ওসিডি অদ্ভুত রোগের নানারকম লক্ষণ

দৈনন্দিন জীবনে অন্যের সাথে টাকা পয়সার লেনদেন আমাদের প্রায় সবারই হয়। লেনদেন করতে গিয়ে অন্যের টাকা যখন আপনার কাছে আসে তখন কি আপনি সেই টাকা পানিতে ধুয়ে তারপর মানিব্যাগে রাখেন বা বাসার বাইরে গিয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে তা বাসায় আসার পর ধুয়ে পরিষ্কার করেন? কিংবা একই টয়লেট অনেকে ব্যবহার করে বলে সেই টয়লেট ব্যবহার না করে নিজঘরে পেপার বিছিয়ে টয়লেট করার কথা শুনেছেন কখনো? আপনি কি এসব কথা শুনে অবাক হচ্ছেন কিংবা ভাবছেন পাগলের প্রলাপ বকছি? শুনতে অবাক লাগলেও বাস্তব সত্য হচ্ছে, এই অদ্ভুত ব্যাপারগুলো কারো কারো ক্ষেত্রে ঘটেও বটে। কেউ জানেন কেউ বা জানেন না যে এই অদ্ভুত সমস্যাগুলো একটি মানসিক রোগে দেখা যায় যাকে আমরা বলি অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি), অনেকে যাকে শুচিবাই রোগ বলে চেনেন।

একই ধরনের অদ্ভুত চিন্তা বা ছবি এই রোগে ভিড় করতে থাকে মাথায়, আপনি যাকে অপ্রয়োজনীয় ভেবে তাড়াতে চাচ্ছেন কিন্তু পারছেন না, বারবারই বিরক্তিকর এই চিন্তাগুলো চলে আসছে মনে। অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডারের ‘অবসেশন’ বলতে এই অদ্ভুত, অপ্রয়োজনীয়, বিরক্তিকর অবাধ্য চিন্তাগুলোকেই বোঝায়। আপনি বুঝছেন চিন্তাগুলো আপনার নিজের এবং অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু সরাতে পারছেন না, আপনি চাইছেন চিন্তাগুলো না আসুক কিন্তু আটকাতে পারছেন না। এই একই ধরনের চিন্তা এক বা একাধিক বিষয়ে হতে পারে। যেমন-কারো শুধু ময়লা বা নোংরা নিয়ে চিন্তা আসে তো কারো আবার ময়লা ছাড়াও ধর্ম বা যৌনসম্পর্কের বিষয়ে চিন্তা আসে।

ধরা যাক, আপনার বা আমার হাতে ময়লা লেগেছে, তখন আমি বা আপনি কী করি, একবার বা দুইবার ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলি। কিন্তু যাদের ক্ষেত্রে এই রোগটি রয়েছে তারা অনেকবার অনেক সময় ধরে হাত ধুতে থাকেন-কারণ তাদের মনের ভেতর চিন্তা আসতে থাকে যে, তার হাতের ময়লাটা বোধহয় গেল না। এই ময়লা লেগে থাকার চিন্তা বারবার আসাটাকে বলে অবসেশন। আর এই চিন্তার ফলে যে কাজটি আপনি করছেন যেমন এক্ষেত্রে বারবার হাত ধোয়া, একে বলে কমপালসন। বারবার আসা চিন্তাগুলোর কারণে যে কাজগুলো করতে আপনি বাধ্য হচ্ছেন বা চিন্তাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে বা আপনার উদ্বেগ কমাতে বাধ্যতামূলক যে কাজগুলো বারবার করছেন কমপালসন বলতে তাকেই বোঝায়।

