মাদক যৌনজীবনে প্রভাব ফেলে

ইরেকশন বা লিঙ্গের উত্থান একটি জটিল নিউরোভাসকুলার ফেনোমেনা। নিউরো মানে আমাদের স্নায়ুয়তন্ত্র এবং ভাসকুলার মানে আমাদের রক্ত সংবহনতন্ত্র। আমাদের স্নাুয়তন্ত্রের আবার দুটি ধরন আছে। একটি আমাদের ইচ্ছাধীন অপরটি স্বয়ংক্রিয়। এই স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রটি যৌনক্রিয়ার সাথে সরাসরি জড়িত বা বলা যেতে পারে এটা তারই কাজ।

স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের ওপর মনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তাই লিঙ্গের উত্থান অক্ষত মনোসামাজিক অবস্থা, স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের সমন্বিত কার্যক্রমের সার্থক ফলাফল। এই তিনটির কোনো একটিতে সমস্যা দেখা দিলে ইরেকশন ব্যাহত হয়। প্রিম্যাচিউর ইজাকুলেশন বা দ্রুত বীর্যপাত হয় মূলত স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের অতি সংবেদনশীলতার কারণে। আবার সংবেদনশীলতা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে গেলে বীর্যপাত দেরিতে হয়-যাকে আমরা বলি ডিলেইড ইজাকুলেশন। যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়া আরেক ধরনের যৌন রোগ যেক্ষেত্রে একজন পুরুষ যৌন বিষয়ে কোনো ধরনের আগ্রহ পায় না। এটা হয় শরীরের কিছু গোনাডাল বা যৌন হরমোন কমে যাওয়ার কারণে।

পুরুষদের মতো নারীদেরও কিছু যৌন রোগ হয় নেশার কারণে। শারীরিক ভিন্নতার কারণে তাদের যৌন রোগগুলোর ধরনও আলাদা। তবে যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়াটা একই রকমের। নারীদের ক্ষেত্রেও সমস্যাটা হয় গোনাডাল হরমোন কমে যাওয়ার ফলে। যে মাদকগুলো বাংলাদেশে পাওয়া যায় তাদের প্রায় সবগুলোই নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই যৌন ইচ্ছার উপর মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে। বেশিরভাগ মাদকাসক্ত রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় দীর্ঘদিন মাদক সবনের ফলে তাদের যৌন ইচ্ছা বা ডিজায়ার হারিয়ে গেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, এই সমস্যা পুনরায় পারিবারিক জীবনে ফিরে যেতে বাধা দেয়। নেশা কীভাবে আমাদের যৌনজীবনকে প্রভাবিত করে সেটা তুলে ধরাই আমার আজকের লেখার উদ্দেশ্য। যে ড্রাগসগুলি বেশি চলছে অর্থাৎ রিহ্যাব সেন্টারগুলোতে গেলে যে মাদকের আসক্তি সবচেয়ে বেশি পাওয়া তারা হলো যথাক্রমে ইয়াবা, গাঁজা, ফেন্সিডিল ও মদ। এর মধ্যে মদ আমাদের দেশে বৈধ। মদ খাওয়ার জন্য লাইসেন্স করতে হয়। আরেকটি বৈধ এবং ব্যাপক প্রচলিত নেশা হলো সিগারেটের নেশা। আইনগত এবং সামাজিক উভয় ধরনের বৈধতা থাকার কারণে সিগারেটকে মাদক হিসেবে ধরা হয় না। তবে যৌনজীবনে সিগারেটের প্রভাব বেশি থাকার কারণে এবং ৩১ মে বিশ্ব তামাক ‍মুক্ত দিবস হওয়ার কারণে ইয়াবা একটি ভয়াবহ তীব্র আসক্তিগুণ সম্পন্ন মাদক মেথাম্ফিটামিনের সাথে ক্যাফেইন মিশিয়ে ইয়াবা বানানো হয়। অন্যান্য ব্রেইন উত্তেজক মাদকের মতো এটিও সেবনের সাথে সাথে আনন্দের অনুভূতি তৈরি করে। এর পরপরই সেবনকারী শক্তি এবং এলার্টনেস অনুভব করে। ইয়াবা মানুষ একারণেই খায়। কিন্তু এর জন্য দাম দিতে হয় অনেক। কারণ ইয়াবাতে খুব দ্রুত আসক্তি চলে আসে। মস্তিষ্কের বিকৃতিও হয় বেশি। শুধু মস্তিষ্কের ক্ষতি হয় তা নয়। কিডনি ড্যামেজ হয়ে যায়। হৃৎপিন্ড কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে যাকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বলে। ক্রমে ক্রমে মানষটি মৃত্যুর দিকে চলে যায়। প্রথম দিকে খাওয়ার সাথে সাথে যেখানে শক্তি বেড়ে যেত সেখানে ক্রমাগত ব্যবহারের কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার মতো অবস্থা হয়।

