মানসিক সুস্থতায় সুষম খাদ্য

স্বাস্থ্যকর খাবারই ডায়েটের প্রধান চাবিকাঠি

সুস্বাস্থ্যের জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের প্রয়োজন। সুস্বাস্থ্য ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক এই তিন অবস্থার একটি সমন্বয়।

সুস্বাস্থ্যের জন্য রোগমুক্ত সুস্থ শরীরের সঙ্গে ভয়, হতাশা, বিষণ্নতা ও মানসিক চাপমুক্ত থাকা প্রয়োজন। ব্যক্তির চাহিদা অনুযায়ী সুষম খাদ্য গ্রহণ আমাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।

যাদের খাবারে বেশি শাকসবজি, ফল, বাদাম, শস্য, মাছ, অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড জাতীয় খাদ্য ও মাছের তেলের সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করেছে, তাদের (কন্ট্রোল গ্রুপ) মধ্যে বিষণ্নতা কমে গেছে। আবার আরলি অ্যাজে (জন্ম থেকে আট বছর বয়স) কম পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাদ্য, বেশি সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড, পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্যগ্রহণ শৈশব ও কৈশোরকালে দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অপুষ্টি ও অতিপুষ্টির কারণে শারীরিক সমস্যা তৈরি হয়।

আমরা জানি স্থূলতার পেছনে একাধিক কারণ আছে, আবার অসম খাদ্যাভ্যাসের কারণে স্থূলতা হতে পারে। স্থূলতা ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে একটি জটিল সম্পর্ক রয়েছে। যাঁদের বিষণ্নতা আছে, তাদের মধ্যে স্থূলতা হওয়ার আশঙ্কা ৫৮ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে যাঁরা স্থুল, তাঁদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ বেশি আশঙ্কা বিষণ্নতা হওয়ার।

অসামঞ্জস্য বা কম পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে বিষণ্নতা ও উদ্বেগের রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। এখন গবেষকেরা চিন্তা করছেন খাদ্যের অ্যালার্জি বাইপোলার ডিজ-অর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, মুড ডিজ-অর্ডারের সম্পর্ক থাকতে পারে। কিছু গবেষণা বলছে, অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যায়।

পুষ্টিকর স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য মস্তিষ্কের বিকাশ বৃদ্ধি করে থাকে। ব্রেনের প্রোটিন ও এনজাইম নিউরো ট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করে, কিছু হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে এবং স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যকে উন্নত করে। খাদ্য অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করে। যা অন্ত্রের ভেতরের অবস্থাকে সুষ্ঠু রাখতে সাহায্য করে। ফলে অন্ত্রের প্রদাহ কমে যায়। প্রদাহ চিন্তাধারা ও মেজাজের ওপর প্রভাব ফেলে।

পরিপাকতন্ত্রে সেরোটিনিন উৎপন্ন হয়। খাদ্য সেরোটিনিন মাত্রা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। সেরোটিনিন মস্তিষ্কের স্নায়ুকে সংযোগকারী একটি নিউরোট্রান্সমিটার। যা মেজাজ, আনন্দ, চিন্তা, ঘুম প্রভৃতি প্রভাবিত করে। কিছু কিছু খাদ্য আমাদের মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।

ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিড: এটি মুড, চিন্তা করতে ও চিন্তাকে উন্নত করতে সাহায্য করে। ওমেগা ৩ হলো অসম্পৃক্ত ফ্যাট, যা মূলত মাছের তেলে পাওয়া যায়। তবে সামুদ্রিক মাছে বেশি পাওয়া যায়। ইলিশ, টুনা, স্যামন, সাডিন মাছ ছাড়াও কিছু খাবারে পাওয়া যায়। যেমন আখরোট, চিয়াসিড, তিসির তেল, সয়াবিন, সবুজ পাতাওয়ালা সবজি। প্রতিদিন চাহিদামতো ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিডসমৃদ্ধ খাদ্য মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহের মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে ও প্রদাহ কমায়।

জিঙ্ক: রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। আবার খাদ্যে জিঙ্ক কম থাকলে তা বিষণ্নতার কারণ হয়। জিঙ্ক আমাদের স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করে। দই, মাছ, গরুর মাংস, ডিম, দুধ, পনির, মিষ্টিকুমড়ার বিচি, মাশরুম, তিল, চিনাবাদাম, কাজুবাদাম, পালংশাক ইত্যাদি জিঙ্কের ভালো উৎস।

ভিটামিন সি: ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ খাবার প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় রাখা প্রয়োজন। এটি অ্যান্টি- অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, কোলাজেন কলার নমনীয়তা রক্ষা করে দ্রুত ঘা শুকায়। ভিটামিন সি বিষণ্নতা কমাতে সাহায্য করে। মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের চলাচল ও তথ্য আদান-প্রদানে ভূমিকা রাখে। এটি সেরোটিনিন তৈরির কাজে লাগে।

