নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ডাক্তাররা সাইমন ফ্যারেলকে ওষুধ দিয়ে সংজ্ঞাহীন করে রেখেছিলেন কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য। সেই কৃত্রিম কোমা থেকে জেগে ওঠার পর সাইমনের মনে আছে তিনি তার অক্সিজেন মাস্কটা ছিঁড়ে ফেলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। দশদিন তাকে রাখা হয়েছিল নিবিড় পরিচর্যায়। তাকে নি:শ্বাস নিতে হচ্ছিল ভেন্টিলেটারের মাধ্যমে।
ডাক্তাররা যখন তাকে কোমা থেকে জাগান, তখন কোভিড-১৯এর সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থা তিনি কাটিয়ে উঠেছেন, কিন্তু তার ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুসের তখনও স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নেবার ক্ষমতা ছিল না। তার অক্সিজেনের দরকার ছিল।
দুই সন্তানের বাবা ৪৬ বছরের সাইমন তখন মারাত্মক প্রলাপের মধ্যে। তার শরীরে যে অক্সিজেনের দরকার সেটা বোঝার ক্ষমতা তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার মনে হচ্ছিল এসবের কোন দরকার নেই।
কোভিড-১৯ যাদের গুরুতরভাবে অসুস্থ করেছে, যাদের বেশ কিছুদিন ভেন্টিলেটারে থাকতে হয়েছে এবং যাদের কড়া মাত্রায় ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখতে হয়েছে, সেসব রোগীর মধ্যে আইসিইউ-তে এমন লক্ষণ প্রায়ই দেখা গেছে।
হাসপাতালে দীর্ঘদিন ভেন্টিলেটারে থাকার পর তৈরি হতে পারে নানাধরনের শারীরিক ও মানসিক জটিলতা লন্ডনের রয়াল ফ্রি হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটের ঊর্ধবতন চিকিৎসক ডা. কুলওয়ান্ত ধাদওয়াল বলছেন, “এধরনের রোগীদের মধ্যে মারাত্মক প্রলাপ বা বিকার, বিভ্রান্তি এবং অস্থিরতা আমরা দেখছি। সাধারণত কারো যদি অস্ত্রোপচার হয় বা সাধারণ নিউমোনিয়া রোগীকে সংজ্ঞাহীন করা হয়, তারপর জ্ঞান ফিরলে তারা এতটা বিভ্রান্ত বা অস্থির অবস্থায় থাকে না। এই কোভিড-১৯ রোগীদের ভেন্টিলিটার থেকে বের করার পর তারা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে অনেক বেশি সময় নিচ্ছে।”
চিকিৎসকরা বলছেন, এ কাজটা সফলভাবে করা গেলেও, সেখান থেকেই শুরু হচ্ছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ করে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা রোগীদের আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া বিশাল একটা চ্যালেঞ্জ।
দীর্ঘ পথ
বিশ্বে লাখো লাখো মানুষ এখন এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছে। অনেকে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে ইনটেনসিভ কেয়ারে চিকিৎসা নিয়েছে, অনেককে হয়ত অতটা কঠিন সময় পার করতে হয়নি, অবস্থা গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছনর আগে হাসপাতালে অক্সিজেন চিকিৎসা তাদের সেরে উঠতে সাহায্য করেছে। কিন্তু কোভিড-১৯ এদের সবার জীবনকে বদলে দিয়েছে।
কিন্তু গুরুতর অসুস্থ হয়ে যাদের নিবিড় পরিচর্যায় যেতে হয়েছে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে তাদের পুনর্বাসন কীভাবে হবে, সেটা তারা কোমা থেকে জেগে ওঠার আগেই শুরু করা উচিত। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য তাকে সাহায্য করার কাজটা সেই সময় থেকেই শুরু করতে হবে।
তারা বলছেন, যখন গুরুতরভাবে আক্রান্তরা সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আছে, সে অবস্থাতেই নার্স ও বিশেষজ্ঞদের রোগীর পেশী ও হাড়ের জয়েন্টগুলো সচল রাখতে বিশেষ ব্যায়াম করাতে হবে। নাহলে দীর্ঘসময় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় থাকার কারণে তার শরীর খুব শক্ত হয়ে যাবে।
ডাক্তাররা বলছেন, কোভিড-১৯-এর মত মারাত্মক ভাইরাস থেকে সেরে ওঠার পর অন্যতম বড় একটা চ্যালেঞ্জ হল খুব মারাত্মক প্রদাহ কাটিয়ে ওঠা।
কীধরনের সমস্যা হয়?
