তোমাকে পেয়ে আমরা ধন্য

0
55
তোমাকে পেয়ে আমরা ধন্য- এ কথাটি বলি শিশুর জন্য?

‘বাচ্চা কথা শুনতে চায় না’,‘বাচ্চা অনেক বেশি দুষ্টু’ বা ‘বাচ্চা প্রচণ্ড জেদি’ -এসব অভিযোগ প্রায়ই বাবা-মা করেন।
এর মূলে আসলে কি থাকে, আমরা একটু জানার চেষ্টা করি।
এক শিশু। নাম রনি। বয়স চার বছর। এখনো স্কুলগামী হয়নি। যখন যা দেখে তাতেই প্রচণ্ড উৎসাহী হয়। রনি রান্নাঘরে তার মায়ের সাথে খুঁটিনাটি জিনিসপত্র নিয়ে টানাটানি করছে। মা তার এই আচরণে বিরক্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে বাবা অফিস যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছেন। রনির বড় বোন নীলা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। যথারীতি সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে কখন মা তাকে তৈরি করে স্কুলে নিয়ে যাবে। এদিকে রনির এই আচরণে তার দাদিও বিরক্ত হছেন।

এ অবস্থায় রনির মা কী করতে পারেন? রনিকে বকাঝকা করতে পারেন,অথবা তাকে ঐ জিনিসটি দিতে পারেন, যা সে চাচ্ছে, অন্যদিকে পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর রাগও হতে পারেন।

সবকিছুই শান্ত অবস্থায় মেটানো যেতে পারে। প্রথমেই বলা যেতে পারে-পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে সহায়তা করা। পরিবারের কোনো কাজ কোনো সদস্যের একার দায়িত্ব নয়। পরিবারের প্রতিটি সদস্যেরই কিছু না কিছু দায়িত্ব রয়েছে। সকলেই তার নিজ দায়িত্ব যখন পালন করবেন, পাশাপাশি সহায়তা করবেন অন্যের সমস্যার সময়।

এইবার আসা যাক সন্তান কখন অবাধ্য হয়?

সংক্ষিপ্ত করে বললে, কথাটি এমন দাঁড়ায়-সন্তান তার নিজের মতো করে কিছু না পেলে অবাধ্য হয়।

এর মানে কি সন্তানের সব চাওয়া পূরণ করতে হবে?

প্রথমেই আমরা একটু জানার চেষ্টা করি সন্তানের চাওয়া কী ধরনের হতে পারে? শিশুরা খুব বেশি কিছু তার পরিবার থেকে অর্থাৎ মা-বাবার কাছে চায় না। তার ছোটো ছোটো চাওয়ার মধ্যে রয়েছে খেলার স্বাধীনতা,খেলার জায়গা এবং সবচেয়ে বেশি চায় তার মা-বাবা বেশির ভাগ তাকেই সময় দিবে। এ ছাড়াও আর অনেক কিছু তারা মা-বাবার কাছে আবদার করে থাকে।

এইবার জানা যাক সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার চাওয়া কতটুকু এবং তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত

মা-বাবার চাওয়াটি একটু ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে । মা-বাবা তাদের ছেলেবেলায় যা পূরণ করতে পারেন নি ঠিক সেই স্বপ্নগুলো সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করতে চান। অনেক সময় দেখা যায় মা-বাবা প্রয়োজনের তুলনায় সন্তানের কাছে খুব বেশি আশা করে থাকেন। যখন সন্তান তা পূরণ করতে অক্ষম হয় তখনই শুরু হয় মনো মালিন্য এবং এক সময় তা খুব বড় আকার ধারণ করে।

কিছু কিছু সময় আমরা ভুলেই যাই সন্তান আমাদের একটি অংশ হতে পারে কিন্তু আলাদা একটি সত্তা,যার নিজস্ব কিছু চিন্তা আছে এবং তা অনুযায়ী নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি আছে। আমাদেরকে বুঝতে হবে সন্তান কখন এবং কেন অবাধ্য হয়। আমরা একটু পেছনের কথা ভাবি। যখন আমরা ছোটো ছিলাম তখন আমরা কখন কি করতাম?আমাদের শৈশব কেমন ছিল? আমি কখন আনন্দ পেতাম?আমার কখন খুব রাগ হত?আমার কেন রাগ হত? ইত্যাদি…।