বাধ্যতামূলক কাজগুলো আচ্ছন্নকারী চিন্তা কমানোর জন্য একটি মাধ্যম হিসেবে শুরু হয়। একটি কথা মনে রাখা জরুরি, সবক্ষেত্রে অবসেশনের ফলে কমপালশন নাও থাকতে পারে। ভেতরে ভেতরে চিন্তাটি কাজ করলেও তার বিপরীতে অনেক সময় কমপালশন থাকে না। চিন্তাটি মন থেকে সরিয়ে ফেলতে চাইলে বেশি করে আসে। নিজেকে তখন অসহায় মনে হয়। তবে তা যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটাতে থাকে তখনই তাকে রোগ হিসেবে বিবেচনা করতে হয়। এই রোগটি যেমন অদ্ভুত তেমনি এর লক্ষণগুলোও নানা রকমের। যাদের ময়লা, নোংরা কিংবা জীবাণু নিয়ে চিন্তা আসে তারা দেখা যায়, বারবার হাত ধোয় বা গোছল করতে গেলে অনেক সময় ব্যয় করে, নিজের প্লেট-গ্লাস বা বিছানা অন্যকে ব্যবহার করতে দেয় না। আবার যাদের ধর্ম নিয়ে চিন্তা আসে তারা ভাবে স্রষ্টা নেই, নামাজ পড়তে গেলেই নোংরা চিন্তা আসে অথবা কোরআন, হাদিস নিয়েও খারাপ চিন্তা আসে যার ফলে সে সবসময় দোয়া দরূদ বা জিকির করতে থাকে গুনাহ হবে ভেবে। একইভাবে হিন্দুদের ক্ষেত্রে দেব-দেবীদের নিয়ে নোংরা চিন্তা আসে।

যৌন চিন্তাগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায় যাদের সাথে যৌন সম্পর্ক করা যায় না যেমন : বাবা, মা, ভাই, বোন তাদেরকে নিয়ে এই চিন্তা আসে যা ওই ব্যক্তির জন্য খুবই যন্ত্রণার। অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে দেখা যায় কেউ কেউ একই জিনিস বারবার পরীক্ষা করছেন, কেউ বা কোনো কাজ নিখুঁতভাবে করতে চাচ্ছেন, কেউ নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে কোনো কাজ করছেন যা থেকে একটু এদিক-সেদিক হলেই অস্থির হয়ে পড়ছেন। কেউ আবার লাকি-আনলাকি নম্বরের কঠিন নিয়মে আটকে আছেন, কেউ অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জমিয়ে রাখছেন আবার কেউ বা সবকিছু জোড়ায় জোড়ায় এক লাইনে সাজাতেই সময় পার করে ফেলছেন। যার যে চিন্তাই থাকুক না কেন চিন্তাগুলো তার দৈনন্দিন জীবনে তাকে দিনে দিনে গতিহীন করে ফেলে। অন্য অনেক মানসিক রোগের মতোই ওসিডিরও নির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনো জানা যায়নি। কেউ বলেন কিছু কিছু নিউরোকেমিক্যালের তারতম্যের কারণে এই রোগে আক্রান্ত হন ব্যক্তি, কেউ আবার জেনেটিক বিষয়গুলোকে কারণ হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। গবেষণা বলে, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কিছু জিন যা মস্তিষ্কের গঠনের ওপর প্রভাব ফেলে। যদিও নির্দিষ্ট কোনো জিন চিহ্নিত করা যায়নি তবু কিছু প্রমাণাদি থেকে দেখা যায় যে, এটি পারিবারিকসূত্রে ঘটতে পারে। গবেষণায় দেখা যায়, ওসিডি আক্রান্ত মানুষের মস্তিষ্কের কিছু অংশে কার্যকারিতা কমে যাওয়া এবং মস্তিষ্কের রাসায়নিক যেমন-সেরেটোনিনের অভাবসহ কিছু অস্বাভাবিকতা আছে।

