মনে হয় মুখে জীবাণু লেগে আছে

মনে হয় মুখে জীবাণু লেগে আছে

শিউলির কষ্ট
আকাশ পরিচ্ছন্ন। সকালের আলো চারপাশের গাছগাছালিতে ঝলমল করছে। নরম কচি আলো কার না ভালো লাগে! যারা ঘুম থেকে দেরিতে ওঠে, প্রকৃতির এমন কোমল সৌন্দর্য দেখার সুযোগ তাদের ঘটে না। এখন নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছে শিউলি। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে ও। একটি কাক আকস্মিক উড়ে এসে গ্রিলের ওপর বসেছে।

এত কাছে কাক এসে বসে! ইশ, কী ময়লা!

কা কা ডাক জুড়ে দিয়েছে কাকটা। ব্যালকনিতে রয়েছে কোমরসমান দেয়াল। দেয়ালের ওপর দিয়ে একটি কালো সরু লাইন, এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত- লাইনটি কালো পিঁপড়ের। পিঁপড়ে দল সারিবদ্ধভাবে যাচ্ছে, চলমান একটি কালো রেখা হেঁটে যাচ্ছে যেন। একদল পিঁপড়ে একটি মরা টিকটিকির দেহখন্ড নিপুণ দক্ষতায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে টিকটিকির দেহখন্ডটি। কাকটি আচমকা নড়ে ওঠে। দেয়ালের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া টিকটিকির দেহখন্ডটি ছোঁ মেরে নিয়ে পাখা ঝাপটে উড়াল দেয়। পাখা ঝাপটানোর সঙ্গে সঙ্গে পচা ময়লার গুঁড়া শিউলির মুখে এসে পড়ে। ভয়াবহ চিৎকার দেয় শিউলি। কেউ এ চিৎকার শুনে ভাবতে পারে, ভয়াবহ কোনো বিপদ ঘটেছে। মুহূর্তের মধ্যে শিউলি ছুটে যায় বাথরুমে। মুখ ধোয়।

প্রথমে পানি দিয়ে ধোয়। তারপর সাবান নেয়- লাইফবয় গোল্ড। টিভির বিজ্ঞাপন দেখে লাইফবয় গোল্ড কিনেছে সে। এটি জীবাণু ধ্বংস করে, কেবল ময়লাই দূর করে না। ত্বক উজ্জ্বল করে। জীবাণু ধ্বংসের মাধ্যমে স্বাস্থ্যও সুরক্ষা করে। এই তথ্য তার জানা আছে। আবার লাইফবয় গোল্ড মুখে ঘষে সে। চোখের পাতার ওপর থেকে ওড়না দিয়ে সাবানের ফেনা মুছে নেয়। পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায়। লুকিং গ্লাসে নিজের ফেনামাখা মুখ দেখে। ফেসিয়াল লাগানোর মতো করে সাবান মেখেছে সে। ধোয়ার জন্য উদ্যত হয়ে নিজেকে থামায়। মনে মনে ভাবে– সাবান মাখা অবস্থায় আরেকটু থাকুক। বেশিক্ষণ না থাকলে জীবাণু মারা যাবে না। প্রায় ২০ মিনিট সাবান মুখে বাথরুমে দাঁড়িয়ে রইল শিউলি। এবার মুখ ধোয়। ভালো করে ঘষে ঘষে সাবান তুলে নেয়। নিশ্চয়ই জীবাণু চলে গেছে এবার। লুকিং গ্লাসের পাশে ঝোলানো আছে পরিষ্কার টাওয়াল। টাওয়ালটি হাতে নিয়ে মুখের পানি মুছে নেয়। অনেকক্ষণ টাওয়ালটি মুখে চেপে রাখে। ওহ্! শান্তি!

