শিশুর মোবাইল-টিভি আসক্তি কখন, কীভাবে বুঝবেন?

0
111

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ

বর্তমান যুগকে বলা হয়ে থাকে তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগের স্বর্ণযুগ। সুতরাং এই যুগে বসবাস করে এর ব্যবহারকে অস্বীকার করা অনেকটা সাঁতার কাটতে নেমে পা না ভেজানোর মতো মনে হবে।

বিশ্বজুড়েই প্রযুক্তির প্রতি মানুষের একটা বিশেষ আকর্ষণ তৈরি হয়েছে, যাকে গ্যাজেটপ্রেম বললে হয়ত ভুল হবে না। স্মার্ট-ফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, ডিজিটাল ক্যামেরার প্রতি বড়োদের দেখে শিশুদেরও আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে, কারো কারো কাছে এর ব্যবহার স্মার্টনেসের প্রতীক হিসেবে দেখা যাচ্ছে।

আজকাল যোগাযোগের সবচেয়ে বড়ো মাধ্যম মোবাইল ফোন। বর্তমানে মানুষ এর প্রতি এতটাই নির্ভরশীল যে, মোবাইল ছাড়া যেন জীবনটাই অচল। আর এই মোবাইল ফোনটাই অনেক বাবা-মা শখ করে বাচ্চার হাতে তুলে দিচ্ছেন। স্মার্ট-ফোন এখন শিশুদের খেলার সঙ্গী। অধিকাংশ বাবা-মা ব্যস্ত থাকেন চাকরি-বাকরি আর ব্যাবসা নিয়ে। সন্তান একা সময় কাটায়, তাই অনেক অভিভাবক সময় কাটানোর জন্য হাতে তুলে দেন মোবাইল, ট্যাব অথবা টিভি।

কিন্তু এই প্রযুক্তিই আবার অনেক সময় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যতক্ষণ পর্যন্ত বিনোদনের পর্যায়ে থাকে ততক্ষণ কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু এর চেয়ে বেশি যদি হয় তখনই বিপদ। অতএব আমরা কখন বুঝব যে প্রযুক্তির এই ব্যবহার আমাদের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তারজন্য নিম্নোল্লিখিত বিষয়গুলো বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে :-

• যদি দেখা যায় বাচ্চার টিভি বা মোবাইল ব্যবহারের সময় ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে।
• শিশুর হাত থেকে মোবাইল বা ট্যাব কেড়ে নিলে তারা রেগে যায় বা নেতিবাচক আচরণ শুরু করে।
• টিভি, মোবাইল বা ট্যাব ছাড়া খেতে চাচ্ছে না। দেহ নিয়ে বিষণ্ণতায় ভুগছে।

কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে সবার আগে জানতে চায় ওখানে টিভি অথবা ইন্টারনেট সংযোগ আছে কিনা? না থাকলে সেখানে বেড়াতে যাওয়া একদম উচিত নয়। এছাড়াও….

• সারাক্ষণ কার্টুন বা গেইম বিষয়ে আলোচনা করে।
• পড়াশুনায় মনোযোগ, আগ্রহ কমে যাওয়া। টিভি বা মোবাইল লেখার সময় নিয়ে মিথ্যা কথা বলা।
• মোবাইল বা টিভি ছাড়া অন্য বিষয়ে (বই পড়া, খেলাধুলা করা, বেড়াতে যাওয়া) আনন্দ খুঁজে না পাওয়া।
• মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেলে আতঙ্কিত হয়ে পড়া।
• সামাজিক মেলামেশা কমে যাওয়া।
• বেশিরবাগ সময় মোবাইল, ট্যাব বা টিভিতে চোখ থাকা।

ওপরের এই সমস্যাগুলো ছাড়াও আরো বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক (ওজন বেড়ে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, ঘুমের সমস্যা, অতিচঞ্চলতা, বিষণ্ণতা, সামাজিক ভীতি ইত্যাদি) সমস্যা দেখা দিতে পারে।

বয়ঃসন্ধির সমস্যা, স্কুলের চাপ, বিশৃঙ্খল বা কঠোর পারিবারিক পরিবেশ-প্রকৃতি ভুলে থাকতেই অনেকে ইন্টারনটের আশ্রয় নেয়। বাবা-মা অনেক সময় এই আসক্তির ব্যাপারটা বুঝতে পারেন না, যতক্ষণ না বাচ্চার আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে।

২০১৭ সালে ১১ থেকে ১৫ বছর বয়স্ক দেড় হাজার কিশোর-কিশোরীর ওপর গবেষণা চালায় রয়্যা সোসাইটি অব পাবলিক হেলথ। এতে দেখা যায়, স্ন্যাপচ্যাট এবং ইনস্টাগ্রাম তাদের মনে সবচেয়ে বেশি হীনম্মন্যতা এবং দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে। ১০ জনের মধ্যে ৭ জন বলেছে ইনস্টাগ্রামের কারণে তাদের নিজেদের বয়সের তরুণ-তরুণীদের অর্ধেকই বলেছে ফেসবুকের কারণে তাদের মানসিক দুশ্চিন্তা ও অশান্তি বেড়ে গেছে।

ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব নিউরোসাইকিয়াট্রিক মেডিসিনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি আটজন মার্কিন নাগরিকের একজন প্রযুক্তিতে আসক্ত। আমাদের দেশে তেমন কোনো পরিসংখ্যান বা গবেষণা না থাকলেও আশপাশে তাকালে বোঝা যায়, প্রযুক্তি আসক্তি দিন দিন বাড়ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) চিহ্নিত ব্যাধির তালিকায় ঢুকতে যাচ্ছে ভিডিও গেমস আসক্তি। বিশেষজ্ঞারা ইলেক্ট্রনিক গেমসের মধ্যে আসক্তির ঝুঁকি শনাক্ত করায় ‘গেমিং ডিজঅর্ডার’ নামে এ ব্যাধি ডব্লিউএইচও’র ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ’র (রোগের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত শ্রেণিবিন্যাস, আইসিডি) ১১তম সংস্করণে স্থান পেতে চলেছে।

ওপরের পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, আমাদের প্রযুক্তির ভালো দিকগুলোর পাশাপাশি মন্দ দিক সম্পর্কেও জানতে হবে। বিশেষত শিশু-কিশোরদের কাছে বিনোদনের অন্যান্য মাধ্যমগুলোকে পরিচিত করতে হবে অন্যথায় তৈরি হতে পারে নানান ধরনের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা।

লেখক : ডা. হোসনে আরা
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
আদ-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

  • মাসিক মনের খবর প্রিন্ট ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতে চাইলে কল করুন : 01797296216 এই নাম্বারে। অথবা মেসেজ করুন পেজের ইনবক্সে। লেখা পাঠাতে পারেন monerkhaboronline@gmail.com বা এই 01844618497 হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে।
Previous articleমানসিক স্বাস্থ্যসেবা পিছিয়ে থাকলেও এখন সামনে এসেছে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
Next articleবাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মনোবিদ দেখানো দরকার : ওয়াসিম আকরাম
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here