প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা ও একটি প্রশ্ন!

শিক্ষার অনেক গুলো কাজের মধ্যে অন্যতম একটি হলো, মানুষের মানবিক গুণগুলোর বিকাশে সহায়তা করা এবং মানুষকে মানবিক করে তোলা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা বা পদ্ধতি কি আসলেই আমাদের মানবিক গুণাবলি বিকাশে সাহায্য করছে?  করলেও কতটুকু?

বাংলাদেশে বতর্মানে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা একজন মানব শিশুকে কতটুকু মানবিক করে তুলছে  বা মানবিক গুণাবলি বিকাশে সহায়তা করছে? সে বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়ার আগে ভারতের বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ড. এইচ আর নগেন্দ্রের বলা একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। গল্পটি তিনি বলেছিলেন  মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সিলিং ও সাইকোথেরাপির উপর এক আর্ন্তজাতিক সম্মেলনে। গল্পটি এরকম- একজন ধনী লোকের চারজন স্ত্রী। তিনি চতুর্থ স্ত্রীকে সব থেকে ভালোবাসতেন এবং পৃথিবীর সব থেকে ভালো এবং মূল্যবান জিনিসপত্র দিয়ে ভরিয়ে রাখতেন। সংসারে তাকে কোনো কাজ করতে দিতেন না। তৃতীয় স্ত্রীকেও তিনি বেশ ভালোবাসতেন। তাকে তিনি তার সব সম্পত্তি এবং বাড়ি ঘরের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রীও কিছুটা ভালোবাসা পেতেন। তিনি তার ব্যবসার কাজে সহায্য করতেন। প্রথম স্ত্রীকে ভদ্রলোক বিন্দুমাত্র ভালোবাসতেন না এবং তার কোনো যত্ন বা খোঁজ খবর রাখতেন না।

Shikkha_Babostha

একদিন ভদ্রলোক খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং ডাক্তার তার সব কিছু পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে তাকে জানালেন যে, তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না। এতে ভদ্রলোক খুব বিচলিত হয়ে পড়লেন এবং বাড়িতে ফিরে চতুর্থ স্ত্রীকে তার এই দুঃসংবাদ দিলেন। সেই সঙ্গে তিনি তার একটি ইচ্ছের কথা জানালেন যে, সে তার সাথে মৃত্যুর সময় সঙ্গী হবেন কি না। একথা শুনে তার প্রাণপ্রিয় চতুর্থ স্ত্রী এক বাক্যে না করে দিলেন। একই ভাবে তৃতীয় এবং দ্বিতীয় স্ত্রীও একই কথা বললেন। তারা জানালেন যে, প্রশ্নই আসে না স্বামীর মৃত্যুর পর তার সঙ্গে সহমরণে যাবার। ভদ্রলোক আরো ভেঙে পড়লেন।

লোকটি তার স্ত্রীদের কথা শুনে খুব বিমর্ষ বোধ করতে লাগলেন। ঠিক এই সময় তিনি আরো একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। কেউ তার খুব কাছে এসে বলছে ‘তোমার কোনো চিন্তা নেই, আমি তোমার সাথে যাবো’। ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন এ তার প্রথম স্ত্রী। যাকে তিনি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। যত্ন আর ভালোবাসার অভাবে সেই মানুষটির কঙ্কালসার অবস্থা। কেবল সেই মানুষ অনেক ভালোবাসা নিয়ে ভদ্রলোকের মরণসঙ্গী হতে রাজি আছেন।

লোকটির প্রথম স্ত্রীকে মানুষের মনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যে মনের বিশেষ কোনো যত্ন বা পরিচর্যা করি না। চতুর্থ স্ত্রীকে তুলনা করা হয়েছে মানুষের শরীরের সঙ্গে, যেটার যত্ন নিতে আমরা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকি। তৃতীয় এবং দ্বিতীয় স্ত্রীকে তুলনা করা হয়েছে ভদ্রলোকের সম্পত্তি ও ব্যবসার সঙ্গে, যেসব জিনিস আমাদের সময় এবং মনোযোগ কেড়ে নেয়। অথচ মানব জীবনে যে বিষয়টির গুরুত্ব সব থেকে বেশি, সেই মনের যত্ন আমরা করি না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই অবহেলা করি।

এখন অনেকের মনে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে যে ড. নগেন্দ্রের গল্পের সঙ্গে আমার এই লেখার সম্পর্ক কোথায়?

আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকানোর আগে কতগুলো বিষয় সামনে চলে আসে। বিশেষ করে শিক্ষা বিষয়ে সমাজের তথা অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের বিভিন্ন পদক্ষেপ সমূহের প্রতি তাকালে আমরা কি দেখি? সমাজ বা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কোন বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিচ্ছেন বেশি?

একটু খেয়াল করলেই দেখবো- সরকারের চাই শতভাগ পাশ, আর অভিভাবক দৌড়াচ্ছেন জিপিও ৫ কিংবা গোল্ডেন জিপিএ’র পেছনে। অভিভাবকরা যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন তাদের সন্তানদের তথাকথিত ভালো রেজাল্টের পেছনে। গোল্ডেন এ প্লাস ছাড়া যেন সমাজে মুখ দেখানোই দায়। অথচ শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে মানবিক হতে সাহায্য করা। কি সমাজে, কি রাষ্ট্রে কিংবা পরিবারে মানবিকতার প্রসার ঘটানো। আদতে তা ঘটছে না। তাহলে কি আমার বলতে পারি গোল্ডেন জিপিএ প্রাপ্তির যে দৌড় তা মূলত ভদ্রলোকের চতুর্থ স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, যা বিপদের দিনে খুব একটা কাজে আসে না। আর শতভাগ পাশ কিংবা রাজনৈতিক সাফল্যকে ভদ্রলোকের তৃতীয় ও দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তুলনা করা চলে। আর যেটি শিক্ষার প্রাণ সেই মানবিকতা গল্পের প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তুলনীয়। যাকে আমরা সবথেকে অবহেলা করছি বা গুরুত্ব দিচ্ছি না। অথচ এর গুরুত্ব পাবার কথা সব চেয়ে বেশি।

সমাজের সব স্তরে অস্থিরতা, অবিশ্বাস এবং দ্বন্দ্বের পেছনে আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাও কম বেশি দায়ী। মানবিক চেতনা সমৃদ্ধ সমাজ তৈরির সময় এখনই। এখনই সময় শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিক মানুষ তৈরির দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। তা না হলে সমাজে এই অস্থিরতা ও অরাজকতা চলতেই থাকবে।

লেখক: প্রধান, শিক্ষা কর্মসূচি, স্পৃহা বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন
এবং সংস্কৃতি কর্মী।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Previous articleবৈষম্যপূর্ণ বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য অচিকিৎসায় বা অপচিকিৎসায় গরীবদের মানসিক রোগ
Next articleহাবিপ্রবি’তে শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here