ঠিক যৌনতার ক্ষেত্রেও এরকমটাই দেখা যায়। ইয়াবা মস্তিষ্কের জন্য উত্তেজকধর্মী মাদক হওয়াতে ইয়াবা সেবনে যৌন উত্তেজনা বাড়ে। অনেকে যৌন অনুভূতিকে তীব্রভাবে উপভোগ করার জন্য ইয়াবা গ্রহণ করে। তাই এরকম একটি ধারণা জনমনে প্রচলিত আছে যে ইয়াবা নিলে সেক্স ভালো হয়। ভালো হয় বলতে যৌন ইচ্ছা বাড়াতে, দীর্ঘ সময় ধরে সেক্স করতে এবং চরম পুলকে তীব্র সুখ পেতে ইয়াবা উপযোগী। কিন্তু এসব হওয়ার জন্য মস্তিষ্কের যে নিউরোট্রান্সটিারটা দরকার তা হলো ডোপামিন। দীর্ঘদিন ইয়াবা সেবনে মস্তিষ্কের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ডোপামিন রিসেপ্টরের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে ইয়াবা আর কাজে আসে না। প্রশ্ন উঠতে পারে দীর্ঘদিন না খেলেই তো হয়। শুরুতেই বলেছি ইয়াবাতে আসক্তি দ্রুত আসে ফলে দু-একবার খেয়ে ছেড়ে দেওয়ার উপায় থাকে না। বলা যেতে পারে এটি একটি নেশার ফাঁদ।

ইয়াবার এম্ফিটামিনের মতো গাঁজার কার্যকরী উপাদানটি হল ক্যানাবিনয়েড। ক্যানাবিনয়েড শুক্রানুর নড়াচড়া, উৎপাদন এবং বীর্যে শুক্রানুর পরিমাণ কমিয়ে দেয়। লিউটিনাজিং হরমোন তৈরিতে বাধা দেয়। ফলে টেস্টোস্টেরনের মতো একটি গুরুত্বপর্ণ গোনাডাল হরমোনের উৎপাদনও কমে যায়। যৌন ইচ্ছা বা আগ্রহের সাথে টেস্টটোসটেরন জড়িত। এই হরমোনের ঘাটতির কারণে পরুষের যৌন ইচ্ছা কমে যায়। নারীর ক্ষেত্রে এই ঘটনাই ঘটে ইস্ট্রোজেন হরমোন কমার মধ্যে দিয়ে। এক সময় গাঁজাকেও ইয়াবার মতো যৌন উত্তেজক মনে করা হতো। সেই হিপ্পি আন্দোলনের সময় হিপ্পিরা গাঁজা সেবন করত। তারা যৌন স্বাধীনতা চাইত। ক্যানাবিনয়েড ইরেকটাইল ডিজফাংশনেও ভূমিকা পালন করে। লিঙ্গের উত্থানের জন্য যে রক্ত সংবহনতন্ত্র গুরুত্বপর্ণ তার একটি অংশ হলো ক্যাভারনোশাল সাইনসয়েড। এই ক্যাভারনোশাল সাইনসয়েডের কোষ কলায় ক্যানাবিনয়েড রিসেপ্টর থাকে। এই রিসেপ্টরগুলো গাঁজার ক্যানাবিনয়েডের সাথে যুক্ত হলে লিঙ্গের ভিতরস্থ কোষ কলা শিথিল হয়ে স্ফীত হতে পারে না। টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণে চরম পুলক বা অর্গাজমও কম হয়।
মদের ক্ষেত্রেও সবার ধারণা এটি একটি শক্তিশালী যৌন উত্তেজক। মদের আসরে নর্তকী অথবা নিষিদ্ধ পল্লীতে ঢুলু ঢুলু পায়ে মেয়েদের কাঁধে ভর দিয়ে চলার দৃশ্য বলতে গেলে আমাদের অনেকেরই মানসপটে জায়গা করে আছে। ছায়াছবির এই দৃশ্য আমাদের ভেতরে এমন একটা ধারণা তৈরি করে যে আহামরি কী যেন একটা সম্পর্ক রয়ে গেছে মদে আর মেয়েতে। মদ বা অ্যালকোহল আমাদের যৌন অনুভতিকে দুইভাবে নাড়া দেয়। অল্পমাত্রায় এটি যৌন উত্তেজক। আবার বেশি মাত্রায় যৌন উত্তেজনা ঘোলাটে হয়ে যায়। শুধু তাই নয় লিঙ্গের উত্থানও সন্তোষজনক হয় না।

যৌনতার ওপর স্মোকিং বা ধুমপানের প্রভাব বলে শেষ করতে চাই। যদিও এ ধরনের বিজ্ঞাপন আমাদের মিডিয়াগুলোতে সেভাবে দেখা যায় না। সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে ক্যান্সারের ক্ষত দেখিয়ে বরং একটা চ্যালেঞ্জই ছুঁড়ে দেওয়া হয় উঠতি বয়সিদের প্রতি যারা ঐ বয়সে স্বাস্থ্য সচেতন হওয়াকে অনেকটা অবজ্ঞার চোখে দেখে। ভীরুতা বা কাপুরুষতা বলে মনে করে। অথচ লস এ্যানজেলেসের বলেভার্ডে মার্লবোরো ম্যানের মুখে তুলে দেওয়া হয়েছে ন্যাতানো সিগারেট, পেছনে বড় করে লেখা ইমপোটেন্স। বোঝানো হয়েছে সিগারেটখেলে ধ্বজভঙ্গ হতে হবে। কারণ সিগারেটের নিকোটিন লিঙ্গের গুরুত্বপর্ণ রক্ত সংবহনতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ভালো থাকুন, সন্দর থাকুন। আপনি ও আপনার চারপাশ মাদকমুক্ত রাখুন ।

Previous articleমাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি থাকাটা পুরো চিকিৎসা নয়
Next articleনিউটনের মনস্তত্ত্ব
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here