প্রবীণদের শিশুতোষ রাগ সামলানোর কৌশল

প্রবীণদের শিশুতোষ রাগ সামলানোর কৌশল

জন্মিলে মরিতে হয় ঠিক তেমনি বেঁচে থাকলে ধীরে ধীরে বার্ধক্যে বা প্রবীণদের কাতারে উপনীত হতে হয়। বার্ধক্যের সঙ্গে যোগ হয়ে যায় অনেক অনেক হারানো স্মৃতি, নানান রোগ, প্রিয়জন হারানোর বেদনা। কখনো কখনো যোগ হয় অর্থনৈতিক ও শারীরিক পরাধীনতা। আর কমে যায় শক্তি, ক্ষমতা।

তাই কারো কারো পক্ষে এই শাশ্বত সত্যটিকে মেনে নিতে কিংবা এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয় অবর্ণনীয় কষ্ট। সঙ্গে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়ে, উপার্জনে অক্ষম হওয়ার ভয় কিংবা মৃত্যু ভয় অনেক প্রবীণদের মনোবল ভেঙে দেয়। তৈরি হয় হতাশা। আর এই হতাশার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অনেক প্রবীণ শিশুসূলভ রাগ প্রকাশ করেন, কারো বোধগম্য হয় না।

মনে হয়, এ বুড়ো অহেতুক এবং অযৌক্তিক। আর এ কারণে আমরা যারা তাদের যতেœর দায়িত্বে থাকি তাদের কাছে এই রাগ খুবই বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় এই শিশুতোষ রাগ সামলাতে না পেরে নিজেরাই ভীষণ চাপের মধ্যে থাকি, হতাশ হয়ে পড়ি।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা উল্টো চরম রাগ প্রকাশ করতে থাকি বার্ধক্যে উপনীত হওয়া আমাদের এই আপনজনদের সঙ্গে। যা তাদের সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি আমরাও অপরাধবোধে ভুগি কিংবা অনুতপ্ত হই। তাতে সমাধান তো কিছু হয়ই না বরং এ যেন একটা চক্রের মতো সংসারে শান্তি নষ্ট করে দেয়।

এক সময় কারো কারো জন্য এই জন্মদাতা, জন্মদাত্রী, মা-বাবা বা লালন পালনকারী দাদা-দাদীকেই মনে হয় চরম বোঝা। এভাবে ভাবার আগে আসুন আমরা আলোকপাত করি এই দিকে যে, প্রতিটি সমস্যারই কোনো না কোনো সমাধান আছে। আর এই সমাধান লুকিয়ে থাকে সমস্যার কারণের মধ্যে।

সেই কারণগুলো বুঝে আমরা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ প্রিয়জন প্রবীণদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি এবং আমাদের মধ্যে জমে ওঠা মানসিক চাপ ও হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। কারণ যারা এই প্রবীণদের সেবা দান করেন তারাই সবচেয়ে বেশি এই রাগের শিকার হন। তাই সামলানোর দায়িত্বও তাদের ওপরই বর্তায়।

নিম্নে প্রবীণদের শিশুতোষ রাগ কীভাবে সামলাবেন তা নিয়ে আলোকপাত করা হলো:

প্রবীণদের রাগ সামলাতে গিয়ে সবার আগে ভাববেন যে, তিনি আপনাকে ছোটো বা অপমান করার জন্য কিছু করেননি বা আপনার ওপর রাগ করছেন না। তিনি কোনো সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন বিধায় তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে রাগ প্রকাশিত হচ্ছে। কিছু কিছু রোগ যেমন- আলঝাইমার, ডিমেনশিয়া কিংবা হরমোনের ভারসাম্যতার অভাবের কারণে বৃদ্ধ বয়সে রাগ বেড়ে যেতে পারে।

ডিমেনশিয়াতে ব্যক্তি অনেক গুরুত্বপর্ণ জিনিস ভুলে যেতে থাকেন, যার ফলে তারা অনেক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারেন। এছাড়া এসময় বার্ধক্যজনিত কারণে অনেকের অনেক ওষধু খেতে হয়। কোনো কোনো ওষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে রাগ বেড়ে গিয়ে অহেতুক রাগ দেখাতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে কারণ বুঝে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

বার্ধক্যের সঙ্গে সঙ্গে অনেকে বন্ধু হারান, পরিবারে গুরুত্ব হারাচ্ছেন বলে মনে করেন। শারীরিক-মানসিক কিংবা অর্থনৈতিকভাবে পরিবারে সাহায্য করতে পারছেন না মনে করে নিজেরাই হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকেন। উপরন্তু পারিবারিক ব্যস্ততায় হয়ত দেখা যাচ্ছে, প্রধান ব্যক্তিটির প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আগের মতো তার সঙ্গে বসে আলোচনা করা, গল্প করা, সিদ্ধান্ত নেয়া এই কাজগুলো করা হচ্ছে না।