প্রলাপ বা বিকার
চিকিৎসকরা বলছেন, যাদের ভেন্টিলেটার যন্ত্রের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে শ্বাস নিতে হয়, তাদের তিন চতুর্থাংশ রোগীর মধ্যে প্রলাপের লক্ষণ দেখা গেছে। অধিকাংশ চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা হল, এই প্রলাপ খুবই ভয়াবহ মাত্রায় হয় এবং তারা বিকারের মধ্যে এমন কিছু দেখেন যা বাস্তব নয়, যাকে হ্যালুসিনেশন বলা হয়। তারা বলছেন, যারা কোভিড-১৯এ গুরুতরভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রে এটাও হয় খুবই তীব্র মাত্রায়।
সংক্রমণের কারণে অথবা বেশি জ্বরের কারণে প্রলাপ হতে পারে। তবে রোগীকে স্বস্তি দেবার জন্য যেহেতু কড়া ঘুমের ওষুধ দিতে হয় তার কারণে এর মাত্রা এত তীব্র হয়ে ওঠে।
রোগী যখন ওষুধ দিয়ে তৈরি কোমা থেকে জেগে ওঠে এবং এই ওষুধের প্রকোপমুক্ত হতে শুরু করে, তখন তারা ভয়ঙ্কর সব কল্পিত দৃশ্য দেখে এবং তাদের মাথার ভেতর একটা বদ্ধমূল বিশ্বাস জন্মায় তারা যা দেখছে সেটা সঠিক। অর্থাৎ এর মানসিক প্রভাব রোগীকে ভয়াবহ রকমে আছন্ন করে ফেলে।
এই সমস্যা কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে প্রকটভাবে হচ্ছে, তার কারণ যখন তাদের ভেন্টিলেটার খুলে নেয়া হচ্ছে, সেসময় পরিবারের কারো সান্নিধ্য রোগীরা পাচ্ছে না। তারা যখন বাস্তব জগতে ফিরছেন, তখন তাদের চারপাশে শুধু হাসপাতালের যন্ত্র, হাসপাতালের গন্ধ ও পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মুখ ও কণ্ঠ। স্বজনেরা কেউ নেই।
দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যা
কোমা থেকে জেগে ওঠার পর অনেক সপ্তাহ ধরে এই প্রলাপ বা বিকারগ্রস্ত অবস্থা থেকে যেতে পারে। ডাক্তাররা বলছেন সময়ে ব্যবস্থা নেয়া না হলে এই বিকার থেকে পরে অবসাদ, উদ্বেগ ও নানাধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে।
সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে চিকিৎসা নেয়া রোগীদের প্রতি ৫ জনের মধ্যে একজনের মানসিক উদ্বেগে ভোগার নজির আছে। কিন্তু কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
ডরোথি ওয়েড বলছেন, কোভিড আক্রান্ত রোগীরা সেরে উঠে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর প্রাথমিকভাবে স্বস্তিবোধ করছেন এবং একটা আনন্দের আবহে থাকছেন। কিন্তু এসব রোগীদের ক্ষেত্রে সবকিছু স্বাভাবিক আছে কিনা সেটা পর্যবেক্ষণে রাখা খুবই জরুরি, কারণ এধরনের মানসিক উদ্বেগের পরিস্থিতি একটা সমস্যা হিসাবে দেখা দিতে সময় লাগতে পারে। অনেক সপ্তাহ ধরে যদি কেউ নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে সেবা নিয়ে থাকেন তার জন্য শারীরিকভাবে সেরে ওঠা বড়ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অনেক কোভিড রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তারা অসম্ভব অবসন্ন বোধ করছেন এবং তাদের পেশী বিকল হয়ে গেছে। তারা এতই ক্লান্ত যে চেয়ারে আধ ঘন্টা বসে থাকলে তাদের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য এরপর চার ঘন্টা ঘুমতে হচ্ছে। পেশী আবার শক্ত করে তোলা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
কাজেই এই রোগ থেকে একজনকে পুরোপুরি সুস্থ করে তুলতে ডায়াটেশিয়ান, ফিজিওথেরাপিস্ট, স্পিচ এবং ভাষা থেরাপিস্ট এবং অকুপেশনাল থেরাপিস্ট সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
কোভিড-১৯ একসঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অংশকে আক্রমণ করে বিকল করে দেয় বলে রোগীকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা এতবড় চ্যালেঞ্জ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
শ্বাসকষ্ট
কোভিড-১৯ থেকে শারীরিকভাবে সেরে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সাধারণ চ্যালেঞ্জ হল শ্বাসকষ্ট কাটিয়ে উঠতে পারা।যারা আক্রান্ত হয়েছে, সেটা হালকা বা গুরুতর উপসর্গ হোক সকলের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।
ফলে সিঁড়ি ওঠানামার মত সহজ কাজও তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। বয়স্ক লোকেদের জন্য এটা বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করে।
যারা নিবিড় পরিচর্যায় থেকেছেন শ্বাস নেবার কষ্ট শুধু যে তাদের ক্ষেত্রে অনেকদিন থেকে যাচ্ছে তা নয়। এই ভাইরাসে কমবেশি আক্রান্ত প্রত্যেক রোগীকে এই সমস্যার সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। শ্বাসক্রিয়া আবার স্বাভাবিক হতে তাদের বেশ সময় লেগে যাচ্ছে।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রতিটি রোগীর যে কোন রোগব্যাধি থেকে সেরে ওঠার মধ্যে তফাত থাকে। কোভিড-১৯ নতুন একটা রোগ। এর থেকে পুরোপুরি সেরে ওঠার বিষয়টি নিয়ে গবেষক, চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা এখনও কাজ করে যাচ্ছেন।
সূত্র: বিবিসি
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন