বিবাদে না জড়িয়ে দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন যেভাবে

0
69
রাগ

মতভেদ থাকা ভাল। কেননা, আমরা যদি সবাই একই মতের হই তবে পৃথিবীটা অনেক নিস্তেজ হয়ে পড়বে। কিন্তু এটাও ঠিক যে আমরা এখন নানা বিষয়ে গভীরভাবে বিভক্ত, এবং সেই বিভাজন দিন দিন অনেক কুৎসিত হয়ে উঠছে। জমকালো পাবলিক বক্তৃতা বা গণ-আলোচনা দিন দিন কলহপূর্ণ, বিদ্রূপাত্মক হয়ে উঠছে। যেখানে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব দেখা যায়। আমরা মানুষের সাথে এখন আর আইডিয়া নিয়ে লড়াই করছি না বরং প্রায়শই একে অপরকে অপমানের খেলায় মেতে উঠছি।

তবে আমরা কীভাবে এই খেলাকে আরও উন্নত করতে পারি? ডগলাস আলেকজান্ডার তার লেখা ‘আ গাইড টু ডিজঅ্যাগ্রি বেটার’ (আরও ভালভাবে মতবিরোধের নিয়ম) বইটিতে এমন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছেন। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, জ্ঞান, শতভাগ সততা, প্রচণ্ড ঘনিষ্ঠতা এবং খোলামেলা হওয়া প্রয়োজন। সুতরাং, কথায় যাচ্ছে-তাই বলা কমিয়ে দিন, মানুষকে অপমান করার ওপর লাগাম টানুন এবং কীভাবে বিবাদমান না হয়েই দ্বিমত পোষণ করবেন সে সম্পর্কে বিবিসি অবলম্বনে  কিছু টিপস জেনে নিন।

১. আপনার একমত হতে হবে না

“প্রথম ধাপ হল, একমত না হওয়া”, এমনটাই বলেছেন হার্ভার্ডের অধ্যাপক আর্থার ব্রুকস। তিনি তার লেখা, “লাভ ইওর এনিমিজ” (আপনার শত্রুদের ভালবাসুন) বইতে এটাই লিখেছেন।এটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা সব বিষয়ে একমত হই না এবং যদি সব সময় ওই বিষয়ে আমাদের দ্বিমত থাকে, সেটাও পুরোপুরি ঠিক আছে। আমরা যদি চিন্তা-ভাবনার স্বাধীনতাকে ভালবাসি তাহলে আমাদের এমন মানুষদের দরকার যারা নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। আমরা যদি সবাই একইরকম ভাবি তাহলে এই পৃথিবীটা কি একঘেয়ে হয়ে উঠবে না? তাই মনে রাখতে হবে যে, নিজের মধ্যে মতবিরোধ করা কোন সমস্যা নয়, আমরা এটি এভাবেই করি।”
২. মাঝামাঝি কোন মতে পৌঁছানোর লক্ষ্য রাখবেন না
কোন ঝগড়াঝাঁটি ছাড়া দ্বিমত পোষণ করার জন্য যে সমঝোতাই করতে হবে, বিষয়টা এমন নয়। কখনও মাঝামাঝি কোন মতে পৌঁছানোর লক্ষ্য রাখবেন না- যখন আপনি কোন বিষয়ে মৌলিকভাবে একমত হতে পারছেন না তখন মতপার্থক্যকে আলাদা করা কোন সমাধান নয়। বরং, একটি সাধারণ অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয় – তাই পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও অভিজ্ঞতা, আবেগ বা প্রত্যাশা ভাগ করে নেওয়াই ভাল।

৩. আপনি কি বলছেন, তার চেয়ে জরুরি আপনি কীভাবে বলছেন:

