করোনায় শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য খেয়াল রাখা প্রয়োজন

করোনায় শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য খেয়াল রাখা প্রয়োজন

মানসিক স্বাস্থ্য বিশ্বব্যাপী একটি ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও স্বাস্থ্য সমস্যা। মানসিক স্বাস্থ্য কোনো অংশেই শারীরিক স্বাস্থ্যের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। শারীরিক সুস্থতার ক্ষেত্রে কেউ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হলে তার পরিপূর্ণ কর্মশক্তি থাকে এবং তিনি ভালো কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারেন। একই রকমভাবে কেউ মানসিকভাবে সুস্থ থাকলে তিনিও পূর্ণোদ্যমে অনেক ভালো কাজ করতে পারেন। অর্থাৎ পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উভয়েরই সুস্থতার সংযোগ আবশ্যক।

মানসিক স্বাস্থ্য হলো আমাদের মন, আচরণগত ও আবেগপূর্ণ স্বাস্থ্যের অপরিহার্য এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আমরা কী চিন্তা করি, কী অনুভব করি এবং জীবনকে সামলাতে আমাদের চিন্তা-চেতনা কীভাবে ব্যবহার করি। এগুলোই আসলে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অর্থবহ অংশ।

মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ নিজের সম্পর্কে যথাযথ ধারণা রাখেন এবং কখনোই মাত্রাতিরিক্ত আবেগ, যেমন রাগ, ভয়, হিংসা, অপরাধবোধ বা উদ্বেগ দ্বারা আবিষ্ট হন না। জীবনে যখন যেরকম পরিস্থিতি উদ্ভুত হয়, তা সামলে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন তারা।

শারীরিক রোগ-ব্যাধি যেমন ব্যক্তির শারীরিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে; তেমনই ব্যক্তি যখন বিভিন্ন নেতিবাচক আবেগ, যেমন- উদ্বেগ বা ভয় দ্বারা আবিষ্ট থাকেন; তখন এই আবেগগুলো তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে দিতে পারে। যেমন- ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা, জেনারেল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার বা সাধারণ উদ্বেগজনিত ব্যাধি, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার প্রভৃতির আবির্ভাব।

বাস্তবতা হচ্ছে- আমরা শরীরের সুস্থতা নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন থাকি এবং সুস্থতার ব্যাপারে যতটা নজর রাখি, মনের সুস্থতার ব্যাপারে আমরা যেন ঠিক ততটাই উদাসীন। বয়স্ক মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে ৯২.৩ শতাংশ নানা কারণে মানসিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। শিশু-কিশোর বয়সী মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৯৪.৫ শতাংশই চিকিৎসাসেবার আওতার বাইরে। এমনকি যেসব শিশু-কিশোর মানসিক প্রতিবন্ধিতার চিকিৎসা পায়, তাদের প্রায় ২৯.২ শতাংশেরই চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

সুস্থ শরীর ছাড়া যেমন সুস্থ মন সম্ভব নয়, তেমনই সুস্থ মন ছাড়া সুস্থ শরীর এবং সুস্থ জীবন কোনোটাই সম্ভব নয়। একবার ভেবে দেখুন তো, শারীরিক অসুখ নিয়ে আমরা যেমন অস্থির ও অধীর হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেই, মনের অসুখ নিয়ে বা মনের সমস্যা নিয়ে আমরা আদৌ মানসিক ডাক্তারের কাছে যাই না। এজন্য আসলে দায়ী মন, মনের সমস্যা ও মানসিক ব্যাধি সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা ও উদাসীনতা। শরীরের অসুখের মতোই মনেরও যে অসুখ হতে পারে, সে সম্পর্কে অধিকাংশই স্পষ্ট ধারণা রাখেন না।

অনেকে মনে করেন মানসিক রোগ মানেই পাগল, সাইকিয়াট্রিস্ট মানেই পাগলের ডাক্তার। ব্যাপারটা কিন্তু আদৌ সে রকম নয়। মানসিক ব্যাধিগুলোকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়- গুরু মানসিক ব্যাধি এবং লঘু মানসিক ব্যাধি। সাধারণভাবে যাদের আমরা পাগল বলে আখ্যায়িত করি, তারা সবাই গুরু মানসিক ব্যাধির অন্তর্ভুক্ত এবং এ সংখ্যা খুবই কম। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৬.০৫ শতাংশ। এর মাঝে গুরু মানসিক ব্যাধিতে মাত্র ১ শতাংশ এবং বাকিরা সবাই লঘু মনসিক ব্যাধি, যেমন- বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, মানসিক চাপজনিত মানসিক ব্যাধি ইত্যাদিতে আক্রান্ত এবং এরা কেউই পাগল নন। এদেরই চিকিৎসা করেন সাইকিয়াট্রিস্ট বা মানসিক চিকিৎসক।

