মানসিক রোগ: অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি) বা শুচিবাই

মানসিক রোগ

আধুনিক চালচিত্রের সঙ্গে যেসব শব্দ আমাদের বাংলা ভাষাতে যোগ হয়েছে, ‘অবসেশন’ বা ‘আবিষ্কারের নেশা’ তাদের অন্যতম। শব্দ হিসেবে চমৎকার হলেও এর ঠিক পেছনে একটি সমস্যাও রয়ে গেছে, সেটি একটি রোগ, যার নাম- ‘অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি) বা ‘শুচিবাই’।
এ রোগের  ক্ষেত্রে বেশিভাগ সময়ই ভুক্তভোগী রোগীর কষ্টকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করার আগেই অনেক সময় পার হয়ে যায়। আবার চিহ্নিত হবার পরও এর চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে থেকে যায় বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি।
অবসেশন
যেকোনো বিষয়ে মনের মাঝে বারবার আসা চিন্তাকেই ‘অবসেশন’ বলে। অবসেশন মানুষের একটি সহজাত ধর্ম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি মনের অজান্তে হয়ে থাকে। একে ‘আবিষ্কারের নেশা’ হিসেবেও অ্যাখ্যা দেওয়া যায়। কেননা চিন্তাটি বারবার মনে এসে একটি তাড়না তৈরি করে বলেই মানুষ কিছু আবিষ্কার করতে পারে, সেটি কোনো যন্ত্রই হোক বা লেখা কোনো বই বা উপন্যাসই হোক।
অবসেশন বা এধরণের চিন্তার বিষয় যেকোন কিছু হতে পারে। ভালো-মন্দ, সুন্দর- অসুন্দর ‍বা নতুন কিছু সব ধরনের চিন্তাই মনে আসতে পারে। তবে রোগের ক্ষেত্রে অর্থাৎ ওসিডি-এর ক্ষেত্রে চিন্তার বিষয় গুলো সাধারণত হয় ময়লা, ধর্ম, যৌনতা, বিভিন্ন রকমের রোগ, রাগ ইত্যাদি নিয়ে।
চিন্তাগুলি যে সবসময় স্বাভাবিক হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। ধরা যাক, ধর্ম বা যৌনতা নিয়ে অস্বাভাবিক কোনো একটি চিন্তা বারবার কারো মনে আসছে, যেটিকে তিনি ‘সত্য নয়’ বলেই জানেন। যেটিকে তিনি বারবার মন থেকে সরাতে চাচ্ছেন কিন্তু সরছে না। তখন তার মনের অবস্থা কি হতে পারে!!
অনেকে নামাজে দাঁড়িয়ে বারবার নামাজ ছেড়ে দেন, উল্টাপাল্টা চিন্তা মনে আসার কারণে। অনেকে জানেন তার কোনো অসুখ (শারিরীক) নেই তবু বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে থাকেন, ডাক্তারের কাছে যেতে থাকেন।
আমি এমন একজন ছাত্রকে দেখেছি যে, এসএসসিতে স্ট্যান্ড করার পর এইচএসসিতে এসে একটি বইয়ের একটি পৃষ্ঠাই বারবার পড়েছে। কারণ পরের পৃষ্ঠায় যাবার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হতে থাকে, আমি আগের পৃষ্ঠা পড়িনি। এভাবে দেখা যায় সে বারবারই একই পৃষ্ঠা পড়ছে।
পড়াশোনা ও খেলাধুলাসহ অনেক ক্ষেত্রেই অবসেশনের প্রয়োজনীয়তা অবধারিত। তবে তা যখন মাত্রারিক্ত হয়ে যায় এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটায় তখনই তাকে রোগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
ওসিডি এর ক্ষেত্রে অবসেশনের বৈশিষ্ট যেমন হয়:
১.    একটি চিন্তা মনের মধ্যে বারবার আসতে থাকে, যে চিন্তাটি তিনি করতে চান না।
২.    অর্থাৎ চিন্তাটি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মনের মাঝে আসতে থাকে।
৩.    চিন্তাটি ব্যক্তির কাছে অপ্রয়োজনীয় বা অহেতুক মনে হয় এবং সেই সঙ্গে মনের মধ্যে প্রচণ্ড এক বিরক্তি তৈরি করে।
