রেও নারীরা জড়িয়ে পড়েন। তবে এ ধরনের অপরাধ ঘটানোর ক্ষেত্রে পুরুষের সংখ্যা নারীর থেকে কোনো কোনো জায়গায় বেশি।

পারিবারিক নির্যাতন কি মনস্তাত্ত্বিক অপরাধ?

পারিবারিক যেসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটে এর পেছনে মনস্তাত্ত্বিক কারণ দায়ী বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। অনেক সময়ই পরিবারের ঘনিষ্ঠজনের মাধ্যমে প্রাপ্ত বা অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীরা বিভিন্ন অশালীন আচরণের শিকার হন। এমনকি ধর্ষণের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে। শুধু তা-ই নয়, অনেক ছেলে শিশুও যৌন হয়রানির শিকার হয়।

স্ত্রীকে স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির লোকজন দ্বারা মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন, অর্থনৈতিক নির্যাতনের পেছনে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো প্রভাব ফেলে। এ ধরনের পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী বা শিশু হতাশায় এবং চেপে থাকা কষ্ট থেকে নিজেরাও অনেক অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

সম্মোহন এবং প্ররোচনা

অনেক অপরাধী নিজেরা অপরাধ করার পাশাপাশি সহজ-সরল ব্যক্তিকে বিভিন্নভাবে সম্মোহন করে। প্ররোচনা কিংবা লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়ানোর চেষ্টা করে। বিশেষ করে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটাতে জঙ্গিদের এ কৌশল অবলম্বন করতে দেখা গেছে।

নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে অপব্যাখ্যা করে এবং ভ্রান্ত বিশ্বাসকে পুঁজি করে নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়ে অপরাধে জড়িয়ে ফেলে। এ ধরনের সম্মোহনের ফলে নিরপরাধ ব্যক্তি খুব সহজে সম্মোহিত হয়ে নিজের অজান্তে অপরাধজগতে পা বাড়ায়। এমনকি আত্মঘাতী পর্যন্ত হয়ে পড়ে। এ ধরনের অপরাধ এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক অপরাধ।

শাস্তি এবং পরিত্রাণের উপায়

আইন বলে অপরাধ যে মাত্রারই হোক না কেন তা যদি অপরাধী মন নিয়ে করা হয়, এর জন্য শাস্তি পেতে হবে। অপরাধের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন আইনে বিভিন্ন শাস্তি নির্ধারিত আছে। এমনকি মৃত্যুদণ্ডের বিধান পর্যন্ত রয়েছে প্রচলিত আইনে। তবে শাস্তির ব্যাপারে নারী অপরাধীর ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা রয়েছে। জামিন পাওয়ার বেলায়ও নারীদের বিশেষ বিবেচনা করা হয়।

মনস্তাত্ত্বিক অপরাধ থেকে পরিত্রাণের সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে মনকে নিয়ন্ত্রণ এবং আইন সম্পর্কে সচেতন হওয়া। শাস্তির পাশাপাশি সংশোধনের সুযোগ রাখা উচিত। বিশ্বের অনেক দেশেই অপরাধীদের সংশোধনের সুযোগ রাখা হয়েছে। আমাদের দেশে শিশু আইনে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা রয়েছে।

সূত্র: প্রথম আলো

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleরোমান্টিক সম্পর্ক বাড়াতে সঙ্গীর সাথে যা করবেন
Next articleমহামারীতে শিশুদের যত্নে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা ও সমাধান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here