জীবাণু তাড়িয়ে শান্ত হয় শিউলি। ফিরে আসে বাথরুম থেকে। দরজার চৌকাঠ পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হয়, ‘না, জীবাণু যায়নি। জীবাণুগুলো মুখে লেগে আছে এখনো।’ কথাটা মনে জাগার সঙ্গে সঙ্গে সুরসুর করে আবার বাথরুমে ঢুকে যায় সে। আবার সাবান মাখে, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ফিরে আসতে গিয়েও পারে না। আবার পানি ঢালে মুখে। আবার। বারবার। সময় গড়িয়ে যায়। শিউলি! এই শিউলি! কোথায় তুমি! ডাকতে ডাকতে মা ওর ঘরে ঢোকেন। শিউলি রুমে নেই। বাথরুমের দরজা খোলা। দরজা খোলা রেখে বাথরুমে কী করে সে? ডাকতে ডাকতে মা বাথরুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ান। দ্রুত এসো শিউলি। সবাই ডাইনিং টেবিলে বসা। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। বলেই মা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। মায়ের তাড়া খেয়ে ফিরে আসার জন্য পা বাড়ায়। থমকে যায় আবার। মনে আবার চিন্তা আসছে– ‘এখনো জীবাণু লেগে আছে।’ নাহ্। প্রবোধ দেয় শিউলি। অনেকক্ষণ ধুয়েছে সে। জীবাণু থাকার কথা নয় আর। বারবার ধুয়েছে। নিশ্চিত সে, জীবাণু আর নেই। তবুও মনের ভেতর থেকে চিন্তা জেগে উঠছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কথাটি বারবার মনে ভেসে উঠছে। কথাটি ঠেকাতে চেষ্টা করছে শিউলি, পারছে না। যাতনা হচ্ছে তার। বুঝতে পারছে, কথাটির কোনো ভিত্তি নেই, বাস্তবতা নেই। বুঝতে পারছে পুরোপুরি অযৌক্তিক চিন্তা এটি। তবুও চিন্তাটা আটকাতে পারছে না। এটি বাইরে থেকে মনে ঢোকে না। নিজের মনের ভেতর থেকেই এমন অযৌক্তিক চিন্তা জেগে ওঠে। তবুও এবার নিজেকে দৃঢ় করে। আর মাত্র একবার ধোবে। ব্যস। সত্যি সত্যি পেরেছে সে। একবার ধুয়ে দ্রুত ব্যালকনিতে আসে। বাইরে কচি রোদ আর নেই। দিনের আলো এখন বেশ কড়া হয়ে উঠেছে। পিঁপড়ের দল লাইন ধরে ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। কাকটিও নেই। কাকের দল দূরে গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে। কেবল শিউলির সময় বয়ে গেছে। টের পায়নি সে।

মনে হয় ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ দিই কোলের মেয়েটিকে ছুড়ে ফেলি
সখিনার জবানবন্দি: নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছেন সখিনা বেগম। বয়স প্রায় পঁচিশ। ছোটো একটি ছেলে কোলে। স্বামীও আছেন সঙ্গে। বসে আছেন গ্রিন রোডের এক মনোরোগ চিকিৎসকের সামনে। বাচ্চাটিকে স্বামীর কোলে তুলে দিয়ে সখিনা ইশারায় বললেন, তুমি বাইরে যাও। আমি আলাদাভাবে স্যারের সঙ্গে কথা বলতে চাই। স্বামী বেচারি উঠে গেলেন।

চেম্বারে এখন সখিনা ও মনোরোগ চিকিৎসক।

বলুন। নির্ভয়ে আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে আপনার কষ্টের কথা বলুন।

সখিনা একবার ভেজানো স্লাইডিং ডোরের দিকে তাকান। একবার তাকান দেয়ালের পোস্টারের দিকে। ‘যেকোনো মানসিক সমস্যারই বৈজ্ঞানিক সমাধান রয়েছে।’ ‘অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা, ঝাড়ফুঁক, বৈদ্যালি রোগীর কষ্ট বাড়ায়।’ পোস্টারের ইনফরমেশনগুলো পড়ে নেন সখিনা। পড়ে তাঁর সাহস বাড়ে। ঢোক গিলে বলেন, খুব শরমের কথা স্যার।

কীভাবে বলব? আমার মন পচে গেছে। বাজে হয়ে গেছি আমি। পুরুষ মানুষের দিকে তাকালে চোখ চলে যায় পুরুষের বিশেষ স্থানের দিকে। ছি, কী লজ্জা, স্যার! মনে হয় লোকটির সঙ্গে সেক্স করি। কী ভয়াবহ কথা, স্যার! এমন চিন্তা আমার মনে আসতেই থাকে। চিন্তাটা তাড়াতে চেষ্টা করি। যায় না।

চিকিৎসক একটু সময় নিলেন। কোনো শব্দ উচ্চারণ করলেন না। সখিনা কাঁদছেন। কাঁদতে দিলেন তিনি। থেমে আবার বলছেন, কী পাপ করেছি স্যার! এমন অযৌক্তিক, বাজে চিন্তা কেন আসবে আমার মাথায়। আমার স্বামী খুব ভালো। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো। কোথাও সুখের অভাব নেই। কেবল আমার মন অসুখী। আমি কি মানসিক রোগী হয়ে গেছি, স্যার?

চিন্তাগুলো কি কেউ বাইরে থেকে আপনার মাথায় ঢুকিয়ে দেয়?

না, না স্যার। বাইরে থেকে নয়। নিজের ভেতর থেকে আসে চিন্তাগুলো।

আর কোনো কথা মনে আসে?