আমাদের আবেগ, মেজাজ, ব্যথা-বেদনা ও অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে সেরোটিনিনের ভূমিকা রয়েছে। অন্ত্রে আয়রণ শোষণে এটি কাজ করে। লেবু ও লেবুজাতীয় ফল ভিটামিন সির উৎস। কমলা, আমলকী, জাম্বুরা, মাল্টা, বরই, কাঁচা মরিচ, জাম, আঙুর, পেঁপে, সবুজ শাকসবজি প্রভৃতিতে ভিটামিন সি পাওয়া যায়।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: অ্যান্টি অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাদ্য ক্লান্তি দূর করতে, প্রাণোচ্ছলতা বজায় রাখতে, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ভিটামিন সি, ই, বিটা ক্যারোটিন, কাঠবাদাম, গ্রিন টি, লাল আটা, বাদাম প্রভৃতি। এগুলো স্মৃতিশক্তিজনিত সমস্যা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।

আয়রণ: আয়রণের অভাবে অ্যানিমিয়া হয়ে থাকে। আর এ কারণে বিষণ্নতা তৈরি হতে পারে। হিমোগ্লোবিনের অভাবে শরীরে যেমন নানা রকম সমস্যা তৈরি হয়, ঠিক একইভাবে মনোযোগে সমস্যা হয়। কোনো কিছুতে মনোযোগ দেওয়া যায় না। গরু বা খাসির কলিজা, গরুর মাংস, ডিম, ছোলা, আটা, শিমের বিচি, গুড়, খেজুর, কিশমিশ, কলা, জাম, আমড়া, তরমুজ, মেথি, পুঁইশাক, ছোলা শাক, কালো কচুশাক, পালংশাক প্রভৃতির মাধ্যমে এই ঘাটতি দূর হয়।

বি১২: এই ভিটামিনের অভাবে অবসাদ, ক্লান্তি, বিরক্তি, মানসিক চাপ, হতাশার মতো সমস্যা হয়। বিস্মৃতি বা ভুলে যাওয়া ভিটামিন বি১২ ঘাটতির কারণে হয়ে থাকে। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে। তাই স্মৃতিশক্তিকে উন্নত করতে ভিটামিন১২-সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। দুধ, ডিম, পনির, কম চর্বিযুক্ত দইয়ে ভিটামিন১২ পাওয়া যায়।

দানা শস্য: শস্যদানায় থাকে আঁশ, নানা ধরনের ভিটামিন ও খনিজ। লাল আটা, লাল চাল দিয়ে তৈরি খাদ্য উপকারী। দানা শস্য পরিশোধন করা হলে এর পুষ্টিগুণ অনেকটা কমে যায়। দানা শস্য থেকে গ্লুকোজ পাওয়া যায়। গ্লুকোজ সরাসরি মস্তিষ্কে ব্যবহৃত হয়। লো জিআই-সমৃদ্ধ খাবারগুলো রক্তে ধীরে ধীরে শক্তি সরবরাহ করে দিনভর মানসিকভাবে সচেতন থাকতে সাহায্য করে।

গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বা জিআই অথবা লো-জিআই হচ্ছে খাদ্য গ্রহণের ২ ঘণ্টার মধ্যে রক্তের গ্লুকোজের মোট মাত্রা বৃদ্ধিকে বোঝায়। জিআই নির্ভর করে খাদ্যে অবস্থিত কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট ও খাদ্যের আঁশের ওপর। গ্লুকোজের জিআই ১০০, মাছ ও মাংসের জিআই শূন্য, ডাল, দুধ, সবজি ও বেশির ভাগ ফলের জিআই কম। বাদামি চাল, আস্ত গম মধ্যম জিআই-সমৃদ্ধ খাদ্য।

মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হলে সুষম খাবার গ্রহণের অভ্যাস তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে খাবার সুষম হবে? আমাদের প্রতিদিনের খাবারে শস্য-জাতীয় খাবার যেমন চাল-আটা-ভুট্টা, প্রোটিন জাতীয় খাবার মাছ-মাংস-ডিম-ডাল চাহিদা অনুযায়ী রাখা।

দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাদ্য বয়সভেদে পরিমিত পরিমাণে বা চাহিদা অনুযায়ী, শাকসবজি ও ফলমূল পর্যাপ্ত পরিমাণে ও তেল ও চর্বি জাতীয় খাদ্য বয়সভেদে প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণ করা প্রয়োজন। অপুষ্টি বা অতিপুষ্টি দুটি অবস্থায় শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। তাই বয়স, লিঙ্গ, কাজের ধরনের ওপর ভিত্তি করে দৈনিক ক্যালরি গ্রহণ করতে হবে।

Previous articleযৌন দুর্বলতায় মুক্তির ‍উপায়
Next articleকরোনা মোকাবেলায় আতঙ্ক নয় বরং সতর্কতাই মূল কথা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here