এস্থার পেরেল আমেরিকার অন্যতম প্রধান কাপল কাউন্সিলর বা যুগল পরামর্শদাতা। তিনি এমন অসংখ্য নারী ও পুরুষের কথা জানেন যারা খুব খারাপভাবে দ্বিমত পোষণ করে। এস্থার বলেন,  “আপনি কোন বিষয় নিয়ে কথা বলছেন তার চাইতে অনেক বেশি জরুরি আপনি সেই বিষয়টি নিয়ে কীভাবে কথা বলছেন, যদি আমরা এমনভাবে কথা বলি যার মাধ্যমে একজন আরেকজনকে সবসময় বাদ দিয়ে দিচ্ছি, ছোট করে ফেলছি তাহলে সেটা, টাকা পয়সা, বাচ্চাকাচ্চা, যৌনতা বা বৈশ্বিক পরিস্থিতি যে বিষয়েই কথা হোক না কেন, সেটা বিষয় না। কথা বলার এই বিষয়গুলো অপ্রাসঙ্গিক। এর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হল এই কথাগুলো প্রকাশের জন্য আমরা কতোটা প্রগতিশীল”।

৪. সত্য কথা বলুন

ঘনিষ্ঠতা অর্জনের জন্য, অর্থপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করুন। যার সাথে আপনার মতের মিল নেই তার সাথেও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকুন। সম্পূর্ণ সৎ থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। ফিওনা হলেন ডেরির বাসিন্দা, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তার ভাইকে গুলি করে হত্যা করেছিল। অথচ তিনি সততার সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে এক প্রাক্তন সৈনিকের সাথে দৃঢ় বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, অনেক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও। ওই সৈনিক তার ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনার সময়ে দায়িত্বে ছিলেন। ফিয়োনা বলেন,”সৎ ও খোলামেলা কথোপকথন কখনও কখনও অনেক নির্মম ও অস্বস্তিকর হলেও এটা করতে হবে, “অন্যথায়, আপনি কেবল একটা জায়গায় আটকে থাকবেন। ”
ডগলাস এ ব্যাপারে একমত পোষণ করে বলেছেন; মতবিরোধ সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে: “যে সমাজ ন্যায়বিচার এবং সততার উপরে সভ্যতা, ভদ্রতা বা সৌজন্যতাকে মূল্য দেয়, তাহলে সেটা একটি স্থবির সমাজের উদাহরণ হতে পারে।”
সত্য কথা বলুন। সভ্যতা, সৌজন্যতা বা শিষ্টাচার ভাল, তবে প্রচণ্ড সততা এর চাইতে শক্তিশালী ভিত্তি।

৫. মনোযোগ সহকারে শুনুন এবং সহানুভূতিশীল হওয়ার চেষ্টা করুন

সৎ কথোপকথন মানে সত্য কথা বলা এবং অপরজন কি বলছে সেটা আন্তরিকভাবে শোনা। যুগলদের থেরাপিস্ট এস্থার বলেছেন, “অপরজন যা বলছে তা গ্রহণ করার ইচ্ছাই আসলে সব” তিনি একে “ভয়ানক ঘনিষ্ঠতা” হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এর বিপরীতে রয়েছে কেবল যুদ্ধ, তিনি বলেন। আপনি নিজেকে অন্য ব্যক্তির উপরে রাখতে চান – এবং তারা যা কিছু বলেছে তার সাথে এক সেকেন্ডের জন্য নিজেকে মেলানোর চেষ্টা করবেন না। অন্যের মতের সাথে নিজেকে এই মেলানোর বিষয়টি আমাদেরকে সহানুভূতির দিকে ঠেলে দেয়। কোনও অচলাবস্থায় পৌঁছানো রোধ করতে, কেবল মনোযোগ দিয়ে কথা শোনাই জরুরি না।
আমাদের কৌতূহলী হতে হবে, খোলামেলা হতে হবে এবং সহানুভূতিশীল হওয়ার চেষ্টা করতে হবে, বলেন এস্থার। আপনি আপনার প্রতিপক্ষের জুতোয় নিজেকে দাঁড় করাতে পারেন এবং তার মতো করে বিষয়গুলো দেখতে পারেন।