পুরো জীবনকে যদি আমরা একটু ভালভাবে লক্ষ্য করি তবে কয়েকটি অংশ দেখতে পাই। প্রত্যেকটি অংশ শিশুদের কাছে নতুন। একটি সময় থেকে অন্য আরেকটি সময়ে প্রস্থান করা তাদের জন্য গ্রহণ করা খুব সহজ ব্যপার নয়। কিছু কিছু সময় শিশুদের শারীরিক পরিবর্তনগুলো এতো দ্রুত হয় যে তারা নিজেদের উপর অনেক বেশি বিরক্ত থাকে এবং মানিয়ে নেয়ার চেষ্টায় থাকে ,অন্যদিকে নজর দেয়ার সময় থাকেনা।

এইবার জেনে নেয়া যাক পিতা-মাতার করণীয় বিষয়ে

• পিতা-মাতা সর্বপ্রথম সন্তানের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা যেন সন্তানের ভাল লাগা মন্দ লাগা সম্পরকে বুঝতে পারা যায়।
• সন্তানকে তার পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং এর নিয়ম-কানুন সম্পর্কে ধারণা দেয়া।
• নতুন কিছু শেখার প্রতি আগ্রহের পরিবেশ তৈরি করা যেন শিশুটি তা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে। এবং প্রত্যেকটি জিনিসেরর ভাল-মন্দ সম্পর্কে ধারণা দেয়া।
• কোনো সিদ্ধান্ত শিশুর উপর চাপিয়ে না দিয়ে তাকে বুঝিয়ে বলা যেন সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাতে অংশ নেয়।
• অপর সন্তানের সাথে তুলনা না করে উভয়ের প্রশংসা করা।
• দুজন সন্তানের মধ্যে দু’জনকেই সমানভাবে সময় দেয়া ও মূল্যায়ন করা।
• শিশু অন্যায় করলে তাকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শাস্তি না দেয়া।

সন্তানের সব আবদার পূরণ নয়
মা-বাবাকেই বুঝতে হবে সন্তানের কোন আবদার তার জন্য সুফল বয়ে আনবে আর কোনটি নয়। সন্তান অনেক কিছু চাইতেই পারে কিন্তু তার ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব মা-বাবার। সুতরাং,মা-বাবাকেই নির্বাচন করতে হবে তার সন্তানের জন্য কোনটি ঠিক হতে পারে।

সন্তানকে বুঝা
সহজ করে বললে, শিশুকে যখন কোন নিয়মের মধ্যে আনতে চাইছেন কিন্তু সে তা মেনে নিতে চাইছে না তখন তার ছোটো ছোটো বিষয়গুলো মূল্যায়ন করা। এতে করে শিশু উৎসাহিত হয়। আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং তাতে গুরুত্ব দিবে। মনে রাখা ভাল,একজন শিশু কাঁদামাটির মতো তাকে যে ছাঁচে ফেলা যাবে তারই রুপ ধারণ করবে কিন্তু তাকে সেই পরিবেশটি তৈরি করে দিতে হবে।
একজন শিশুর জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন তাকে বুঝতে পারা, অন্যায়ের পর শুধু শাস্তি না দিয়ে এর পেছনের কারণ খুজে বের করে তার সমাধানের চেষ্টা করা।
তোমাকে পেয়ে আমরা ধন্য
সবশেষে বলা যেতে পারে,কখনো শিশুকে বুঝাতে যাবে না, ‘আমাদের মতো বাবা-মা পেয়ে তোমার তৃপ্ত হওয়া উচিত’। বরং এইভাবে বোঝাবেন, ‘তোমাকে পেয়ে আমাদের জীবন ধন্য হয়েছে।’

লেখক
খাদিজা ইসলাম
সাইকোথেরাপিস্ট,মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

Previous articleবাইপোলার ডিজঅর্ডার রোগীর অপরিণত শিশু জন্মদানের ঝুঁকি দ্বিগুণ!
Next articleমন ও সাহিত্য: হাসান আজিজুল হক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here