মেটাবলিক সিনড্রোম: হজমে সমস্যা কী করবেন?

0
71

ডা. পঞ্চানন আচার্য্য
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।

প্রতিটি প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য শক্তি দরকার। এই শক্তির নাম হচ্ছে এটিপি, যেটা সরাসরি গাছে ধরে না, অথবা ছোটো ছোটো পুটুলিতে দোকানে বিক্রি হয় না। শক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে তাই প্রাণীরা খাবার গ্রহণ করে। এই খাবারটা আবার অনেক বিশাল একটা ব্যাপার, শরীরের কোষগুলো সেটা নিতে পারে না। এজন্য, যদি মানুষের কথাই ধরি, তারা প্রথমে রান্না বা পাক করে খাবারকে হজম উপযোগী করে নেয়। এরপর দাঁত দিয়ে চিবিয়ে আরো সহজপাচ্য করে নেয়। এরপরে এটি পাকস্থলীতে গিয়ে হজম রসের সহায়তায় এক জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীরের কোষগুলোর জন্য গ্রহণ উপযোগী করে শক্তি বা এটিপিতে পরিবর্তিত হয়। বিশেষভাবে পাক করা হয় বলে অর্থাৎ খাদ্যকে গ্রহণ উপযোগী করে তোলার মাধ্যমে শরীরে শক্তি জোগানোর এই প্রক্রিয়ার নাম বিপাকক্রিয়া, ইংরেজিতে বলা হয় মেটাবলিজম। শুধু শক্তি তৈরিই নয়, খাবার থেকে শরীর গঠনের বিভিন্ন উপাদান তৈরি এবং প্রক্রিয়া শেষে থেকে যাওয়া অপ্রয়োজনীয় অবশিষ্টাংশকে শরীর থেকে বের করে দেয়া এসব জটিল প্রক্রিয়াও এই মেটাবলিজম-এর অন্তর্ভুক্ত। পুরো প্রক্রিয়াটিই আসলে একটি জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়া সরল হোক বা জটিল-যেকোনো সময় এখানে দেখা দিতে পারে গণ্ডগোল, বাঁধতে পারে বিপত্তি। বিপাকক্রিয়ার ক্ষেত্রে বিপত্তির ইংরেজি নাম মেটাবলিক সিনড্রোম-এটাই আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু। সিনড্রোম বলতে একগুচ্ছ সমস্যাকেই বোঝায়। মেটাবলিক সিনড্রোমের মধ্যে প্রধানত তিনটি বিষয় একসঙ্গে গুচ্ছ আকারে থাকে-রক্তে উচ্চ মাত্রার শর্করা (গ্লুকোজ), উচ্চ-রক্তচাপ এবং স্থুলতা। এর সঙ্গে যুক্ত আছে রক্তে চর্বি সমস্যা- উচ্চ মাত্রার ট্রাইগ্লিসারাইড এবং কম মাত্রার হাই-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (এইচ ডি এল)। একইসঙ্গে থাকতে পারে ইউরিক এসিডের আধিক্য, ফ্যাটি লিভার, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের মতো অসুবিধা।

কেন এই বিপত্তিটা হয় এই প্রশ্নের উত্তর যথেষ্ট জটিল। কেননা অনেক বিষয় একসঙ্গে জড়িয়ে আছে। যেমন জীবনযাপন পদ্ধতি এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কম পরিশ্রমের জীবনযাপন, জাঙ্কফুড খাওয়া, ঘুমের অনিয়ম, শারীরিক ব্যায়াম না করা, ধূমপান ও মদ্যপানসহ অস্বাস্থ্যকর বা অনিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন-এইগুলোর নেতিবাচক ভূমিকা পরীক্ষিত সত্য। প্রসঙ্গত মানসিক স্বাস্থ্যগত বিষয়াদিও কিন্তু এই মেটাবলিক সিনড্রোমের পেছনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একজন মানুষের জীবনে মানসিক চাপের মাত্রা, সেই চাপের সঙ্গে সার্থকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে না পারা কিন্তু মেটাবলিক সিনড্রোমের সূচনা করতে পারে। এর বাইরে অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব, বংশগত কারণসহ আরো বিবিধ কারণেই এটি হতে পারে। বয়স বাড়ার কারণেও এর ঝুঁকি বাড়ে। গবেষণা বলছে, ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশি।
প্রশ্ন জাগতে পারে মেটাবলিক সিনড্রোম নিয়ে এত ভাবনা কেন? যদি একটু গুরুত্ব দিয়ে বোঝানোর জন্য বলি তবে বলা যায় মেটাবলিক সিনড্রোম আসলে অনেকগুলো রোগের বা শারীরিক সমস্যার সূতিকাগার। এর কারণে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চরক্তচাপ, রক্তনালীর সমস্যা, যকৃত ও কিডনির সমস্যাসহ নানাবিধ শারীরিক জটিলতার উৎপত্তি হতে পারে। কিন্তু, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মেটাবলিক সিনড্রোম হয়েছে কিনা বুঝতে পারা একটু কষ্টসাধ্য। এটি মূলত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল দেখে চিকিৎসকের মাধ্যমে জানা যায়। এছাড়া, সাধারণত মেটাবলিক সিনড্রোম যে তৈরি হয়ে গেছে শরীরে সেটার তেমন কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে। তবে শরীরের ওজন যদি বাড়তে থাকে, বিশেষ করে মেদভুঁড়ি যদি হতেই থাকে, তবে মেটাবলিক সিনড্রোমের বিষয়টি নিয়ে একজন সাধারণ মানুষের সতর্ক হওয়া উচিত। বয়স বাড়লেও একই কথা। সেইসঙ্গে গুচ্ছ আকারে যেই যেই সমস্যার কথা ওপরে বলা হয়েছে সেই সমস্যাগুলোর লক্ষণাদি দেখা গেলেও সতর্ক হতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক আগাতে হবে। করণীয় কী? এটাকে প্রতিরোধ করাই আসলে একমাত্র করণীয়। আর প্রতিরোধটা হতে হবে বহুমুখী বা বহুমাত্রিক। প্রথমেই আসে নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের দিকে নজর দেয়া। দৈনন্দিন জীবনযাপনে শারীরিক পরিশ্রমের পরিমাণ বাড়াতে হবে, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করতে হবে। সেইসঙ্গে অস্বাস্থ্যকর বা অনিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন পদ্ধতি পরিহার করতে হবে। এজন্য স্থুলতা বা অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে, সুষম স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে, ধূমপান-মদ্যপানসহ সব ধরনের নেশা থেকে দূরে থাকতে হবে, পরিমিত ঘুম ও বিশ্রামে মনোযোগী হতে হবে। নিয়মিত রক্তচাপ মাপাসহ শারীরিক অবস্থা বোঝার জন্য নির্দেশিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যেমন রক্তে শর্করার পরিমাণ, চর্বির পরিমাণ প্রভৃতি; নিয়মিত বিরতিতে করতে হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা মানসিক প্রফুল্লতা ধরে রাখতে হবে, মানসিক চাপ মোকাবেলা করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সবশেষে যদি এই ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েই যায় তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।

Previous articleবিএসএমএমইউর সহকারী হল প্রভোস্ট হলেন ডা. ফাতিমা
Next articleসমাজে নৈতিক অবক্ষয় নৈতিক ও ভালো চরিত্রের ছেলেমেয়েদেরকেও নষ্ট করে দেয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here