৪.    চিন্তাকে তিনি দূরে সরিয়ে দিতে চান, যদিও তিনি জানেন চিন্তাটি তার মনের ভেতর থেকে আসা একটি নিজস্ব চিন্তা।
৫.    সেই সঙ্গে অনেক সময় চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কাজটিও হয়ত তিনি অবচেতনেই করতে থাকেন, যা তিনি নিজেও হয়তো একেবারেই পছন্দ করেন না।
কম্পালশান:
আমরা জানি মানুষ কাজের মাধ্যমে তার চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটান। অবসেশন নিজেও যেহেতু একধরনের চিন্তা সুতরাং এটিরও একরকম প্রকাশ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এখানে অবসেশনের ফল হিসেবে বা বারবার আসা চিন্তার কারণে করা কাজকেই বলা হয়  ‘কম্পালশান’।
একটি কথা মনে রাখা জরুরি, সবক্ষেত্রে অবসেশনের ফলে কম্পালশান নাও থাকতে পারে। ভিতরে ভিতরে চিন্তাটি কাজ করলেও তার বিপরীতে অনেক সময় কম্পালশান থাকেনা।
অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসর্ডার
ধরা যাক  কারো মনে হলো, তার হাতে বা গায়ে ময়লা লেগে আছে। যদিও তিনি ভালো করেই জানেন কোথাও ময়লা নেই, তরপরও চিন্তাটি বারবার আসতে থাকে এবং তিনি বারবার হাত ধুতে যান। এমনকি বারবার সাবান ব্যবহার করতে থাকেন। এখানে ময়লার চিন্তাটি হলো ‘অবসেশন’, আর হাত ধোয়াকে বলা হবে ‘কম্পালশান’। এ দুটি মিলিয়েই মানসিক রোগ এর নাম দেওয়া হয়েছে অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার বা ওসিডি যাকে বাংলায় ‘শুচিবাই’ বলা হয়।
ওসিডি বা শুচিবাই’র কারণ
অন্য অনেক মানসিক রোগের মত ওসিডিরও সঠিক কোনো কারণ এখনও আবিষ্কার হয়নি। কেউ বলেন মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ফাংশন কম হওয়ার কারণে, কেউ বলেন কিছু কিছু নিউরোকেমিক্যালের তারতম্যের কারণে, কেউ আবার জেনেটিক বিষয়গুলোকে কারণ হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। এসবের মধ্যে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু স্থানে সামান্য তারতম্যের বিষয়টিকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
ওসিডি বা শুচিবাই’র চিকিৎসা
যেহেতু আপাত দৃষ্টিতে অন্য কোনো অসুবিধা দেখা যায় না, তাই সহজে এটিকে কেউ রোগ হিসেবে মানতে চান না। ভুক্তভোগীর ভেতরের কষ্টকে অনেক সময় অবহেলা করা হয় এই ভেবে যে, ‘ঐ চিন্তা’ না করলেই তো হয়। অনেক সময় সমস্যার ধরন ও এর ভেতরের বিষয়ের কারণে রোগী নিজেও তার সমস্যাটি প্রকাশ করতে চান না। ‘বলার মতো না’, এমনটা ভেবে নিজেই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করতে চান।
যতো আগে চিকিৎসা শুরু করা যায়, ততোই ভালো। ওষুধ ও সাইকোথেরাপি, দুটোই প্রয়োজনীয়। নির্দিষ্ট করে বললে, ক্লোফ্রানিল বা এসএসআরআই গ্রুপের যে কোনো ওষুধ, সেই সঙ্গে সাইকোথেরাপি ‘সিবিটি’ বা ‘কিউ এক্সপোজার ও রেসপন্স প্রিভেনশান’। তবে সিভিয়ার ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপিও কম কাজ করতে চায়।
মনে রাখতে হবে, সঠিক চিকিৎসার অভাবে অনেক ক্ষেত্রে ওসিডির রোগী আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে পারেন।

Previous articleআপনি জেনারালাইজড এনজাইটি ডিসঅর্ডারে ভুগছেন
Next articleআমি সব মানুষের সাথে মিশতে পারি না
চেয়ারম্যান, মনোরোগবিদ্যাি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here