৬. বাকবিতণ্ডা কমিয়ে দিন এবং অপমানে লাগাম টানুন

সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো মানুষকে তাৎক্ষণিক অপমান করা খুব সহজ করে দিয়েছে। এবং এই হিংসাত্মক ভাষাগুলো বাস্তব দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। এস্থার বলেন, “একে অপরের প্রতি ঘৃণা থেকে এই বাদানুবাদ হচ্ছে। এটি কেবলমাত্র অন্য ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত হওয়ার ব্যাপার নয়, বরং এই মানুষগুলো তাদের মতের বিরুদ্ধে বলা মানুষগুলোকে খাটো করে দেখছে।” ঘৃণা দেখানোর ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি তার প্রতিপক্ষের ধারণার চাইতে তার পরিচয়ের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়, এটি দ্বিমত পোষণ করার সবচেয়ে ক্ষতিকর উপায়। এটি কেবল অপ্রীতিকরই নয়, এটি গভীরভাবে অকার্যকরও বটে। অধ্যাপক আর্থার ব্রুকস বলেছেন, “ইতিহাসে কোন চুক্তি হওয়ার সময় কাউকেই অবমাননা করা হয়নি। এটি কেবল অন্য ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে আপনার বিরোধিতাকে আরও কঠোর করে।
এর সমাধান চাইছেন? আর্থার বলেন, “এর সমাধান হল, আমাদের সবাইকে বাকবিতণ্ডায় জড়ানো কমিয়ে ফেলতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং রাজনীতিবিদদের টিটকারির মুখে পড়ে আমরা এমন মানুষ হয়ে উঠছি যা আমরা হতে চাই না। এমন হওয়া বন্ধ করুন। এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়ান।”

৭. সত্য এবং মতামতের মধ্যে পার্থক্য বুঝুন

আমাদের মতামত হল যার যার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি যা প্রমাণের বিরুদ্ধে পরীক্ষা করা হয় – এই মতামত কেবল আমাদের বিরোধীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তাক করা নয়। পালক মা ক্যাথিকে এলোমেলোভাবে সিটিজেনস অ্যাসেম্বলির জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল যা আয়ারল্যান্ডের কঠোর গর্ভপাত আইন পরিবর্তন করার বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। সেখানে, তিনি তার চাইতে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মানুষের সাথে এবং এসব বিষয়ে তথ্য দিতে পারদর্শী, এমন একাধিক বিশেষজ্ঞের সাথে সাক্ষাত করেন। ক্যাথি বলেন, “আমার জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল, আমার মতামত কেবল আমার মতামত, যদি না আপনি এটিকে একটি জ্ঞাত মতামত করার জন্য সময় এবং প্রচেষ্টা চালিয়ে না যান, তবে এটি কেবল আপনার মতামত হয়ে থাকবে এবং একে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না।” কোথাও মতামত দেয়ার আগে সব সময় বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ এবং বিশেষজ্ঞ পরামর্শের সন্ধান করুন।

৮. যান, ঝামেলা খুঁজে বের করুন

আর্থার বলে, “যেকোন ক্ষেত্রে পারদর্শী হতে, মতবিরোধের সন্ধান করুন। আপনি যদি দ্বিমত প্রকাশের ক্ষেত্রে পটু না হন, তাহলে হয়তো আপনার বন্ধুচক্র এতোটা বিস্তৃত এবং বৈচিত্রময় নয়। যান, কাউকে খুঁজে বের করুন। তার কথা সমবেদনা সহকারে শুনুন, আপনার দৃষ্টিভঙ্গি তার সঙ্গে শেয়ার করুন এবং ভালবাসা প্রকাশ করুন”।

Previous articleপরীক্ষার ফলাফল কেন শিশুদের আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যায়?
Next articleআত্মহত্যা প্রতিরোধে ঢাবিতে জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here