ডিলুশন : বিভ্রমের জগত

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ

(১)
মজিদ সাহেব একজন ব্যাংকার। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল এতদিন, এখনো চলছে। শুধু মাঝখানে তাল কেটে গেছে। কারণ, তাঁর স্ত্রী অন্য কোনো এক পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। প্রথমের সামান্য সন্দেহ আজ দৃঢ় বিশ্বাসের মহিরুহ।

সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে সারাদিন মাথায় ঘুরতে থাকে বাসায় কী হচ্ছে, কী চলছে। ব্যাংকের কাজে কোনো সমস্যা হচ্ছে না, অন্যদের সাথে সম্পর্কেও কোনো সমস্যা নেই।

সবই ঠিক কিন্তু স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। সেদিন পরীক্ষা করার জন্য বাসার বাইরের পাপোশটা একটু বাঁকা করে রেখে এসেছিলেন, বাসায় ফিরে দেখেন সেটা সোজা করে রাখা হয়েছে। স্ত্রী যতই বলেন এটা ঝাড়– দেয়ার সময় ঠিক করে রাখা হয়েছে- মজিদ সাহেব তত নিশ্চিত হন যে ঘরে কেউ নিশ্চয়ই এসেছিল। নাহলে স্ত্রী এত চিৎকার করে বুঝাতে চাইছে কেন।

আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য বাসায় সিসি ক্যামেরা বসিয়েছেন। স্ত্রী যখন জিজ্ঞেস করেছেন যে এগুলা হঠাৎ কেন; তিনি নিঃসন্দেহ হলেন এবার কিছু একটা ধরা পড়বে। কিন্তু এক মাসেও কিছু পাওয়া গেল না। তখন তিনি আরো কিছু ক্যামেরা নিয়ে এসে বিভিন্ন কোণায় বসিয়ে দিলেন, এমনকি বৈঠকখানায় চার কোণাতে চারটা ক্যামেরা বসানো হল। তাতেও কিছু না আসাতে উনি ধরেই নিলেন যে আসলে ঘরে কিছু হচ্ছে না, সবই বাইরে। কারণ, সেদিন ক্যামেরাতে তাঁর স্ত্রীকে দেখা গেল বাইরে থেকে এসেই হাত মুখ না ধুয়েই বিছানায় শুয়ে পড়তে এবং বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমাতে। এরপর থেকে ব্যাংকে বসে থেকেও চোখ থাকে তাঁর মোবাইলে, বাসার ক্যামেরাগুলোতে কী হচ্ছে, কখন স্ত্রী বাইরে যান সেটার নজরদারিতে।

একদিন বাজারে গিয়ে নজরদারি করতে গিয়ে ধরা পড়েন অন্য লোকের হাতে। লোকটি মজিদ সাহেবকে ভেবেছিল একজন সন্দেহজনক মানুষ হিসেবে যিনি অনেকক্ষণ একজন মহিলার পিছনে পিছনে ঘুরছেন। সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। তাঁর স্ত্রী তাঁকে উদ্ধার করে আনলেন বটে, তবে এখন ডিভোর্স দিতে চান।

(২)
হারুন কয়েকমাস ধরে বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তার দৃঢ়বিশ্বাস কিছু লোক তার গতিবিধি সারাক্ষণ পর্যবেক্ষণ করছে। সে অনেক চেষ্টা করেছে তাদের নজরদারি এড়িয়ে চলতে। কিন্তু তার শরীরের কোথাও একটা ইলেকট্রনিক চিপ বসানো হয়েছে; যে কারণে সে যেখানেই থাকুক না কেন সে তথ্য ওই লোকগুলোর কাছে চলে যাচ্ছে। এসব চিন্তাতে আর চিপটি খুঁজে বের করতে গিয়েই তার নাওয়া-খাওয়া সব বন্ধ। অবশেষে একদিন বিকালে সবাই ধরাধরি করে হারুনকে হাসপাতালে ভর্তি করল। সে চিপস বের করতে গিয়ে নিজের পায়ে ক্ষত করে ফেলেছে।