তাছাড়া কিছু রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে স্ট্রেপ্টোকোক্কাল ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের পর ওসিডি দেখা দিতে পারে। সারাবিশ্বে প্রায় ১-৩% মানুষ এ রোগে আক্রান্ত এবং মানসিক রোগগুলোর মধ্যে এর অবস্থান চতুর্থ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে মানুষের অক্ষমতার কারণগুলোর মধ্যে এটির অবস্থান দশম। আমাদের দেশেও এ ধরনের রোগীর সংখ্যা কম নয়। শিশু এবং কিশোর বয়সেও এ রোগ দেখা দিতে পারে। গবেষণা বলে, আমাদের দেশে ওসিডি অক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের ময়লা বা নোংরা নিয়ে চিন্তা আসে আর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ধোয়া বা পরিষ্কার করার হার বেশি। বেশিরভাগ রোগীদের মধ্যে এর সাথে অন্যান্য মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই মাত্রা অর্ধেকেরও বেশি। আমাদের দেশে পরিচালিত অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১০ বছরের ওপরে ওসিডি আক্রান্ত রোগীদের জীবনযাত্রার মান নিম্নগামী এবং গবেষণা বলে, ওসিডি আক্রান্ত রোগীদের বেশিরভাগেরই রোগের তীব্রতা অনেক বেশি। তীব্রতা বেশি হওয়ার পেছনে একটি বড়ো কারণ হচ্ছে এই রোগের ব্যাপারে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ সচেতন নয়। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের অনেক মানুষ এখনো মানসিক রোগের ব্যাপারেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন। শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ বুঝতে পারে না এটা একটি মানসিক রোগ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে চিকিৎসার অভাবে রোগটি ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যায়।

পরিবারে কোনো সদস্য এ রোগে আক্রান্ত হলে তা অন্যদের মধ্যে বিরক্তির উদ্রেগ করে এবং অন্যরা ভাবেন যে, সে এসব ইচ্ছাকৃতভাবে করছে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উপেক্ষা ও কটাক্ষ এক সময় তার রোগটিকে দিনে দিনে বাড়িয়ে তোলে কারণ ওসিডি মনের ওপর চাপের কারণে বেড়ে যেতে পারে। এ রোগের ব্যাপারে অজ্ঞতার কারণে আমাদের দেশে ওসিডি আক্রান্ত মানুষ প্রায়ই চিকিৎসককে তাদের উপসর্গ বলতে চান না, কারণ এতে তারা বিব্রত বোধ করেন বিশেষ করে সেক্সচুয়াল বা যৌন চিন্তাগুলোর ক্ষেত্রে। অনেকেই তাদের পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের কাছ থেকে তাদের উপসর্গ আড়াল করার চেষ্টা করেন কারণ তারা অনেকেই বুঝতে পারেন না যে, এটা একটি মানসিক রোগ। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পরে কারণ সে তার সমস্যার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে না তাই সে প্রায়ই বিরক্তির মধ্যে থাকে এবং খুব খিটখিটে আচরণ করে।

যদিও আমাদের দেশে মানসিক রোগের ব্যাপারে দিনে দিনে সচেতনতা বাড়ছে তবু এখনো দেশের একটি বড়ো অংশই মনে করে-মানসিক রোগ মানেই ভাঙচুর, মারামারি আর উচ্ছৃঙ্খলতা। শুচিবাই, বিষণ্ণতা বা দুশিন্তাগ্রস্ততার মতো সমস্যাগুলো যে মানসিক রোগ হতে পারে তা হয়ত অনেকেই জানেন না। এই রোগের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি পরিবার থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন বা সংসার ভেঙে গেছে এমন ঘটনাও কিন্তু কম নয়। তবে ভালো খবর এই যে, পত্রিকা, ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কল্যাণে মানুষ এখন শুধু ওসিডি নয়, অন্যান্য মানসিক রোগেগুলোর ব্যাপারেও সচেতন হচ্ছে।

ওসিডি একটি নীরব মানসিক রোগ, তবে ওসিডি নিয়ে বিব্রত অথবা লজ্জিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, এটি একটি রোগ যা আপনার জন্য দোষের কিছু নয়। ওসিডি ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন অথবা অ্যাজমার মতো একটি দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য অবস্থা যা চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তাই ওসিডি রোগটি লুকোনোর কিছু নেই। বরং লুকালে নিজেরই ক্ষতি। তাই রোগটি না লুকিয়ে আপনার উচিত মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া এবং সেইসাথে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের রোগীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হওয়া জরুরি, তাহলেই শুধু খুব প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নিয়ন্ত্রণ করে রোগীর কষ্ট কমানো সম্ভব।

সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ৮ম সংখ্যায় প্রকাশিত।

Previous articleধূমপান ও স্থূলতার মতোই ক্ষতি করে নিঃসঙ্গতা:গবেষণা
Next articleমানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রযুক্তি
সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, সিরাজগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here