জি স্যার। আরো ভয়াবহ কথা মনে আসে। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে মনে হয় ঝাঁপ দিই! আবারও তাঁর মুখে কঠিন যাতনার ছাপ ভেসে ওঠে। সখিনা বলেন, একদিন কোলের মেয়েটিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আকস্মিক মনে হচ্ছিল ছুড়ে ফেলে দিই মেয়েটিকে। তখনই বুকে জড়িয়ে ধরি ওকে। জোরে। মেয়ে চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করে। আমার স্বামী এসে ব্যালকনি থেকে আমাকে উদ্ধার করে। এরপর ব্যালকনিতে তালা দিয়েছি ভেতর থেকে। চাবি আমার কাছে রাখে না আমার স্বামী। ভাবে, আমি সত্যি সত্যি মানসিক রোগী হয়ে গেছি।
আর কিছু বলবেন?

জি স্যার, আরো কথা আছে। বলুন। আমার হাজব্যান্ডের নিজস্ব ব্যবসা আছে। বসা কাজ করে সে। অফিসে এসি রুম। তবুও বাইরে থেকে এলে আমি বেডরুমে ঢোকার আগে তার জামাকাপড় খুলে বাথরুমে পাঠাই। গোসল করে নতুন জামাকাপড় পরে তাকে আমার বেডরুম ঢুকতে হয়। এমন না করলে আমার অশান্তি বাড়ে। দেহে জ্বালাপোড়া বেড়ে যায়। বেডকভার ঘন ঘন ধোয়া লাগে। সে এক বিশ্রী অবস্থা, স্যার! কী করব?

মনোবিশ্লেষণ
শিউলি ও সখিনার কষ্টকর জীবনযাপন আমরা দেখেছি। ওরা শুচিবাই বা অবসেশন রোগে ভুগছে। এই রোগের পুরো নাম, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার। রোগটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অবসেশনাল থট (চিন্তা) এবং কম্পালসিভ বিহেভিয়ার। বিভিন্ন মাত্রার অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন ও ডিপারসোনালাইজেশন মূল বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। এবার অবসেশনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমরা বোঝার চেষ্টা করব। শিউলির কথা ভাবা যাক। মুখে ময়লা লেগেছে তার। মুখ ধুয়েছে। সাবান দিয়ে বারবার ধুয়েছে তবুও মনে চিন্তা আসে, না ধোয়া হয়নি। জীবাণু লেগে আছে। বারবার স্থায়ী একটি চিন্তা নিজের মনে ঢুকে যাচ্ছে। চিন্তাগুলো তাড়াতে চেষ্টা করছে। না, ঠেকাতে পারছে না। কষ্ট বাড়ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবে চলতে থাকে। ‘ময়লা লেগে আছে’ চিন্তাটি মনে বারবার আসতেই থাকে। একই ঘটনা ঘটেছে সখিনার ক্ষেত্রে। বারবার চোখ চলে যায় পুরুষের বিশেষ গোপন স্থানের দিকে। বারবার সেক্স করার চিন্তা আসে। উভয়ে বুঝতে পারে- চিন্তাগুলো অর্থহীন, বাজে, অযৌক্তিক। উভয়েই বোঝে, চিন্তাগুলো বাইরে থেকে কেউ মনের ভেতর ঢুকিয়ে দেয় না, নিজের মনে জেগে ওঠে। উভয়ে চিন্তাগুলো বাধা দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করে।

এগুলো হচ্ছে অবসেশন। দীর্ঘদিন এমন যাতনা চলতে থাকলে রোগীর প্রতিরোধ করার (Resist) ক্ষমতা কমে যায়। এতে ডায়াগনোসিসে কোনো অসুবিধে হয় না। কারণ তত দিনে উপসর্গগুলো শেকড় গেড়ে বসে, প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অনেক সময় অবসেশন এত বেশি তীব্র থাকে যে, এগুলো যে ভুল চিন্তা, সেটি বোঝার ক্ষমতা কমে আসে। উপসর্গের তীব্রতা কমে এলে বুঝতে পারে বিষয়টি একেবারেই অযৌক্তিক ছিল। এজন্য অবসেশনকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে- ব্যক্তির প্রাণান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও অর্থহীন স্থায়ী ধারণা, চিন্তা, প্রতিচ্ছবি বা তাড়না বারবার মনের মধ্যে ঢুকে যাওয়াকে অবসেশন বলে। রোগী বুঝতে পারে- যে ধারণা, চিন্তা, প্রতিচ্ছবি বা তাড়না নিজের মনে জেগে ওঠে সেগুলো অর্থহীন। অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারে প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অবসেশন। সিজোফ্রেনিয়া নামক বড়ো ধরনের মানসিক রোগেও দেখা যেতে পারে এই অবসেশন ।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি

করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

 

Previous articleবিষণ্ণতা কমতে পারে যেসব কাজে
Next articleখুঁতখুঁতে স্বভাব খারাপ কিছু নয়
প্রাক্তন পরিচালক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here