গতিশীল রাষ্ট্রের প্রধান অন্তরায় ‘মাদক’

0
56
প্রতীকী ছবি

ড্রাগ শব্দটি এসেছে ইটালি থেকে। ইটালিয়ান শব্দ ড্রখে থেকে ড্রাগ। সভ্যতার শুরুতে মানুষ গাছপাতা লতাগুল্মের নির্যাস নানাবিধ রোগের ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করতো। ওই নির্যাসই ড্রখে বলে পরিচিত ছিল। সভ্যতার বিবর্তনে আজ মানুষের জীবন বাঁচাতে নিজেরাই হাজারো ড্রাগ আবিষ্কার করেছে। অব্যাহত আছে নতুন কোনো মাদক আবিষ্কারের।

ওই ড্রাগই একসময় ‘মাদক’ নাম ধারণ করে সভ্যতাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে কিছু মানুষের হাত বেয়ে আফগানিস্তান পাকিস্তান ভারত বার্মা লাউস কম্বোডিয়া হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছে। যার ফলে মাদক নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয়েছে বিশ্বকে। বাংলাদেশও ছিল একসময় নিরাপদ ট্রানজিট।

জর্দা, গুল, হুক্কা, পাতার বিড়ি, চুরট, তারি, বাংলা মদ বা চুলাই মদ এবং গাঁজা ছিল একসময় এতদ অঞ্চলের তথা পাকভারত উপমহাদেশের মানুষের মাদকাসক্তির অন্যতম মাধ্যম। এসবের ব্যবহার আজোবধি সমানতালে বিদ্যমান।

একসময় ইউরোপ আমেরিকা থেকে পর্যন্ত এই উপমহাদেশে বিশেষ করে পাকভারত উপমহাদেশে হিপ্পি জিপসীরা কথিত পীর ফকিরের দরগায় চলে আসতো গাঁজার কলকীর টানে।

বিশ্বসভ্যতায় দ্রুত আর্থ-সামাজিক বিবর্তনের সাথে সাথে যে ড্রাগ একদিন মানুষের জীবন বাঁচাতে আবিষ্কার হয়েছিলো, তথাকথিত সভ্যতার নামে সেই ড্রাগই মানুষের জীবন কেড়ে নিতে শুরু করে!

৮০’র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে হেরোইন মরফিন পেথিডিন মাদক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, এমনটি মানুষ জানতে পারে। অতি লাভজনক ব্যবসা হওয়ার কারণে এসব মাদক ব্যবসার সাথে তখন নাম উঠে আসে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের।

নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে ব্যাপকতা পায় ফেনসিডিলের। রাষ্ট্রের উঁচু নিচু সকল শ্রেণী পেশার মানুষের একটি বড় অংশ ফেনসিডিলে আসক্ত হয়। একসময় দাম হাতের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় টিকটিকির লেজ, জুতার কালির মতো মাদকের সাথেও যুক্ত হতে শুরু করে একশ্রেণীর মানুষ।

একুশ শতকের শুরুতে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার ফেনসিডিল দেশের অভ্যন্তরে পৌঁছে যায় হাজারো সিন্ডিকেটের হাত ধরে।

একসময় নেশার জগতে যুক্ত হয় বুপ্রিনরপাইন ইনজেকশন। ভারত থেকে আসা ওই নেশা জাতীয় দ্রব্যও পৌঁছে যায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পৌঁছে যায়।

২১ শতকে এসে মাদকাসক্তিতে নতুন যোগ হয় ইয়াবা। বর্তমানে ইয়াবার ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে বাংলাদেশের আটষট্টি হাজার গ্রাম পর্যন্ত। আর ইয়াবার সাথে এমন কোনো শ্রেণিপেশার মানুষ বাদ নেই, যারা ক্রেতাবিক্রেতা হিসেবে জড়িত হয়নি।

দেশে দুই বছর ধরে মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযানে মাদক ব্যবসায়ী নিহত হলেও ব্যবসা ও সেবন কমেনি উল্লেখ করার মত। বরং মিয়ানমার ভারত থেকে মাদকের বড় বড় চালান দেশের অভ্যন্তরে আসা অব্যাহত রয়েছে।

মাদকের ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা আইনের আওতায় আসলেও বড় ব্যবসায়ীরা (নেপথ্যে থেকে অর্থের যোগানদাতারা ) ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ায় মাদকের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা।

এমনি অবস্থায় অপ্রতিরোধ্য বিশেষ করে ওই বড় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়ে তাদের সমূলে উৎপাটন অথবা দমন না করলে ভবিষ্যতে সুস্থ জাতি গঠনে বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও বিশিষ্টজনরা মনে করেন।

পরিস্থিতি কতটা খারাপ তা আদালতের দিকে দৃষ্টি দিলেই বুঝা যায়। দায়রা আদালতে প্রতিদিন যেসব মামলার আসামির জামিন হয় এর আশি শতাংশই মাদক বিশেষ করে ইয়াবা মামলা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যুবকরাই এর সাথে যুক্ত। আলাপ করে জানা গেছে, তাদের বড় অংশই বড় ব্যবসায়ীর দ্বারা টাকার বিনিময়ে ব্যবহৃত হচ্ছে।

একটি জাতির মূল চালিকাশক্তি শক্তি যুবসমাজ। এই যুবসমাজের উপরই অবিরাম আঘাত হেনেছে সর্বনাশা মাদক। সভ্যতার বিবর্তনে একেকবার একেকটি নাম ধারণ করে উপস্থাপিত হয়েছে মাদক। আর মাদকাসক্ত হয়ে চোখের সামনে কত তাজা প্রাণ ঝরছে আর ঝরছে, রাষ্ট্র ক’টি তার হিসাব রাখে!

একটি পরিবারের আশাআকাঙ্ক্ষা ও ভরসাস্থল পরম মমতায় বেড়ে উঠা একটি সন্তান। জন্মের পর সে কেবল পরিবারের সম্পদ হলেও, খেলাধুলার বয়স হলে সে সমাজের এবং সে যখন স্কুলে যায় তখন সে রাষ্ট্রের সম্পদ।

আমরা আমাদের সন্তানকে এভাবে অতল অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। সুতরাং আমাদের সন্তান আর রাষ্ট্রের সম্পদ সুরক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রকে দায়সারা নয় বরং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ আগামীর জন্য।

ম.ম জুয়েলের গবেষণালব্দ চরণ দুটি আমার মন ছুঁয়েছে। প্রকৃত পক্ষেই চিরন্তন “মাদক কারো বন্ধু নয়, জীবন যৌবন করে ক্ষয়”। যৌবন না থাকলে জীবন মূল্যহীন। আর মূল্যহীন জীবন পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি নিজের কাছেও অপাঙক্তেয়।

আমি বিশ্বাস করতে চাই, কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, কারো ক্রীড়ানক হয়ে সর্বনাশা মাদকের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করবে না আমাদের পরমাদরের সন্তানেরা। বরং একটি সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আর রাষ্ট্রও যুবসমাজকে রক্ষায় যথাযথ ভূমিকা পালন করবে।

নতুন সূর্য, নতুন আলো, নতুন ভোরের অপেক্ষার প্রহর হয়তো শেষ হবে সহসাই- আমরা আমাদের সন্তানদের কাছে থেকে এ আশা করতেই পারি।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে 

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪

 

Previous articleএন্ডোমেট্রিওসিস প্রতিরোধে আলোচনা সভা
Next articleতরুণদের মানসিক অসুস্থতার কারণে বিশ্বে বাৎসরিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৯০ বিলিয়ন ডলার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here