ট্রাফিক জ্যাম, মানসিক স্বাস্থ্যে কীরুপ প্রভাব ফেলে!

বৈশ্বিক উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। অথচ সময়ের সঙ্গে এদেশের মানুষের মানসিক চাপ বাড়ছে। ২০১৯ সালে ঢাকার প্রায় সাড়ে বারো হাজারের মানুষের ওপর একটা সমীক্ষা চালিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) দেখতে পান এই শহরের ৬৮ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ভাবে অসুস্থ। এর মধ্যে ৪৪ শতাংশ মানুষই ভুগছেন বিষণ্ণতায়। এর পেছনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে কাজ করছে ট্রাফিক জ্যাম।

ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যামের ভীষণ দুরূহ অবস্থা বর্তমানে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। ২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার রাস্তায় এক যুগ আগে যেখানে গাড়ি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার গতিতে চলতো। সেখানে বর্তমানে গাড়িগুলো ঘণ্টায় মাত্র ৫ কিলোমিটার যাচ্ছে। ট্রাফিক জ্যামের এমন ভয়াবহতা দূর করতে অনেক পদক্ষেপ নিলেও কার্যক্ষেত্রে তেমন কোন উন্নতিই চোখে পড়ছে না। যার ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় সময় কাটানো মানুষ সময়ের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে পড়ছে।

প্রতিদিন রাস্তাঘাটে ট্রাফিক জ্যাম এবং বহুক্ষণ যাতায়াতের ফলে যাত্রীদের মানসিক অবস্থার উপর ভীষণ চাপ পড়ছে। রাস্তাঘাটের চেঁচামেচি, গাড়িঘোড়ার প্রচন্ড শব্দ একজন চালক এবং যাত্রীদের উপর ভীষণভাবে প্রভাব ফেলছে। যার ফলে বাড়ছে মানসিক চাপ। এর কারণে একজন মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণহীনতা, কাজের ক্ষেত্রে হতাশা বা প্রতিক্রিয়ায় নানারকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

যার ফলে সংসার, সমাজেও বাড়ছে সমস্যা। এই প্রসঙ্গে ভারতের মনোবিদ সানি জোসেফ বলেন, ‘ট্রাফিক জ্যামের ফলে সৃষ্ঠ মানসিক চাপ প্রায়শই আমাদের ঘরে চলে আসে। যার ফলে আমাদের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ঘরে এসে বিশ্রামের সময় সন্তানদের বকাঝকা কিংবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অযথা ঝগড়া-বিবাদের মতো ঘটনাও ঘটছে। এছাড়াও রাস্তায় যানজটের কারণে অনেক সময় স্বাভাবিক কাজও ব্যাহত হয়। রাস্তায় নষ্ট হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর এসব সময়ে রাস্তায় অত্যাধিক শব্দ মস্তিষ্কে চাপ দেয়।’

এদিকে ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জিপজেটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে ঢাকাতে বাস করা সবচাইতে স্ট্রেসফুল বা মানসিক চাপের ব্যাপার। ১৫০টি শহরের তালিকায় অনাকাঙ্খিতভাবেই এক্ষেত্রে নাম্বার ওয়ান বাংলাদেশ। গবেষণায় দেখা যায়, এর পেছনে বড় অংশে দায়ী ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম, বায়ু দূষণ, লিঙ্গ বৈষম্য, বেকারত্ব, মানসিক স্বাস্থ্যের মতো বিষয়।

ঢাকায় দীর্ঘদিন ধরে বাস করছেন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ত্রিশোর্ধ্ব এমন কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে তাদের উপর পড়া মানসিক চাপের কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া যায়।

মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করা আহমেদ হুমায়ন বলেন, ‘ঢাকার প্রতিটা মোড়ে, প্রতিটা সিগন্যালে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়, বাসা থেকে রোজ সকালে এক ঘণ্টা আগে বের হতে হয়। তার উপর ঠিকমতো গাড়ি পাওয়া যায় না, মাঝে মাঝে দুই-তিনবার গাড়ি বদল করে গন্তব্যে পৌঁছানো লাগে। দূষিত বায়ু, ধূলাবালি এসব কারণে কোথাও সহজে যাওয়া যায় না, এমনকি শপিং সেন্টারেও দেখবেন ভিড়।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন বলেন, ‘যেখানে যাবেন জ্যাম, কোন ট্রাফিক রুলস নাই, গাড়ি যে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চালাচ্ছে। রাস্তায় অনেক সময় ট্রাফিক পুলিশরা গাড়িগুলো আটকিয়ে অযথা হয়রানি করে জ্যাম তৈরি করছে। এছাড়াও রাস্তায় দেখবেন ডাস্টবিন উপচে ময়লা পড়ছে। ফুটপাত দখলে থাকে, হাঁটার কোনো জায়গা নাই, এজন্য দেখা যায় ওজন বেড়ে যায়, রক্তচাপ বাড়ে, মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। কোনো সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করে তুলতে এই বিষয়গুলোই যথেষ্ট।’

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বিষয় একজন মানুষের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক সম্পর্কগুলোর ওপর প্রভাব ফেলছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিউটের মনোবিজ্ঞানী ডা. মেখালা সরকার, ‘প্রতিদিনের কাজ সম্পন্ন করা যখন কঠিন হয়ে যায় সিম্পল একটা জ্যামের কারণে তখন সেটা একজন মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে। এখন নিয়মিত ট্রাফিক জ্যামে পড়া, অসুস্থতায় ভোগা কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় অনেক মানুষ মানসিক চাপে ভুগছে।’

এত মানুষের বিষণ্ণতার কারণ পর্যালোচনা করতে গিয়ে বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. এস এম জুলফিকার আলী বলেন, ‘নগরীর মানুষ ট্রাফিক জ্যাম, বাতাসের মান, ইভটিজিংসহ প্রভৃতি কারণে বিষণ্ণতায় ভুগছেন।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘বিষণ্ণতা যেমন প্রকট আকারে বাড়ছে, আমরা এর সমাধানের লক্ষ্যে গবেষণায় দেখার চেষ্টা করছি। এটি ঠিক শহরে মানুষ যেসব কারণে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হচ্ছে সেগুলোর সব রাতারাতি সমাধান সম্ভব না। তবে এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়া যায় যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে সহজ করে তুলবে। যেমন, যানজট প্রতিনিয়ত মানুষকে মানসিক চাপে ফেলছে। এরজন্য কেবল বিভিন্ন পদক্ষেপ বা উন্নয়নই যথেষ্ট নয়। এমন ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করা যার মাধ্যমে যানজটের প্রকোপ ৩০/৪০ ভাগ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব। আর সেটি হলে সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রভাব পড়বে যা মানুষের মানসিক চাপ কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবে।’

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪
Previous articleবুদ্ধিদীপ্ত ও চিন্তাশীল মানুষ হতে হলে মাদক থেকে দূরে থাকতে হবে
Next articleঅবসর কখন নেওয়া উচিত?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here