শারীরিক রোগের সাথে মানসিক রোগ : অসচেতনতায় বাড়ছে ট্রিটমেন্ট গ্যাপ

0
99

ডা. রেদওয়ানা হোসেন
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী স্বাস্থ্য হলো, ‘ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক অবস্থার একটি ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থান’। এর এক বা একাধিক অংশের ব্যত্যয় ঘটলে ব্যক্তির জীবনের স্বাভাবিকতা ব্যাহত হয়। তাই দেহ, মন ও সমাজ জীবনের একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির কথা চিন্তা করা যায় না।

শারীরিক ও মানসিক রোগের সহাবস্থান খুবই সাধারণ একটি বিষয়। দীর্ঘমেয়াদি কিংবা গুরুতর শারীরিক রোগ থেকে জন্ম নিতে পারে বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা কিংবা অন্য যেকোনো মানসিক রোগ। থাইরয়েড হরমোনজনিত সমস্যা, ডায়াবেটিস, নিউরোলজিক্যাল অথবা রিউমাটয়েড কোনো কোনো রোগ প্রাথমিকভাবে মানসিক রোগের লক্ষণ নিয়ে প্রকাশিত হতে পারে।

মৃগী রোগের সাথেও প্রায়শই উপস্থিত থাকে মানসিক রোগ। অপরদিকে মানসিক রোগের কারণে শারীরিক রোগের উৎপত্তিও লক্ষণীয়। সিজোফ্রেনিয়া বা গুরুতর বিষণ্ণতার রোগীরা অনেক সময়ই পুষ্টিস্বল্পতায় ভোগেন।

  • মনোরোগের চিকিৎসায় যে সকল ঔষধ ব্যবহৃত হয় সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে সেবন করলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল ইত্যাদি রোগ দেখা দিতে পারে। নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে থাকলে অবশ্য এই সমস্যা মোকাবেলা সম্ভব।

বর্তমান বিশ্বে এখন অসংক্রামক ব্যাধির আধিক্য। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার এবং শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ এসকল রোগের মধ্যে অন্যতম। বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগজনিত রোগ পরবর্তীতে জন্ম দিতে পারে হৃদরোগের।

আবার গবেষণায় দেখা গেছে যে যেসকল ব্যক্তি সিজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলার ডিজঅর্ডারে ভুগছেন তাদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হৃদরোগ। মাদকাসক্তিও হৃদরোগের ঝুঁঁকি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

ডায়াবেটিসের সাথে বিষণ্ণতার সম্পর্কটা দ্বিমুখী। ডায়াবেটিস যেমন বিষণ্ণতার ঝুঁকি বাড়ায় তেমনি বিষণ্ণতা থেকেও হতে পারে ডায়াবেটিস। সাধারণ মানুষের চেয়ে ডায়াবেটিক রোগীরা বিষণ্ণতার দুই থেকে তিন গুণ বেশি ঝুঁকিতে থাকেন এবং এ হার নারীদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে বেশি।

ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরা অত্যধিক মানসিক চাপে থাকেন যা থেকে দেখা দেয় স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, বিষণ্ণতা বা উদ্বেগজনিত রোগ। ক্যান্সারের চিকিৎসাতেও এসকল রোগের ঝুঁকি বাড়ে। শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি রোগে যারা আক্রান্ত তাদের প্রায় সবারই ধূমপানের ইতিহাস থাকে। সাধারণ মানুষের চেয়ে মানসিক রোগীদের মধ্যে ধূমপানের হার অনেক বেশি। আবার দুশ্চিন্তা এবং বিষণ্ণতায় বেড়ে যেতে পারে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ।

অসংক্রামক ব্যাধিসহ সকল শারীরিক রোগের সাথে মানসিক রোগের সহাবস্থান কোনো দুর্লভ বিষয় নয়। একটি বিশাল অঙ্কের মানুষ পৃথিবীব্যাপী কোমরবিড মেন্টাল ডিজঅর্ডারে ভুগছে। তাদের রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় না করা গেলে মেন্টাল হেলথ ট্রিটমেন্ট গ্যাপ অনেকাংশে বেড়ে যাবে।

  • তাই শারীরিক রোগাক্রান্ত প্রতিটি ব্যক্তির মানসিক রোগের জন্য স্ক্রিনিং করা প্রয়োজন। এটি করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সচেতনতা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পিরামিড মডেল অনুযায়ী সেলফ কেয়ার, প্রাইমারি হেলথ কেয়ার এবং বিশেষায়িত মানসিক সেবা এই তিন স্তরে কোমরবিড মানসিক রোগের চিকিৎসা দেয়া যায়। সেলফ কেয়ার এবং ইনফর্মাল কেয়ারের আওতায় সর্বাগ্রে প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি। সাধারণ মানুষকে মানসিক রোগের সাধারণ লক্ষণগুলি সম্বন্ধে সচেতন করা এবং কোন পর্যায়ে চিকিৎসা প্রয়োজন সে বিষয়ে তাদেরকে তথ্য দেয়া এই স্তরের মূল উদ্দেশ্য।

প্রাইমারি কেয়ারে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার মান বাড়াতে এবং যথাযথ রেফারেল সিস্টেম তৈরি করতে জেনারেল প্রাকটিশনারদের ট্রেনিং দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। স্পেশালিস্ট সার্ভিস বলতে জেনারেল হাসপাতালে সাইকিয়াট্রি বিভাগ চালুকরণ বোঝানো হয়। এসকল বিভাগে বিশেষজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞবৃন্দ চিকিৎসা দেন।

কনসাল্টেশন লিয়াজো সাইকিয়াট্রি প্র্যাকটিসের মাধ্যমে মেডিসিনের বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি রোগীদের কোমরবিড মানসিক রোগ চিকিৎসায় এই বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ট্রিটমেন্ট গ্যাপ কমিয়ে আনতে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। শারীরিক রোগের সাথে কোমরবিড মানসিক রোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবহেলিত। মানসিক রোগের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা না দিতে পারলে তার বিরূপ প্রভাব রোগীর ওপরই পরবে।

যে ব্যক্তিটি সমন্বিত চিকিৎসায় হতে পারত সুস্থ কর্মক্ষম একজন মানুষ, সে হয়ে উঠবে পরিবার ও সমাজের বোঝা।

তাই শারীরিক ও মানসিক রোগ নির্ণয়ে অবহেলা নয়। দক্ষ ও সচেতন জনবল তৈরির মাধ্যমে কমিয়ে আনতে হবে ট্রিটমেন্ট গ্যাপ। মনে রাখতে হবে, রোগ নয়, প্রয়োজন রোগাক্রান্ত মানুষটির চিকিৎসা।

লেখক :
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

/এসএস/মনেরখবর/

Previous articleপ্যানিক ডিজঅর্ডার চিকিৎসায় ভালো না হওয়ার কারণ ও প্রতিকার
Next articleচোখে ঝাপসা দেখি, কাজ করতে পারি না

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here