যেকোন প্রিয় ব্যক্তি বা বস্তু হারানোর পর শোক একটি স্বাভাবিক আবেগীয় প্রতিক্রিয়া। তবে কিছু কিছু সময় এই হারানোর ব্যথা বেশ প্রবল আকার ধারণ করে। এই সময়ে বিরাট মানসিক ধাক্কা থেকে শুরু করে ক্রোধ, অবিশ্বাস, অনুশোচনা, গভীর বিষণ্ণতা ইত্যাদি নানারকম অনুভূতি আমাদের মনে আসতে পারে। শোকের প্রভাব আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্য, ঘুম, খাওয়া, এমনকি স্বাভাবিক চিন্তা করার উপরেও পড়তে পারে। এগুলো সবই আমাদের প্রিয় ব্যক্তি বা বস্তু হারানোর পরের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া – এবং সেই প্রিয় ব্যক্তি বা বস্তু আমাদের জীবনে যত বেশী তাৎপর্যপূর্ণ আমাদের শোকের পরিমাণও ততই বেশী।
আপনি যে ব্যক্তিকে অনেক বেশী ভালোবাসতেন তাকে হারানোর পর অথবা প্রিয় বস্তুটি হারানোর পর মানিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা সাধারণত আপন কাউকে হারানোর পর যে আবেগীয় প্রতিক্রিয়া হয় সেটিকেই শোক বলে মনে করি, তবে শোক অন্যান্য পরিস্থিতিতেও হতে পারে। যেমনঃ
১। বিবাহ বিচ্ছেদ বা প্রেমের সম্পর্কে ভাঙন
২। চাকরিচ্যুতি
৩। পোষা প্রাণীর মৃত্যু
৪। গর্ভপাত
৫। বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন না হওয়া
৬। আর্থিক ক্ষতি
৭। বন্ধুত্বের ভাঙন
৮। অবসর গ্রহণ
৯। বহুদিনের ব্যবহৃত কোন বস্তু হারানো বা নষ্ট হওয়া
১০।প্রিয় ব্যক্তির অসুস্থ হয়ে যাওয়া
এমনকি জীবনধারার ছোট ছোট পরিবর্তনও শোকের অনুভূতি তৈরী করতে পারে, যেমন – বাসা পরিবর্তন, শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি, কর্মক্ষেত্রের পরিবর্তন ইত্যাদি।
আপনার শোক যে কারণেই হোক না কেনো সেটা আপনিই অনুভব করছেন এবং কারণটাও আপনার ব্যক্তিগত, সুতরাং এটি নিয়ে কোন লজ্জাবোধ করবেন না অথবা ভাববেন না যে শুধু নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে শোক প্রকাশ করা যায়, বাকী বিষয়গুলোতে শোক প্রকাশ করা যথাযথ নয়। তবে শোক প্রকাশ করার ও মানিয়ে চলার অবশ্যই কিছু উত্তম উপায় রয়েছে যেগুলো আপনার দুঃখ কমাতে সাহায্য করবে এবং জীবনকে আরও অর্থপূর্ণভাবে দেখতে সহায়তা করবে।
যখন আপনি শোকাহত
শোক একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং এর কোন নির্দিষ্ট ভুল-সঠিক উপায় নেই। আপনি কীভাবে বা ঠিক কতটা শোক অনুভব করবেন তা নির্ভর করে আপনার ব্যক্তিত্ব, মানিয়ে নেয়ার পদ্ধতি, আপনার পুর্ব অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস এবং ক্ষতিটা আপনার নিকট কতটুকু তাৎপর্যপূর্ণ তার উপর। অবধারিতরূপেই শোক থেকে সরে আসতে সময় লাগে এবং এর নিরাময় প্রক্রিয়াটি বেশ ধীরগতির – এখানে জোরজবরদস্তি করে দ্রুত করা সম্ভব নয়। শোক প্রকাশের কোন নির্দিষ্ট সময়সূচী ও নেই। কিছু মানুষ হয়তো কয়েক সপ্তাহের মাঝেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে আবার কারো কারো হয়তো কয়েক মাস বা বছর ও প্রয়োজন হতে পারে।
যেভাবে মোকাবেলা করবেন
১। আপনার কষ্ট হচ্ছে সেটি স্বীকার করে নিন।
২। শোকের প্রভাবে বিভিন্ন অযাচিত আবেগীয় অনুভূতির সৃষ্টি হতে পারে এটি মেনে নিন।
৩। বুঝতে চেষ্টা করুন যে আপনার শোকের অনুভূতি একান্তই আপনার অনন্য অনুভূতি।
৪। যারা আপনার প্রতি যত্মবান বলে আপনি মনে করেন তাদের সাথে সরাসরি কথা বলুন।
৫। শোক এবং বিষণ্ণতার মাঝে পার্থক্য বুঝতে শিখুন।
শোকের পর্যায়সমূহ
সাইকিয়াট্রিস্ট এলিজাবেথ কব্লার-রস ১৯৬৯ সালে পাঁচ-পর্যায়ের শোকের প্রস্তাব করেন। স্তরগুলো হলো –
১। অস্বীকার করাঃ “এটি আমার সাথে ঘটেনি।”
২। রাগ করাঃ “এটি আমার সাথে কেনো ঘটছে? এর জন্য কাকে দোষ দেবো?”