যে কারণে প্রবীণ ব্যক্তিটি একাকিত্ব ও গুরুত্বহীনতায়ও ভুগতে পারেন। তার ওপর তার সঙ্গে বিরক্ত হয়ে বা জোরে কথার বললে সমস্যা আরো বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে ঠান্ডা মাথায়, নরম গলায় তাদের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন।

পারিবারিক আলোচনা ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে প্রবীণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাদের সময় দেয়া প্রয়োজন। অনেক সময় প্রবীণরা নিজেদের ভুল আচরণগুলো অনুধাবন করতে পারেন না। তাই তার রাগের প্রেক্ষিতে উল্টো রাগ না দেখিয়ে শান্ত থাকা। পরবর্তীতে তার রাগের কারণে আপনি কষ্ট পেয়েছেন সেটা ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলা। তার রাগের কারণে জানতে চাওয়া এবং তার অনভূতিকে সম্মান দেখানো এবং বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন।

অনেকসময় প্রচণ্ড হতাশায় ভূগলে প্রবীণরা সবকিছু নেতিবাচকভাবে দেখেন এবং সে কারণেই ছোটোখাটো বিষয়ে রাগ দেখান। অনেক ভালো কিছু করার পরও, অনেক যত্ন করার পরও সন্তুষ্ট হন না। এ সময় যারা যত্ন করেন তাদের বিরক্ত লাগা স্বাভাবিক।

কিন্তু যদি হতাশায় ভোগা প্রবীণ ব্যক্তিটির কথা চিন্তা করেন, ভালো কিছু দেখতে পারছেন না বলেই তিনি এই যত্নগুলো উপভোগ করতে পারছেন না। আর এজন্যই তার জীবন থেকে আনন্দ, সুখ, শান্তি বিষয়গুলো চলে গেছে। এই নেতিবাচক চিন্তাগুলো তার ইচ্ছাকৃত নয় বরং সমস্যা বা রোগেরই লক্ষণ।

তাই এই সময় তার ওপর বিরক্ত না হয়ে এবং নিজের ওপর ব্যক্তিগতভাবে বিষয়গুলোকে না নিয়ে বরং ঐ সময় তার ভুল ধারণাগুলোকে ভাঙিয়ে দিন। তার সঙ্গে বসে আলোচনা করুন। রেগে গেলে তার কী কী ক্ষতি হয়, আপনারা কীভাবে কষ্ট পান এই অনুভূতিগুলো বলুন। তাতে কাজ না হলে প্রফেশনাল কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করাতে পারেন। অবস্থা বেশি জটিল হলে মনোরোগ বিশেজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

অনেক সময় প্রবীণদের মধ্যে সন্দেহ প্রবণতার কারণেও রাগ প্রকাশ করতে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে সন্দেহের কারণ সঠিক কিনা যাচাই করুন। যদি অকারণে সন্দেহ হয় তবে সেটা আলঝাইমার ডিজিজ বা মানসিক রোগের জন্য হতে পারে। সেজন্য অবশ্যই মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।

কারণ শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি বয়স্কদের মানসিক পরিবর্তনও হয়ে থাকে। শারীরিক প্রয়োজনে আমরা ওষুধ ও ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। সতরাং মানসিক প্রয়োজনকে অবহেলা করা প্রবীণ ব্যক্তিটির মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা করার নামান্তর মাত্র। কারণ রাগ, দুঃখ, হতাশা এগুলো যেমন স্বাভাবিক আবেগ, ঠিক তেমনি এগুলোর অস্বাভাবিক ও অহেতুক প্রকাশ মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার লক্ষণ।

তাই অবহেলা নয়, ব্যক্তিকে দোষারোপ নয়, প্রবীণদের শিশুতোষ রাগ সামলাতে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন। তাদের রাগের প্রকাশকে ব্যক্তিগত ভাবে না নিয়ে কারণ অনুসন্ধান করুন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।

সর্বোপুরি সকল প্রবীণরাই চান পরিবারের কাছ থেকে সম্মান, গুরুত্ব আর ভালোবাসা। সেটা সঠিকভাবে প্রকাশ করছেন কিনা সে বিষয়ে সচেতন হোন।

পরিশেষে বলব, যিনি বা যারা প্রবীণদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের জন্য আসলেই সেটা চাপমূলক মনে হলে আগে নিজের চাপ মোকাবেলার ব্যবস্থা নিন। অবশ্যই আপনার নিজের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য যা যা প্রয়োজন করুন।

সংসারের দৈনন্দিন কাজের বাইরে নিজের জন্য সময় বের করুন। আপনি যখন সুস্থ থাকবেন, সঠিকভাবে অন্যকেও ভালো রাখতে পারবেন। আপনার সুস্থতার ফলে আপনার মধ্যকার ইতিবাচকতা দিয়ে আপনি আপনার আপনজন প্রবীণ ব্যক্তিটির নেতিবাচক শিশুতোষ রাগ সামলাতে সক্ষম হবেন।

 

সেলিনা ফাতেমা বিনতে শহিদ

সহকারী অধ্যাপক (ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি)

মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

Previous articleডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বিএমআরসির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত
Next articleঅনিদ্রা ও মানসিক অস্থিরতায় ভুগছি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here