(৩)
ওপরের দুইজনের মধ্যে প্রথমজনকে আপাতদৃষ্টিতে একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবেই মনে হয়। আমাদের মনে এমন ধারণা হতেই পারে যে, মজিদ সাহেবকে একটু সন্দেহবাতিক বলা চলে কিন্তু সেটা তো স্বাভাবিকভাবে হতেই পারে। কিন্তু দ্বিতীয়জনকে নিশ্চিতভাবেই অস্বাভাবিক ধরে নেয়া যায়। মজার বিষয় হচ্ছেÑউনারা দুজনেই একধরনের মানসিক সমস্যা বা মানসিক অসুবিধার লক্ষণ দেখাচ্ছেন। যার নাম ডিলুশন। বাংলায় বলা চলে চিন্তাভ্রম বা ভ্রমাত্মক চিন্তা। সারা বিশ্বজুড়েই অনেক মানুষ বিভিন্ন ডিলুশনে আক্রান্ত হয়ে বিবিধ মানসিক রোগে ভুগছেন। ডিলুশন হচ্ছে এমন একটি দৃঢ় বিশ্বাস, যেটি মিথ্যা ভিত্তির ওপর গড়ে উঠে এবং যার বিপরীতে কোনো সঠিক তথ্যপ্রমাণ বা যুক্তি তুলে ধরলেও তার বিশ্বাসের পরিবর্তন হয় না। ওপরের উদাহরণগুলোর দিকে খেয়াল করলেই দেখবেন মজিদ সাহেব কিংবা হারুন তাঁদের বিশ্বাসে অটল ছিল এবং কোনো যুক্তি বা প্রমাণে তাঁরা সে বিশ্বাস থেকে সরে আসেননি।

  • ডিলুশন হতে পারে অনেক ধরনের। বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করলে অন্তত চৌদ্দ ধরণের ভ্রান্তচিন্তা পাওয়া যায়। জেনে নেয়া যাক কিছু উল্লেখযোগ্য ধরণ :

সবচেয়ে বেশি যে ডিলুশন পাওয়া যায় সেটি হচ্ছে পারসিকিউটরি ডিলুশন, যেখানে একজন ব্যক্তি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, কেউ বা কিছু লোকজন বা কোনো সংস্থা তাঁর বিরুদ্ধে নেমেছে। সে বা তারা তাঁকে মেরে ফেলতে চায় বা বিপদে ফেলতে চায় বা বদনাম রটাতে চায়। ডিলুশন অব রেফারেন্সে আক্রান্ত মানুষ যখন দেখেন দ‚রে একাধিক লোক আলোচনা করছে তখন ধরেই নেন যে, তাঁকে নিয়েই কথা বলছে, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে অথবা তাঁকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করছে। অনেকেই মজিদ সাহেবের মতো বিনা প্রমাণেই তার জীবনসঙ্গীকে নিয়ে সন্দেহ করেন, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, স্ত্রী অন্যের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন।

অনেকেই বিশ্বাস করেন যে তার শরীরে কোনো না কোনো রোগ রয়েছে যেটা এখনো ধরা পড়েনি আর তাই ঘন ঘন চিকিৎসক দেখান এবং পাল্টান, একই পরীক্ষা অনেকবার করে করতে থাকেন। কেউ কেউ নিজেকে অনেক বড়ো বলে ভাবতে থাকেন, অতি-আত্মবিশ্বাসী হয়ে। অন্যদিকে কেউ কেউ নিজেকে ধরেই নেন যে, জীবনে অনেক ভুল করে ফেলেছে। পৃথিবীতে সে অনেক বড়ো অপরাধী। কিছু অসম্ভব এবং অকল্পনীয় ভ্রান্ত বিশ্বাসেও দৃঢ় আস্থা পোষণ করেন। যেমন : দিব্যি সুস্থ মানুষ, কিন্তু বিশ্বাস করছে যে তার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেছে অথবা পেটের সব নাড়িভুড়ি সব পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন চিকিৎসককে অনুরোধ করতে থাকেন সেসব ঠিক করতে। অনেকেই আবার সব কিছু থেকে গুটিয়ে নেন নিজেকে এটা চিন্তা করে যে, সবকিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে অথবা খুব শীঘ্রই তা হবে।

ডিলুশন বা বিভ্রম এবং প্রচলিত বিশ্বাস

এখন প্রশ্ন আসতেই পারে যে, এভাবে তো স্বাভাবিক লোকও চিন্তা করতে পারে সময়ে সময়ে। তাহলে পার্থক্য কী? আসলেই পার্থক্য করতে পারাটা অনেক সময়ই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন পড়তে পারে। এখন প্রশ্ন বিশেষজ্ঞরা কিসের ভিত্তিতে এটা করেন?

এই প্রশ্নের সম্প‚র্ণ উত্তর দেয়া হলে জনসাধারণের জন্য তা বুঝতে জটিল হতে পারে। তবে, সাধারণভাবে একটা বিষয় জানানো জরুরি বলে মনে হয়। যেসব চিন্তাকে আমরা একজন ব্যক্তির সামাজিক, শিক্ষাগত, ধর্মীয় বা জীবন দর্শনের প্রেক্ষাপট থেকে ব্যাখ্যা করা যায়, সে সব চিন্তাকে কখনোই ডিলুশন ভাবা হবে না। ধরা যাক একজন মনে করছে যে তার যাবতীয় কাজ কর্ম, চিন্তা বা অনুভূতি কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। মানে অন্যের দ্বারা সে নিয়ন্ত্রিত।

এখন এর ব্যাখ্যা হিসেবে সে যখন বলবে স্রষ্টার কথা তখন এটা হবে স্বাভাবিক চিন্তা। আর যখন সে ব্যাখ্যা করবে কোনো গোয়েন্দা সংস্থা বা অন্য কোনো ব্যক্তির কথা তখন সেটা ডিলুশন হিসেবেই ভাবতে হবে। কেননা, কোনো গোয়েন্দা সংস্থা বা ব্যক্তি কারো গতিবিধি নজরে রাখতে পারে, বাধ্য করতে চেষ্টা করতে পারেÑকিন্তু এরকম সর্বব্যাপী সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মানে সে কি চিন্তা করবে, অনুভব করবে, কী করবে সবকিছুই কখনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

সব কথার শেষ কথা, ডিলুশনে আক্রান্ত ব্যক্তি আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক চিন্তার অধিকারী মনে হতেই পারে। কিন্তু এটি আসলেই সমস্যাজনক। এটি সমস্যাজনক ওই ব্যক্তির জন্য, ওই ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ মানুষজনের জন্য, এমনকি পুরো সমাজের জন্যই। তাই, কোনো ব্যক্তির চিন্তাধারায় অযৌক্তিক ভাবনার প্রাবল্য দেখা দিলে এবং সেটা অন্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ালে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা প্রয়োজন। তবে, একই সাথে সতর্ক থাকতে হবে, আমার বা সমাজের প্রচলিত চিন্তার সাথে না মিললেই সেটা ডিলুশন হয়ে যায় না।

লেখক : ডা. পঞ্চানন আচার্য্য
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।

সূত্র : মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন সেপ্টেম্বর ২০২২ সংখ্যা

  • মাসিক মনের খবর প্রিন্ট ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতে চাইলে কল করুন : 01797296216 এই নাম্বারে। অথবা মেসেজ করুন পেজের ইনবক্সে। লেখা পাঠাতে পারেন monerkhaboronline@gmail.com বা এই 01844618497 হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে।

/এসএস/মনেরখবর/

Previous articleআজীবন সম্মাননা : অধ্যাপক সৈয়দ মাহফুযুল হক এর সাফল্যগাঁথা
Next article‘প্রয়োজন ছাড়া কখনো মুঠোফোন ব্যবহার করা উচিত নয়’ অধ্যাপক ডা. কাওসার
ডা. পঞ্চানন আচার্য্য। স্থায়ী ঠিকানা চট্টগ্রাম। তবে, কলেজ শিক্ষক মায়ের চাকুরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কেটেছে শৈশব। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবং উচ্চ-মাধ্যমিক চট্টগ্রাম কলেজ থেকে। সিলেট এম. এ. জি. ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস পাসের পর সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। মেডিক্যালে পড়ার সময় থেকেই মনোরোগ নিয়ে পড়ার প্রতি আগ্রহ। তাই, ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্ধারিত সময়ের চাকুরি শেষে ভর্তি হন মনোরোগবিদ্যায় এম.ডি(রেসিডেন্সি) কোর্সে। বর্তমানে তিনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত শিক্ষকতার ধারা বজায় রেখে চিকিৎসক ও শিক্ষক হওয়াটাই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। বই, সঙ্গীত আর লেখালেখিতেই কাটে অবসর সময়ের বেশির ভাগ। স্বপ্ন দেখেন - মেধা ও মননশীলতার চর্চায় অগ্রগামী একটা বাংলাদেশের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here