শরীর ফিট রাখার জন্য আমরা নিয়মিত হাঁটা, ব্যায়াম, জিমে যাওয়া, ডায়েট কন্ট্রোল ইত্যাদি কত কিছুই না করি। মনের সুস্বাস্থ্যের জন্য অনেকে হয়তো মেডিটেশন, ইয়োগা ইত্যাদি করে থাকেন। কিন্তু কেবল এগুলোই পর্যাপ্ত নয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রতিদিনই আমরা কিন্তু শারীরিক সমস্যা অনুভব করি না। যেমন- প্রতিদিন একজন মানুষের জ্বর হয় না বা শরীরে ব্যথা হয় না। তবে এমন কোনো দিন নেই, যেদিন আমরা কোনো না কোনো মানসিক সমস্যার লক্ষণ অনুভব করি না। যেমন: প্রতিদিন কোনো না কোনো সময় আমরা নানা কারণে উদ্বিগ্ন হই, বিষণ্ণতা অনুভব করি, মানসিক চাপ অনুভব করি কিংবা উত্তেজিত হই। এগুলো সবই মানসিক সমস্যার লক্ষণ।

আবার এগুলো অনুভব করা মানেই যে কেউ মানসিক রোগী, তা কিন্তু নয়। এগুলো কিছুটা সময়ের জন্য হলেও আপনার মানসিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। বাস্তবতা হলো, পৃথিবীতে বসবাস করতে গেলে এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতেই হবে। যেহেতু প্রতিদিন নানা রকম সমস্যায় পরতে হয়, সেগুলোর সুন্দর সমাধানের জন্য অবশ্যই মনের স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। মনের স্থিতিশীলতা-অস্থিতিশীলতা আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ভর করে চিন্তার প্রক্রিয়ার ওপর। দৈনন্দিন জীবনযাপনকে সুন্দর করতে হলে মানসিক স্বাস্থ্যের স্থিতিশীলতা অতীব জরুরি।

মনের সমস্যার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হলে অর্থাৎ চিন্তাধারা, মনের সমস্যা প্রভৃতি পারিবারিক, সামাজিক, কর্মজীবন, শিক্ষাজীবন ইত্যাদি জীবনের নানা ক্ষেত্র ব্যাহত করলে অবশ্যই সব সামাজিক বাঁধার ঊর্ধ্বে উঠে এর চিকিৎসা করাতে হবে। প্রয়োজনে মানসিক চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে। কারণ এ অবস্থা চলতে থাকলে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় জীবন একদিন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।

যদি আপনার কাছের মানুষ, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবদের কারো মাঝে হঠাৎ করে আচরণের কোনো লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখতে পান অথবা মানসিক রোগের কোনো লক্ষণ তাদের মধ্যে লক্ষ্য করেন, তবে আন্তরিকতার সঙ্গে তাকে সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হতে পরামর্শ দিন। সম্ভব হলে নিজে তাকে নিয়ে যেতে পারেন মানসিক চিকিৎসকের কাছে। এ ব্যাপারে তার মধ্যে কোনো ভয়-ভীতি কাজ করলে, তা ঝেরে ফেলতে তাকে পরামর্শ দিয়ে পারেন। পরিপূর্ণ এবং সঠিক চিকিৎসার জন্য মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীকে সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ মতো নিয়মিত ফলোআপে থাকাও জরুরি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে কেউ না কেউ আত্মহত্যার কারণে প্রাণ হারান। আর অধিকাংশ ব্যক্তিরই আত্মহত্যার কারণ মানসিক বিপর্যস্ততা বা মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়া। তাই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়িয়ে সার্বিক সুস্থতা অর্জনের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

Previous articleকরোনায় বিশেষ শিশুদের যত্ন
Next articleটেকসই উন্নয়নে মানসিক স্বাস্থ্য

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here