৩। মধ্যস্থতা করাঃ “এটি যদি আমার সাথে ঘটা বন্ধ করে দিতে পারো, তার বিনিময়ে আমি…।”
৪। বিষণ্ণতাঃ “আমার মন প্রচণ্ড বিষণ্ন, আমি কোন কাজ করার মতো অবস্থায় নেই।”
৫। স্বীকার করে নেয়াঃ “যা ঘটে গেছে তা নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই।”
আপনি যদি এখন কোন হারানোর ঘটনার পর এই অনুভূতিগুলো অনুভব করেন, তাহলে বুঝতে পারবেন আপনি কোন স্তরে রয়েছেন। তবে সবাই যে স্তরগুলোর সবক’টিই ধারাবাহিকভাবে পার করবেন তেমন নয় আবার প্রত্যেকটি স্তরই যে সবাই অনুভব করবেন তেমনটি ও নয়। প্রিয় ব্যক্তি বা বস্তু হারানোর প্রতিক্রিয়া কখনোই সাধারণ প্রতিক্রিয়া নয় তাই একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমওয়ার্কে সবার শোকের অনুভূতিকেও বেঁধে রাখার চেষ্টা করা উচিৎ নয়।
শোকের লক্ষণসমূহ
শোক ভিন্ন ভিন্ন মানুষের উপর ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলে, তবে আমরা বেশীরভাগ মানুষই শোকের সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অনুভব করে থাকি।
আবেগীয় লক্ষণসমূহ
মানসিক ধাক্কা এবং অবিশ্বাসঃ প্রিয়জন বা প্রিয় বস্তু হারানোর ঠিক পরমূহুর্তেই যা ঘটে গেছে সেটি মেনে নেয়া কঠিন। আপনার মধ্যে এক ধরণের অসাড় অনুভূতি হতে পারে এবং যা ঘটে গেছে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হতে পারে, এমনকি আপনি সত্যিকে অস্বীকারও করতে পারেন। যেমন – হয়তো আপনি কোন মৃত ব্যক্তি বা পোষা প্রাণীকে পুণরায় দেখার প্রত্যাশা করতে পারেন।
বিষণ্ণতাঃ গভীর বিষণ্ণতা শোকের সর্বজনীন লক্ষণ। আপনি হয়তো শূন্যতা, হতাশা, আকুলতা বা গভীর একাকীত্ব ইত্যাদি অনুভব করতে পারেন। এছাড়াও আপনি কান্না করতে পারেন বা মানসিকভাবে অস্থিতিশীল অনুভব করতে পারেন।
অপরাধবোধঃ আপনার মধ্যে কোন একটি কাজ কেনো করেছিলেন বা কেনো করেননি এই বিষয়ক অপরাধবোধ কাজ করতে পারে। আপনার ক্ষতি প্রতিরোধ করার জন্য কেনো আপনি আরো বেশী চেষ্টা করেননি এই বিষয়ে অপরাধবোধ কাজ করতে পারে।
রাগঃ ক্ষতির পেছনে কারো দোষ না থাকা সত্ত্বেও আপনার মনে রাগ এবং বিরক্তি কাজ করতে পারে। আপনি হয়তো নিজের উপর রাগান্বিত বোধ করতে পারেন কিংবা সৃষ্টিকর্তা, চিকিৎসক, এমনকি যিনি মারা গিয়েছেন তার উপরেও আপনার রাগ হতে পারে।
শারীরিক লক্ষণসমূহ
১। ক্লান্তি
২। মাথা ঘোরানো
৩। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া
৪। ঘুম না হওয়া
কোথায় সাহায্যে নেবেন?
১। পরিবারের আপনজন বা বন্ধুদের নিকট সাহায্যে খুঁজুন।
২। শোকাহত ব্যক্তিকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে অনেকেই অস্বস্তিবোধ করতে পারে – এটুকু মেনে নিন।
৩। নিজ নিজ ধর্ম/বিশ্বাস থেকে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করুন।
৪। প্রয়োজনে কোন সাপোর্ট গ্রুপে যোগদান করুন।
৫। মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর শরণাপন্ন হোন।
লিখেছেনঃ মেহেদী হাসান আসিফ,
সাইকোলজিস্ট, টেলিসাইকিয়াট্রি রিসার্চ এন্ড ইনোভেশন নেটওয়ার্ক লিমিটেড।
করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে