জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ‘দুই সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’- টাইপের স্লোগান আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। পৃথিবীর উন্নত অনেক দেশের ন্যায় আমাদের মতো অনেক জনবহুল দেশেও এ ধরণের স্লোগান খুব জনপ্রিয়। কিন্তু গবেষণা বলছে পরিবারের অধিক শিশু থাকলে তাদের মানসিক বিকাশ অধিক ত্বরান্বিত হয়। অন্যথা শিশুরা মানসিক সমস্যায় ভোগে তুলনামূলকভাবে অন্যদের থেকে বেশি।
সম্প্রতি মার্কিন বহুজাতিক প্রকাশনা সংস্থা উইলিতে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে এ তথ্য জানানো হয়। গবেষণাটি করেছেন অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশের দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।
পরিবারে এক শিশুর তুলনায় দুই বা ততোধিক শিশু থাকলে তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এমনকি শিশুর প্রাথমিক শৈশব বিকাশ পরিবারে শিশুর সংখ্যাধিক্যের ওপর নির্ভর করে। প্রত্যেক নতুন শিশুর জন্মে এ উন্নয়ন কমপক্ষে পাঁচ শতাংশ হারে বেড়ে যায়।
‘আরলি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইটস অ্যাসোসিয়েশন উইথ ম্যাটারনাল প্যারিটি’ শিরোনামে গবেষণাটি করেছেন অস্ট্রেলিয়ার ‘লা ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয়’র পাবলিক হেলথ বিভাগের শিক্ষক এম মফিজুল ইসলাম এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক ড. নুরুজ্জামান খান।
বাংলাদেশ মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯ এর তথ্য ইউনিসেফ নির্দেশিত চারটি ডোমেইন বিশ্লেষণ করে শিশুর প্রাথমিক বিকাশের ক্ষেত্রে এ তথ্য তুলে ধরেন গবেষকরা। ডোমেইনগুলো হলো শারীরিক বিকাশ, সাক্ষরতা ও সাংখ্যিক বিকাশ, শিখন ক্ষমতা ও সামাজিক আবেগ-অনুভূতির বিকাশ।
বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ৩৬ থেকে ৫৯ মাস বয়সী (৩ থেকে ৫ বছর) ৯ হাজার ৩৮০টি শিশুর ওপর এ গবেষণা চালানো হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ২৫ শতাংশ শিশুর প্রাথমিক শৈশব বিকাশ ঠিকমতো হচ্ছে না। ৭১ শতাংশ শিশুর সাক্ষরতা ও সাংখ্যিক বিকাশ বিঘ্নিত হচ্ছে, ২৭ শতাংশ শিশু সামাজিক আবেগের দিক থেকে অবিকশিত থেকে যাচ্ছে। ৯ শতাংশ শিশু শেখার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে। আর ১ শতাংশ শিশু শারীরিকভাবে বিকশিত হচ্ছে না। এ সমস্যাগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ ঘটছে পরিবারে শিশুর সংখ্যা তুলনামূলক কম হওয়ার কারণে।
গবেষণা বলছে, শিশুদের প্রাথমিক বিকাশের ওপর তাদের মা কত সংখ্যক সন্তান গ্রহণ করছেন তার একটি সম্পর্ক রয়েছে। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নির্ভর করে মায়েদের সন্তান গ্রহণের ওপর। একজন মা একের অধিক সন্তান গ্রহণ করলে শিশুদের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। এক্ষেত্রে মায়েরা যদি মাধ্যমিক অথবা উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন তাহলে অন্যদের তুলনায় সেই মায়ের শিশু সঠিকভাবে বিকশিত হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গবেষক ড. নুরুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মূলত তিনটি কারণে সমস্যাগুলো হচ্ছে। প্রথমত, বাংলাদেশে শিক্ষিত পরিবারগুলো সন্তান কম নিতে আগ্রহী। বাবা-মা শিক্ষিত হওয়ায় তারা চাকরিক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। এতে তাদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। যে কারণে ওই পরিবারের শিশুটি মা-বাবার কাছ থেকে পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছে না। ফলে শিশুটি বেড়ে উঠছে বাড়ির কাজের মানুষটির সঙ্গে অথবা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসে বুঁদ হয়ে, যেটা সবচেয়ে বেশি হয়। এতে ওই শিশুটির বিকাশ বিঘ্নিত হচ্ছে।’
‘দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে শিশুদের প্রাথমিক বিকাশ নিয়ে তেমন কোনো একাডেমিক পড়াশোনার ব্যবস্থা নেই। এ সম্পর্কে বাবা-মায়েদের জ্ঞান নেই বললেই চলে। তারা বেশিরভাগই অসচেতন। জাতীয় পর্যায়েও এ ব্যাপারে সচেতনামূলক কোনো ক্যাম্পেইন লক্ষ্য করা যায় না। তৃতীয়ত, দেশে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। ফলে শিশুদের একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের পথ রুদ্ধ হচ্ছে। এটি একটি বড় সমস্যা।’
‘মূলত, পরিবারে সন্তান বেশি থাকলে শিশুরা নিজেদের সঙ্গে মিশতে পারে। একে অন্যের সঙ্গে সময় কাটালে উৎফুল্লতা বাড়ে। ফলে উন্নয়ন ঘটে’ বলে গবেষক ড. নুরুজ্জামান খান এর অভিমত।
সমস্যাগুলোর সমাধানে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত শিশুদের প্রাথমিক বিকাশ সম্পর্কে পড়াশোনার ফিল্ড তৈরি করা। প্রি-প্রাইমারি (প্রাক-প্রাথমিক) লেভেলে জোর দিতে হবে। বাবা-মায়েদের সন্তানদের সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। বাবা-মা যেন পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের সঙ্গে বেশি সময় দেন সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি জরুরিভাবে ডিভাইস ডিপেন্ডেন্সি কমাতে হবে। হোক বাবা-মা কিংবা শিশু। সন্তানদের সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে পর্যাপ্ত সময় কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।’
আরো পড়ুন…
ওসিডি হলে করণীয় কী? : (চতুর্থ ও শেষ পর্ব)
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে
/এসএস